বিয়ের আসরে বসা হল না মৌলভীবাজারের হাসনার

দুই শতাধিক দমকলকর্মীর টানা ১৫ ঘণ্টা চেষ্টায় পশ্চিম লন্ডনের গ্রেনফেল টাওয়ারের আগুন নিয়ন্ত্রণে এসেছে। ভবনটির কাঠামো ছাড়া আর কিছুই অবশিষ্ট নেই। তবে যে দুঃসহ বেদনা ভবনটিকে ঘিরে তৈরি হয়েছে, তা স্মরণকালের ভয়াবহ বলছেন অনেকেই।

এদিকে অগ্নিকাণ্ডের পর মৌলভীবাজারের কমরু মিয়ার পাঁচজনের পরিবারের কাউকেই খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। আগামী মাসেই কমরুর মেয়ে হাসনা বেগমের বিয়ের কথা পাকা ছিল। কার্ড বিতরণ করা হয়েছে।

মঙ্গলবার মধ্য রাতে লাগা আগুনে এ পর্যন্ত ১৭ জনের মৃতদেহ উদ্ধার করা হলেও তাদের চেনার উপায় নেই। সবার দেহ-ই পুড়ে গেছে। দেখে বোঝার উপায় নেই, কোনটি কার মৃতদেহ। যে বাসার ভেতরে যে লাশ পাওয়া গেছে, সেসব মৃতদেহ ওই বাসার অধিবাসীর বলে ধরে নেয়া হচ্ছে। তবে বাসার বাইরে পাওয়া মৃতদেহগুলো শনাক্ত করা দুরূহ হয়ে পড়েছে।

এদিকে আগুনের ভয়াবহতায় ব্রিটেনবাসী হতভম্ব। অত্যাধুনিক সরঞ্জাম দিয়ে নতুন কাজ করানো ভবনটি পঞ্চাশ মিনিটের মাথায় ২৪ তলা পর্যন্ত আগুন কীভাবে ছড়িয়ে পড়ল, তা নিয়ে চলছে বিশ্লেষণ। ভবনের চতুর্থ তলার একটি বাসার ফ্রিজ বিস্ফোরণ থেকে আগুনের সূত্রপাত বলে ধারণা করা হচ্ছে।

তবে আগুন ছড়িয়ে পড়ার কারণ হিসেবে অনেকে বলছেন, ভবনটির বাইরের দিকে লাগানো আবরণই আগুন ছড়িয়ে পড়ার অন্যতম কারণ।

মঙ্গলবারের আগুনে এক বাঙালি পরিবার নিখোঁজ রয়েছে। আগুন লাগার পর পরই তাদের সঙ্গে আত্মীয়স্বজনের কথা হয়। তখন ভবনের ভেতর থেকে প্রাণে বাঁচার আকুতি জানানোর সঙ্গে তাদের জন্য দোয়া করতে বলা হয়। যাতে মৃত্যু হলেও কষ্ট যেন কম হয়।

টাওয়ারে একটি ফ্ল্যাটে পাঁচ বাংলাদেশি পরিবারের বসবাস ছিল। তিনটি পরিবার আগুনের ভয়াবহতা থেকে প্রাণে বেঁচে গেলেও ১টি পরিবারের খোঁজ পাওয়া যায়নি অগ্নিকাণ্ডের দুই দিন পরও। পরিবারটির দেশের বাড়ি মৌলভীবাজারের একাটুনা গ্রামে। কমরু মিয়া (৮২) স্ত্রী এবং দুই ছেলে ও এক মেয়েকে নিয়ে থাকতেন।

কমরুর ভাতিজা আবদুর রহিম সংবাদমাধ্যমকে জানান, আগুন লাগার পর রাতে চাচাতো ভাইয়ের সঙ্গে তার টেলিফোনে শেষ কথা হয়। তখন তিনি বাঁচার আকুতি জানাচ্ছিলেন। রাত আড়াইটার দিকে হাসনার সঙ্গে কথা হয়।

তার আকুতি ছিল, ‘আমরা সবাই এখন বাথরুমে। আমাদের বের হওয়ার কোনো উপায় নেই। দোয়া করেন আমাদের যেন কষ্টে মৃত্যু না হয়।’

কমরু মিয়া বছরখানেক আগে সপরিবারে এ টাওয়ারে ওঠেন। তার দুই ছেলে আবদুল হমিদ ও আবদুল হানিফ এবং মেয়ে হাসনা বেগম তানিমা ও স্ত্রীসহ এ ভবনে থাকতেন।

মেয়ে হাসনা বেগম তনিমার বিয়ে হওয়ার কথা ছিল ২৯ জুলাই। সব আয়োজন পাকা ছিল। হল বুকিং ও বিয়ের কার্ড বিতরণের কাজও শেষ। শপিং করা হচ্ছিল ধুমধামে। হবু স্বামীর বসবাস ম্যানচেস্টারে। হাসনা বেগম তনিমা উত্তর-পূর্ব লন্ডনের টটেনহ্যাম হিল বিজনেস পার্কে কম্পিউটার সামগ্রীর দোকান পিসি ওয়ার্ল্ডে কাজ করতেন। এ ভবনের নিচে আরেক বাংলাদেশি পরিবার থাকত। তার রেস্টুরেন্ট ব্যবসা রয়েছে।

তিনি জানান, ভবনে চারটি বাঙালি পরিবার থাকত। তাদের মধ্যে কমরু মিয়ার পারিবার এখনও নিখোঁজ। এ টাওয়ারে মধ্যপ্রাচ্য ও আফ্রিকার কয়েকটি দেশের লোকের বাস ছিল বেশি।

অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় রানী দ্বিতীয় এলিজাবেথ গভীর শোক প্রকাশ করেছেন। তিনি আহত-নিহতদের পরিবারদের প্রতি গভীর শোক প্রকাশ করেছেন।

ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী থেরেসা মে, প্রধান বিরোধী দল লেবার পার্টির নেতা জেরেমি করবিন ঘটনাস্থল পরিদর্শনে গিয়েছেন বৃহস্পতিবার।

৬৫ জনকে জীবিত উদ্ধারের পর তাদের লন্ডনের ছয়টি হাসপাতালে চিকিৎসা দেয়া হচ্ছে। তাদের মধ্যে কুইন এলিজাবেথ হাসপাতালে ১১ জন এবং তাদের অবস্থা আশঙ্কাজনক।

সব মিলিয়ে ৩৭ জনের চিকিৎসা চলছে। তাদের মধ্যে ১৭ জনের অবস্থা আশঙ্কাজনক। এখনও নিখোঁজ ৪৬ জন। স্বজনরা তাদের খোঁজে হাসপাতাল থেকে হাসপাতালে ছুটছেন। তবে ভবনের ভেতরে আরও লাশ থাকতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। তাদের শনাক্ত করতে বিশেষ প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত কুকুর ও ডোম ব্যবহার করা হচ্ছে।

এদিকে আগুনে সবহারা মানুষগুলোর পাশে এসে দাঁড়িয়েছেন প্রতিবেশীরা। প্রথম থেকেই তারা যার যা কিছু আছে তা নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েন দুর্গতদের পাশে। উপাসনালয়, কমিউনিটি সেন্টার খুলে দেয়া হয়েছে আশ্রয় কেন্দ্র হিসেবে। দূর-দূরান্ত থেকে তৈরি খাবার নিয়ে এসেছেন অনেকে।

পূর্ণ তদন্তের নির্দেশ প্রধানমন্ত্রীর : ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী থেরেসা মে বৃহস্পতিবার লন্ডন টাওয়ারের অগ্নিকাণ্ডের কারণ উদ্ঘাটনে পূর্ণ তদন্তের নির্দেশ দিয়েছেন।

প্রধানমন্ত্রী বলেন, আগুন এত দ্রুত কেন ছড়িয়ে পড়ল, তা জানা দরকার। আশা করছি, তদন্তে বিষয়টি বের হয়ে আসবে। ১৯৯০ সালের পর এত ভয়াবহ আগুন ব্রিটেনে আর কখনও ঘটতে দেখা যায়নি। সে বছর লন্ডনের ব্যস্ততম পাতাল রেলওয়েতে এক ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে।

মৌলভীবাজার প্রতিনিধি জানান, লন্ডনের গ্রেনফেল টাওয়ারে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় মৌলভীবাজার সদর উপজেলার একই পরিবারের ৫ সদস্য মঙ্গলবার থেকে নিখোঁজ রয়েছেন। হৃদয়বিদারক এ খবর শোনার পর শোকে স্তব্ধ এলাকা। কখন তাদের খবর আসবে এ অপেক্ষার প্রহর গুনছেন স্বজনরা। নিখোঁজ কমরু মিয়া সদর উপজেলার আখাইলকুড়া ইউনিয়নের ৫নং ওয়ার্ডের ফৈসাউরা গ্রামের বাসিন্দা।

সরেজমিন বৃহস্পতিবার নিখোঁজ প্রবাসী কমরু মিয়ার বাড়িতে গেলে স্বজনরা জানান, ৯০ বছর বয়সী কমরু মিয়া বছরখানেক ধরে সপরিবারে লন্ডনের গ্রেনফেল টাওয়ারের একটি ফ্ল্যাটে থাকেন।

মঙ্গলবার রাতে ওই ভবনে আগুন লাগার প্রায় ৩ দিন পেরিয়ে গেলেও খোঁজ মিলছে না কমরু মিয়ার স্ত্রী-সন্তানসহ পরিবারের ৫ সদস্যের।

নিখোঁজ কমরু মিয়ার দুই স্ত্রীর মধ্যে প্রথম স্ত্রী জুলেখা বিবি (৭৫) তার তিন সন্তান সুজন মিয়া (৫০), মিনা বেগম (৫২) ও রুসনা বেগমকে (৬০) নিয়ে দেশে থাকেন। দ্বিতীয় স্ত্রী মিনা বেগম ও ৪ সন্তান আবদুল হাকিম (৩৫), আবদুল হামিদ (৩২), আবদুল হানিফ (২৫) ও হাসনা বেগম (২০) নিয়ে কমরু মিয়া লন্ডনে থাকতেন।

মঙ্গলবার রাতে গ্রেনফেল টাওয়ারে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের পর থেকে স্বজনদের খোঁজ পাচ্ছেন না দেশে বসবাসরত কমরু মিয়ার পরিবার।

তারা জানান, অন্য একটি ভবনে থাকার কারণে সন্তানদের মধ্যে বেঁচে আছেন শুধু আবদুল হাকিম (৩৫)। তিনি দেশে অবস্থানরত পরিবারের অন্যদের সঙ্গে ফোনে যোগাযোগ রাখছেন। বাকি তিন সন্তান দুই ছেলে ও এক মেয়ে এখনও নিখোঁজ। ওরা আদৌ বেঁচে আছে নাকি মারা গেছে, তা এখনও নিশ্চিত হতে পারছেন না পরিবারের সদস্যরা। তাই খুবই দুশ্চিন্তার মধ্য দিয়ে সময় পার করছেন তারা।

লন্ডনে অবস্থানরত কমরু মিয়ার ছেলে আবদুল হাকিম জানান, রাত আড়াইটার দিকে হাসনা বেগমের সঙ্গে কথা হয়। তার আকুতি এখনও আমার কানে ভাসে। সে বলছিল, ‘আমরা সবাই এখন বাথরুমে, আমাদের বের হওয়ার কোনো উপায় নেই, দোয়া করেন আমাদের যেন কষ্টে মৃত্যু না হয়।’ হাকিম বলেন, এরপর তাদের কারও মোবাইলে আর যোগাযোগ করা যাচ্ছে না।