আল জাজিরাকে কেন ঘৃণা করে সৌদি আরব?

কয়েক বছর ধরে আল জাজিরা টিভি নেটওয়ার্কের ‘শরিয়া ও জীবন’ নামের অনুষ্ঠানটিই সবচেয়ে জনপ্রিয়। তাতে মুসলিম ব্রাদারহুডের আধ্যাত্মিক নেতা ইউসুফ আল-কারাদাবিকে নানা প্রশ্ন করে উত্তর পেতেন দর্শকেরা। অনুষ্ঠানে ইউসুফকে বিচিত্র সব প্রশ্ন করা হতো। যেমন: আত্মঘাতী বোমা হামলা করার সময় কি একজন ফিলিস্তিনি নারী হিজাব পরতে বাধ্য?

আল জাজিরার আগে এমন টিভি শো আরব বিশ্বের কোনো টিভি চ্যানেলেই হতো না। সেখানে গণমাধ্যমকে কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করা হয়। কিন্তু কাতারভিত্তিক এই চ্যানেলটি এমন কিছু বিষয়ে অনুষ্ঠান প্রচার শুরু করে, যা আরব বিশ্বে অলিখিতভাবে নিষিদ্ধ। এমনকি এর মতামতও অন্যান্য আরব মিডিয়া থেকে ভিন্ন।

ঠিক এসব গুণের কারণেই মধ্যপ্রাচ্যে আল জাজিরা তুমুল জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। তাই বন্ধুর সঙ্গে সঙ্গে অনেক শত্রুও জুটে যায়। সৌদি আরব ও মিসরের মতো দেশগুলোর শাসকেরা এই টিভি চ্যানেলটির কার্যক্রমকে নিজেদের জন্য ক্ষতিকর মনে করা শুরু করে। শাসকগোষ্ঠীগুলো ভাবছিল, আল জাজিরা তাদের বিরোধী পক্ষকে সমর্থন দিচ্ছে। টিভি চ্যানেলটির ইসলামি দৃষ্টিভঙ্গিও তাদের পছন্দ হয়নি। আল জাজিরার কারণে দেশ দুটির জনগণের মধ্যে সমালোচনার দৃষ্টিভঙ্গি গড়ে ওঠায় শাসকেরা ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠেন।

বছরের পর বছর ধরে তাই আল জাজিরার দৃষ্টিভঙ্গিতে পরিবর্তন আনার জন্য সৌদি আরব ও মিসরের শাসকগোষ্ঠীর পক্ষ থেকে আহ্বান জানানো হচ্ছিল। আরেকটি বিকল্প পথ ছিল তল্পিতল্পা গুটিয়ে চলে যাওয়ার। সৌদি আরব, মিসর ও জর্ডান তো চ্যানেলটির ব্যুরো অফিস বন্ধই করে দেয়। সৌদি আরব চ্যানেলটির কাছে হোটেল ভাড়া দেওয়াও নিষিদ্ধ করে। এখন টিভি চ্যানেলটি বন্ধ করার জন্য কাতারের ওপর চাপ সৃষ্টি করেছে অন্য আরব দেশগুলো। কাতারের সঙ্গে চলমান কূটনৈতিক যুদ্ধ থামানোর জন্য অন্যতম পূর্বশর্ত এটি।

সৌদি আরবসহ সাতটি দেশ সম্প্রতি কাতারের সঙ্গে সব ধরনের সম্পর্ক ছিন্ন করেছে। তাদের অভিযোগ, দেশটি সন্ত্রাসবাদে আর্থিক সহায়তা ও মদদ দিয়ে আঞ্চলিক অস্থিতিশীলতা তৈরি করছে। তবে দোহা কর্তৃপক্ষ বরাবরই এ ধরনের অভিযোগ অস্বীকার করে আসছে। তবু দেশটি দুই সপ্তাহের বেশি সময় ধরে নজিরবিহীন কূটনৈতিক ও অর্থনৈতিক অবরোধের মুখে পড়ে আছে। ফলে উপসাগরীয় অঞ্চলে সাম্প্রতিক দশকগুলোর মধ্যে সবচেয়ে জটিল রাজনৈতিক সংকট দেখা দিয়েছে।

প্রতিবেশী দেশগুলোর নিষেধাজ্ঞা থেকে রেহাই পেতে চাইলে কাতারকে টেলিভিশন চ্যানেল আল জাজিরা বন্ধ ও ইরানের সঙ্গে সম্পর্কে সীমারেখা টানাসহ ১৩টি শর্ত মানতে হবে। কাতারের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্নকারী সৌদি আরব, মিসর, সংযুক্ত আরব আমিরাত ও বাহরাইন গতকাল শুক্রবার এ শর্তগুলোর তালিকা দেশটিকে দিয়ে বলেছে, ১০ দিনের মধ্যে সেগুলো পূরণ করতে হবে। অন্য শর্তগুলোর মধ্যে রয়েছে তুর্কি সামরিক ঘাঁটি বন্ধ করা ও অন্য আরব দেশে নিষিদ্ধ সংগঠন মুসলিম ব্রাদারহুডের সঙ্গে সব ধরনের সম্পর্ক ছেদ করা।

মধ্যপ্রাচ্যে আরবি ভাষায় কথা বলা মানুষের সংখ্যা ৩৫ কোটি। ১৯৫০ ও ৬০-এর দশকে স্থানীয় রেডিও স্টেশনগুলো তাদের কাছে পৌঁছানো শুরু করে। ১৯৯০-এর দশকে সৌদি রাজপরিবার আরবি ভাষার বিভিন্ন সংবাদপত্র কিনতে শুরু করে এবং পুরো অঞ্চলে সেগুলো ছড়িয়ে দিতে থাকে। এ ছাড়া আরও বেশি দর্শক টানতে এমবিসি নামের একটি স্যাটেলাইট চ্যানেল তৈরির কাজ শুরু করেছিল সৌদি আরব। এই উদ্যোগ খুব বেশি জনপ্রিয় না হলেও আরব অঞ্চলের গণমাধ্যম জগতে বেশ আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল। ধারণা করা হচ্ছিল, সৌদি আরবই বোধ হয় গণমাধ্যমের লাগামটি হাতে তুলে নিচ্ছে।

এ ঘটনা মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর শাসকগোষ্ঠীর মধ্যে ভিন্ন একটি প্রতিক্রিয়া তৈরি করেছিল। আরব গণমাধ্যমের ওপর বই লেখা শিবলি তেলহামি বলেন, ‘এটিই কাতারের আমির শেখ হামাদ বিন খলিফা আল থানিকে আল জাজিরা প্রতিষ্ঠায় অনুপ্রাণিত করেছিল। ১৯৯৬ সালে যাত্রার শুরু থেকেই এই নেটওয়ার্কটির পেছনে কোটি কোটি ডলার খরচ করা হয়।’

এর কারণ, সৌদি মালিকানাধীন সংবাদপত্রগুলোর কঠোর সমালোচনার মুখে পড়েছিলেন থানি। আল জাজিরা দিয়ে এর প্রত্যুত্তর দেওয়ার চেষ্টা করেছিলেন তিনি।

তেলহামির কথায়, আল জাজিরা শুরু থেকেই আরব বিশ্বের দর্শকদের আকৃষ্ট করার চেষ্টা করছিল। আরব ও মুসলিমরা যেসব বিষয়ের ওপর অনুষ্ঠান দেখতে চান, ঠিক তেমন অনুষ্ঠান বানানো শুরু হয়। ইসরাইলের সেনা ও আন্দোলনরত ফিলিস্তিনিদের মধ্যকার সংঘর্ষ সরাসরি সম্প্রচার করা শুরু হয়। এটি এর আগে কখনোই কোনো আরব চ্যানেল প্রচার করার সাহস দেখায়নি। এমনকি ইসরাইলের আইনসভাতেও প্রতিবেদক পাঠিয়েছিল আল জাজিরা। আবার এসবের পাশাপাশি ওসামা বিন লাদেনের ভিডিওবার্তাও প্রচার করত চ্যানেলটি। ফলে সব ধরনের মতামত প্রচারের একটি প্ল্যাটফর্ম হয়ে উঠেছিল কাতারভিত্তিক এই চ্যানেল।

এসব কর্মকাণ্ডের কারণে ২০০১ সালের মধ্যেই আল জাজিরা সবচেয়ে জনপ্রিয় আরব টিভি চ্যানেলে পরিণত হয়। এতে সংবাদই খুঁজতেন বেশির ভাগ দর্শক। ওই সময় প্রায় ৭৫ শতাংশ আরব নাগরিকের প্রিয় চ্যানেলের তালিকার প্রথমের দিকে ছিল চ্যানেলটি।

আল জাজিরার সমালোচনাও আছে। ২০০১ সালের ১১ সেপ্টেম্বরে যুক্তরাষ্ট্রের টুইন টাওয়ারে হামলার পর সন্ত্রাসীদের সমর্থনের অভিযোগ উঠেছিল আল জাজিরার বিরুদ্ধে। ২০১২ সালে চীনও আল জাজিরা ইংলিশের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিয়েছিল। চ্যানেলটির আরবিভাষী সংস্করণটির বিরুদ্ধে মুসলিম ব্রাদারহুডকে সমর্থনের অভিযোগও উঠেছে।

‘দ্য আল জাজিরা ইফেক্ট’ নামের বইয়ের লেখক হিউ মাইলস দ্য টেলিগ্রাফ পত্রিকাকে বলেছিলেন, ‘আল জাজিরা অ্যারাবিক চ্যানেলটি ইসলামপন্থী। ওখানে এটি একটি জনপ্রিয় দৃষ্টিভঙ্গি। কিন্তু অন্য আরব দেশগুলো এটি গ্রহণ করে না। তারা মনে করে এটি তাদের জন্য হুমকিস্বরূপ।’

ওয়াশিংটন ইনস্টিটিউটের গালফ অ্যান্ড এনার্জি পলিসি প্রোগ্রামের পরিচালক সাইমন হেন্ডারসনের মতে, দোহার নীতিগুলোরই প্রতিফলন ঘটায় আল জাজিরা। তিনি বলেন, ‘আল জাজিরা না থাকুক এটা অনেক আরব দেশই চায়।’

প্রতিবেশী আরব দেশগুলোর দেওয়া সাম্প্রতিক শর্তের পরিপ্রেক্ষিতে এরই মধ্যে বিবৃতি দিয়েছে আল জাজিরা। এই পদক্ষেপকে ‘অঞ্চলটির মতপ্রকাশের স্বাধীনতায় বাধা দেওয়ার শামিল’ বলে অভিহিত করা হয়েছে। মিসর ও সিরিয়ার মতো দেশে থাকা চ্যানেলটির কয়েকজন প্রতিবেদক আশঙ্কা করছেন, তাঁদের হয়তো জোর করে কাতার পাঠিয়ে দেওয়া হতে পারে। তবে নেটওয়ার্কটির সাংবাদিকেরা জানিয়েছেন, এই অবস্থাতেও ইতিবাচক থাকতে চান তাঁরা।

আল জাজিরা ইংলিশের সম্পাদক জাইলস ট্রেন্ডল দ্য টেলিগ্রাফ পত্রিকাকে বলেন, ‘আল জাজিরার পক্ষ থেকে আমি এতটুকু বলতে চাই যে, আমরা এখানে থাকার ব্যাপারে আত্মবিশ্বাসী এবং আমরা নিজেদের সাংবাদিকতা চালিয়ে যেতে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ।’

ভাষান্তর: অর্ণব সান্যাল