প্রাথমিক-মাধ্যমিক স্তরে ৬ বছরে পাঠ্যবই বদল ১২ বার!
ঘন ঘন পদ্ধতি বদলের কারণে অগোছালোই থেকে যাচ্ছে দেশের প্রাথমিক থেকে উচ্চমাধ্যমিক স্তরের শিক্ষাব্যবস্থা। একটি পদ্ধতি ঠিকমতো কার্যকর হওয়ার আগেই চালু হচ্ছে আরেকটি ব্যবস্থা। পরিবর্তিত পদ্ধতির সঙ্গে ঠিকমতো খাপ খাওয়াতে পারছেন না শিক্ষক ও শিক্ষার্থীরা। কোনো কোনো পদ্ধতির স্পষ্ট ব্যাখ্যাও দিতে পারছেন না মন্ত্রণালয়ের শীর্ষ কর্মকর্তারা। পদ্ধতিগুলো রপ্ত করতে বেশির ভাগ শিক্ষক ব্যর্থ হচ্ছেন।
ফলে একদিকে যেমন উপযুক্ত শিক্ষাব্যবস্থা দাঁড়াতে পারছে না; তেমনি অপচয় হচ্ছে সরকারের মোটা অঙ্কের অর্থ। পদ্ধতিগুলো বাস্তবায়নের নামে অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগও উঠছে শিক্ষা, গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়সহ সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন বিভাগের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বিরুদ্ধে। আর নতুন নতুন এসব পদ্ধতির সঙ্গে তাল মেলাতে না পেরে সবচেয়ে বেশি ক্ষতির মুখে পড়ছেন শিক্ষার্থীরা।
এক অনুসন্ধানে দেখা গেছে, গত ১২ বছরে দেশে এই স্তরের শিক্ষাব্যবস্থায় কেবল পাঠ্যবই-ই বদল হয়েছে ছয়বার। প্রাথমিক সমাপনীসহ পরীক্ষা পদ্ধতি বদলেছে চারবার, একাদশে ভর্তি পদ্ধতি একবার ও খাতা মূল্যায়ন পদ্ধতি দুবার। এ ছাড়া পদ্ধতি বদলের ঘোষণা দিয়েও সেখান থেকে সরে এসেছে বেশ কিছুবার। এর ফলে বারবার বিভ্রান্তিতে পড়তে হয়েছে শিক্ষার্থী, অভিভাবক ও শিক্ষকদের।
শিক্ষাব্যবস্থায় পরিবর্তনকে ইতিবাচক হিসেবে দেখলেও পরিবর্তনের নামে ‘পরীক্ষা-নিরীক্ষা’ কাম্য নয় বলে মন্তব্য করেছেন জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক মীজানুর রহমান।
তিনি বলেন, ‘পরিবর্তন কাম্য। পাঠ্যবই দু-তিন বছর পর বদলাতে পারে। তবে আমাদের শিক্ষাব্যবস্থায় পরিবর্তনের নামে এক ধরনের পরীক্ষা চলছে। সব পদ্ধতি বিশেষজ্ঞদের পরামর্শে চালু হচ্ছে-এমন নয়। কোনো কোনোটার বেলায় বিদেশি সংস্থার পরামর্শও আছে।
তিনি আরো বলেন, একটা পদ্ধতি চালুর পর সমালোচনার মুখে আরেকটা পদ্ধতি চালু হচ্ছে বা আগের পদ্ধতিতে ফিরে যাচ্ছে। ফলে শিক্ষাব্যবস্থার পদ্ধতিতে স্থিতিশীলতা আসছে না। শিক্ষার্থীরা এর বলি হওয়ায় নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে শিক্ষাব্যবস্থার ওপর। ঘন ঘন পদ্ধতি বদল না করে শিক্ষা বাস্তবায়ন কেমন হচ্ছে, সেসব বিষয়ে মনোযোগী হওয়া বেশি জরুরি।’
গত ১২ বছরের শিক্ষাব্যবস্থা পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, এ সময়ের মধ্যে শিক্ষা ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের চালু করা কোনো পদ্ধতিই শেষ পর্যন্ত টেকেনি। বাতিল হয়েছে চালু হওয়ার বছর খানেকের মধ্যে। ঢাকঢোল পিটিয়ে দেওয়া দুই মন্ত্রণালয়ের অনেক ঘোষণারও বাস্তবায়ন নেই।
শিক্ষানীতিতে উল্লেখ না থাকলেও প্রাথমিক সমাপনী পরীক্ষা ঠিকই চলছে। এমন কিছু পদ্ধতি চালু রয়েছে, যেগুলোর জন্য মার্ক বৈষম্যের শিকার হচ্ছেন শিক্ষার্থীরা। কিছু পদ্ধতি বাস্তবায়নের বাজেট খরচ হচ্ছে কর্মকর্তাদের বিদেশ ভ্রমণ ও কর্মশালায়। সুফল পাচ্ছেন না শিক্ষার্থীরা।
দুই শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, গত পাঁচ বছরের মধ্যে কেবল পাঠ্যবই-ই বদল হয়েছে পাঁচবার। পরীক্ষা পদ্ধতি পাল্টানো হয়েছে কয়েকবার। প্রস্তুতি ছাড়া আবার আমূল বদলাচ্ছে নবম ও দশম শ্রেণির ১২টি পাঠ্যবই। একাদশ শ্রেণিতে ভর্তির পদ্ধতি দুই বছর আগে চালু হলেও চলতি শিক্ষাবর্ষ থেকে তা পাল্টাচ্ছে। দেড় দশকে শিক্ষার্থী মূল্যায়ন পদ্ধতিও বদলেছে তিনবার।
এসব ভাঙাগড়ার মধ্যে আবার শিক্ষার্থী মূল্যায়নে গত ২৮ মে সবচেয়ে বড় পরিবর্তন আনার ঘোষণা দেন শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ। নতুন এ ব্যবস্থা চালু হলে শিক্ষার্থীর প্রাপ্ত নম্বর বাড়িয়ে ও কমিয়ে মূল্যায়ন হবে। নম্বরের ভিত্তিতে নয়, সরকার নির্ধারণ করে দেবে জিপিএ-৫-এর সংখ্যা। দুই বছর আগে একাদশে ভর্তি-নীতিমালা চালু হলে নানাভাবে হয়রানির শিকার হন শিক্ষার্থীরা। অনেক শিক্ষার্থীকে একাধিক কলেজে ভর্তি ফি দিতে হয়। শেষে বাধ্য হয়ে সেটি বাতিল করে গত ২৮ মে শিক্ষা মন্ত্রণালয় ফের নতুন নীতিমালা ঘোষণা করে।
এমনকি আগামী শিক্ষাবর্ষ থেকে সহজীকরণের নামে নবম-দশম শ্রেণির ১২টি পাঠ্যবই আবার বদলে যাচ্ছে। এ ব্যাপারে শিক্ষামন্ত্রী জানান, শিক্ষার মান বাড়াতে ও যুগোপযোগী পাঠ্যবই প্রণয়ণে বাংলা, ইংরেজি, বাংলাদেশ ও বিশ্ব পরিচয়, বাংলাদেশের ইতিহাস ও বিশ্বসভ্যতা, গণিত, উচ্চতর গণিত, সাধারণ বিজ্ঞান, পদার্থ, রসায়ন, জীববিজ্ঞান, হিসাববিজ্ঞান ও অর্থনীতি সহজীকরণ হচ্ছে।
কিন্তু সহজীকরণ হলে পাঠ্যবইয়ের রূপ কেমন হবে, এ বিষয়ে শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ দেওয়ার কোনো পরিকল্পনা এখনো পর্যন্ত মন্ত্রণালয়ের নেই। তবে এই সহজীকরণের পরামর্শক অধ্যাপক মুহম্মদ জাফর ইকবাল বলেন, পরিবর্তনের বিষয়টি চলমান। সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে সব সময় পরিবর্তন প্রয়োজন আছে। পাঠ্যবই পরিবর্তনে এখন যোগ্য ব্যক্তিদের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে।
শিক্ষাবিদদের আশঙ্কা, শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ ছাড়া বই বদলালে শিক্ষার মান বাড়ার বদলে কমবে। ২০১০ সালে প্রণীত শিক্ষানীতির আলোকে ২০১২ সালে প্রাথমিক থেকে উচ্চমাধ্যমিক স্তরের পাঠ্যবই সাজানো হয়। ১৯৯৬ সালেও পাঠ্যবই বদলায়। গত তিন বছর ও চলতি বছরেও এসব বই পরিবর্তন হয়। এর মধ্যে চলতি বছর পাঠ্যবই পরিবর্তন নিয়ে ব্যাপক আপত্তি ওঠে।
এমন অভিযোগ রয়েছে, এ বছর সরকার সাম্প্রদায়িক সংগঠন হেফাজতে ইসলামের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে বিভিন্ন পরিবর্তন আনতে গিয়ে ইসলামীকরণ করে ফেলেছেন। এর আগে ২০০২, ২০০৭, ২০০৯ ও ২০১০ সালেও এসব পাঠ্যবইয়ে পরিবর্ধন ও পরিমার্জন আনা হয়।
পিছিয়ে নেই পরীক্ষার খাতা মূল্যায়নের পরিবর্তনও। জানা গেছে, আগামী বছর থেকে পাবলিক পরীক্ষার খাতা মূল্যায়নে আরেক দফা পরির্তন আসছে। গত বছরের ২৭ নভেম্বর শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে পাবলিক পরীক্ষায় শিক্ষার্থী মূল্যায়নে ‘স্ট্যান্ডার্ডাইজেশন’ (প্রমিতকরণ) নামে নতুন পদ্ধতির কথা জানান শিক্ষামন্ত্রী।
এ পদ্ধতি অনুযায়ী, খাতায় প্রাপ্ত নম্বর সরাসরি শিক্ষার্থীকে দেওয়া হবে না। এ ক্ষেত্রে কোনো বিষয়ে শিক্ষার্থীর প্রাপ্ত নম্বর থেকে ওই বিষয়ে শিক্ষার্থীদের প্রাপ্ত নম্বরের গড় সংখ্যা দিয়ে বিয়োগ হবে। এরপর প্রাপ্ত ফল ওই বিষয়ে সব শিক্ষার্থীর নম্বরপ্রাপ্তির তারতম্য (স্ট্যান্ডার্ড ডেভিয়েশন) দিয়ে ভাগ হবে। এরপর যা আসবে তা শিক্ষার্থীকে দেওয়া হবে।
এ পদ্ধতিতে প্রতি বছর কত শতাংশ শিক্ষার্থী জিপিএ-৫ পাবে তা সরকারিভাবে নির্ধারণ করা হবে। এটা প্রয়োগ করলে শিক্ষার্থীর র্যাঙ্ক অর্ডারে (যে ফল করার কথা) কোনো পরিবর্তন আসবে না।
শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের তথ্য মতে, গত দেড় দশকে শিক্ষার্থী মূল্যায়ন পদ্ধতিও অন্তত তিনবার বদলেছে। যেমন-গ্রেডিং পদ্ধতি, এসবিএ (স্কুলভিত্তিক) ও ধারাবাহিক মূল্যায়ন। ২০০৭ সালে স্কুলভিত্তিক খাতা মূল্যায়ন (স্কুল বেইজড এসেসমেন্ট বা এসবিএ) চালু করা হলেও শেষ পর্যন্ত এক শ্রেণির শিক্ষকদের দুর্নীতির কারণে তা বন্ধ করতে বাধ্য হয় সরকার। এ পদ্ধতি অনুযায়ী শিক্ষক বিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীকে মূল্যায়ন করে নম্বর দেন। এখন ‘ধারাবাহিক মূল্যায়ন’-এর নামে এ পদ্ধতি আবার ফিরিয়ে আনা হয়েছে।
এমনকি অনেক প্রকল্প নিলেও পূর্ব প্রস্তুতির অভাবে তা শেষ পর্যন্ত বাস্তবায়ন করতে পারেনি শিক্ষা মন্ত্রণালয়। জানা যায়, ছয় বছর আগে শিক্ষা মন্ত্রণালয় পাঠ্যবই ছেপে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি (আইসিটি) বিষয়কে বাধ্যতামূলক করে।
কিন্তু এখনো সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোয় এ বিষয়ে শিক্ষক নিয়োগ দিতে পারেনি। সে ক্ষেত্রে বিষয় থাকলেও পাঠ পাচ্ছেন না শিক্ষার্থীরা। এমনকি প্রকল্পটিতে ব্যাপক দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছে। ৩০৫ কোটি টাকার সরকারি এ প্রকল্পের প্রায় শতকোটি টাকা জলে যাচ্ছে বলে প্রকল্প কর্মকর্তা, শিক্ষক ও অভিভাবকদের অভিযোগ।
গত ২১ জুন গণশিক্ষামন্ত্রী মোস্তাফিজুর রহমান জানান, সে বছর থেকে পঞ্চম শ্রেণিতে আর সমাপনী পরীক্ষা হবে না। কিন্তু সে ঘোষণার বাস্তবায়ন নেই। গতবারও এ পরীক্ষা হয়। এবারও তা নেওয়া হবে। অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত প্রাথমিক শিক্ষার স্তর ঘোষিত হওয়ায় পঞ্চম শ্রেণি শেষে সমাপনী পরীক্ষা বন্ধের দাবি জানিয়ে আসছেন শিক্ষাবিদরা। এ পরীক্ষা কবে বন্ধ হবে, তা এখনো বলতে পারছে না গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়।
গণশিক্ষামন্ত্রী এ প্রসঙ্গে সম্প্রতি বলেন, শিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে চিঠি পেলেও প্রাথমিক শিক্ষা অষ্টম শ্রেণিতে উন্নীত করা যাচ্ছে না। মন্ত্রিসভার অনুমোদন না পাওয়া পর্যন্ত ষষ্ঠ থেকে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত শিক্ষা মন্ত্রণালয়েরই দায়িত্বে থাকছে।
শিক্ষা মন্ত্রণালয় সূত্র মতে, শিক্ষা পদ্ধতিতে সবচেয়ে আলোচিত পরিবর্তন হয় ‘সৃজনশীল’ ব্যবস্থায়। ২০০৫ সালে এ পদ্ধতি চালু হলেও গত ১২ বছরে ২০০৫ মাত্র ৫৬ শতাংশ শিক্ষক এটি আয়ত্ত করতে পেরেছেন। এ পদ্ধতিতে পড়ানোর মতো দক্ষ শিক্ষকের সংকট প্রকট।
সৃজনশীল প্রশ্ন পদ্ধতির ভীতি কাটছে না শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের মধ্যে। শিক্ষার্থীরা ঝরে পড়ছে। শিক্ষক সংকট, কঠিন সিলেবাস, জটিল সৃজনশীলতা ও শ্রেণিকক্ষে শিক্ষার্থীদের মনোযোগী করতে না পারা ঝরে পড়ার কারণ বলে মনে করেন অভিভাবক ও শিক্ষাবিদরা।
এই রকম সংবাদ আরো পেতে হলে এই লেখার উপরে ক্লিক করে আমাদের ফেসবুক ফ্যান পেইজে লাইক দিয়ে সংযুক্ত থাকুন। সংবাদটি সম্পর্কে মন্তব্য করতে হলে এই পেইজের নীচে মন্তব্য করার জন্য ঘর পাবেন