‘অপহরণকারীরাই আমাকে বাসের টিকিট ধরিয়ে দেয়’
অপহরণের প্রায় ১৮ ঘণ্টা পর যশোর থেকে উদ্ধার করা হয় কবি, লেখক ও কলামিস্ট ফরহাদ মজহারকে। এরপর আজ (মঙ্গলবার) সকালে প্রথমে তাকে ঢাকার আদাবর থানায় ও পরে মিন্টো রোডের গোয়েন্দা কার্যালয়ে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখান থেকে নেওয়া হয় ঢাকার মহানগর হাকিম আদালতের বিচারক আহসান হাবিবের খাস কামরায়। মঙ্গলবার বিকালে সেখানে ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি দেন ফরহাদ মজহার। ঘটনার আদ্যোপান্ত জানিয়ে জবানবন্দিতে তিনি বলেন, ‘অপহরণকারীরাই আমাকে বাসের টিকিট ধরিয়ে দেয়।’
পুলিশ ও আদালত সূত্র জানায়, ফরহাদ মজহার আদালতকে দেওয়া জবানবন্দিতে জানান, প্রতিদিনের মতো রাত তিনটা থেকে সাড়ে তিনটার মধ্যে ঘুম থেকে জেগে উঠি। ভোর পাঁচটা পর্যন্ত কম্পিউটারে কাজ করি। এরপর চোখের ড্রপ নিতে ও হাঁটাহাঁটির জন্য বাসা থেকে বের হই। পাশেই সেন্ট্রাল হাসপাতাল আছে। ওখানে যাওয়ার আগেই হাঁটাহাঁটির সময় তিন জন লোক ধাক্কা মেরে আমাকে মাইক্রোবাসে তোলে। কিছুক্ষণ পরই আমাকে সিটের নিচে ফেলে রাখে। আমিও নিচু হয়ে আমার কাছে থাকা একটি মোবাইল ফোন দিয়ে বাসায় ফোন করি। বলি, আমাকে কারা যেন ধরে নিয়ে যাচ্ছে। মনে হচ্ছে মেরে ফেলবে। তাদের গাড়ি উত্তর দিকে মানে গাবতলীর দিকে যাচ্ছিল। এরপরই তারা আমার কাছ থেকে ফোন নিয়ে নেয়। আমার চোখ বেঁধে ফেলে। গাড়ি চলতে থাকে। কোথায় যাচ্ছি, বুঝতে পারছিলাম না। অনেক্ষণ পর বুঝতে পারলাম আমি কোনও নদী পার হচ্ছি। সম্ভবত ফেরির মধ্যে ছিলাম। এরইমধ্যে তাদের কাছে আমার জীবনের বিনিময়ে টাকার অফার করি। তারা বলে, ‘তুই কত দিতে পারবি? দুই কোটি ? ’
ফরহাদ মজহার বলেন, ‘‘আমি বলি, অতো টাকা আমার কাছে নাই। তখন তারা বলে, ‘এক কোটি টাকা দিতে পারবি?’ আমি বলি, অতো টাকাও আমার কাছে নাই। আমি সর্বোচ্চ ৩০ থেকে ৩২ লাখ টাকা দিতে পারবো। তখন তারা আমার ফোন দিয়ে আমার পরিবারের সঙ্গে কথা বলতে দেয়। টাকার বিনিময়ে ছেড়ে দেওয়ার কথা পরিবারকে বলার সঙ্গে সঙ্গে ফোন নিয়ে নেয়। সারাদিন কোনও খাবার খেতে দেয়নি। নানা ঘটনায় আমি অনেকটা বিধ্বস্ত ও বিপর্যস্ত হয়ে যাই।’’
জবানবন্দিতে ফরহাদ মজহার বলেন, ‘ফেরিঘাট পার হওয়ার পর আমাকে একটি টিকিট ধরিয়ে দেয় অপহরণকারীরা। বলে, ‘এই টিকিট দিয়ে গাড়িতে বাসায় ফিরে যাবি। কাউকে কিছু বলতে পারবি না। আমরা তোকে ফলো করছি।’ কিছুক্ষণ হাঁটার পর একজন রিকশাচালকের কাছে জায়গার নাম জিজ্ঞাসা করি। সেখান থেকে খাওয়ার জন্য একটি হোটেলে যাই। খাওয়ার সময় মনে হলো হোটেলের একজন আমাকে চিনতে পেরেছে। আমার দিকে বারবার তাকাচ্ছিল।’’
তিনি বলেন,‘‘খাওয়া শেষ করে দ্রুত আমি রাত পৌনে ৯টার দিকে হানিফ বাসের কাউন্টারে যাই। সেখানে গিয়ে ফোনে চার্জ দেই। এরপর ঢাকাগামী হানিফ পরিবহনের বাসে উঠে পেছনের দিকে বসি। আমি তখন ভীষণ ক্লান্ত। রাত ৯টার দিকে বাস ছেড়ে যাওয়ার পরপরই ঘুমিয়ে পড়ি। কিছুক্ষণ পর দুজন লোক আমার কাছে গিয়ে জানতে চান, ‘আমি ফরহাদ মজহার কিনা।’ তাদেরকে আমার পুলিশের লোক মনে হয়েছে। আমি আমার পরিচয় দিলে তারা আমাকে বাস থেকে নামিয়ে আনেন। ওই সময় র্যাবের লোকজনও আসে। এরপর আমাকে তাদের গাড়িতে করে ঢাকায় নিয়ে আসা হয়।’’
পুলিশের একটি দায়িত্বশীল একটি সূত্র জানায়, ফরহাদ মজহার যা বলেছেন, তা-ই রেকর্ড করা হয়েছে। ঘটনার বর্ণনায় বেশ কিছু প্রশ্ন তৈরি হলেও সে বিষয়ে তাকে কোনও পাল্টা কোনও প্রশ্ন করা হয়নি। তার হেফাজত থেকে হানিফ পরিবহনের একটি টিকিট (সিট নম্বর-আই থ্রি), একটি ব্যাগ, ব্যাগের মধ্যে একটি চার্জার, একটি সাদা-কালো স্ট্রাইপ পাঞ্জাবি, একটি সাদা স্যান্ডো গেঞ্জি ও সাড়ে ১২ হাজার টাকা উদ্ধার করা হয়েছে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের ফরহাদ মজহার বলেছেন, ওই ব্যাগ ও টাকা তার নিজের। তার কাছে সবসময় একটি ব্যাগ ও টাকা থাকে। তিনি যে টিকিটে ঢাকায় ফিরছিলেন সেটিতে ‘গফুর’ নামে এক জনের নাম লেখা আছে।
মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের এক জন কর্মকর্তা জানান, ফরহাদ মজহার কিছুটা বিধ্বস্ত ছিলেন। তিনি নিজেও বলেছেন, তার ওপর অনেক চাপ গেছে। রাতে ঘুমাতে পারেননি। ফলে অনেক কিছুই তিনি মনে করতে পারছেন না। একটু স্বাভাবিক হলে তিনি আরও তথ্য দিতে পারবেন। দুর্বৃত্তদের চিনতে পেরেছেন কিনা, বা তারা কী ভাষায় কথা বলছিল এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি গোয়েন্দাদের বলেছেন, তারা তাকে (ফরহাদ মজহার) গালাগালি করতে শুনেছেন। তবে তাদের চিনতে পারেননি।
ডিবির অতিরিক্ত উপ-পুলিশ কমিশনার (পশ্চিম) গোলাম মোস্তফা রাসেল বলেন, ‘এ ঘটনায় একটি অপহরণ মামলা হয়েছে। আমরা বিষয়টি খতিয়ে দেখছি। কারা তাকে অপহরণ করেছিল তা জানার চেষ্টা চলছে।’
উল্লেখ্য, সোমবার (৩ জুলাই) ভোররাতে মোহাম্মদপুর লিংক রোডের হক গার্ডেনের নিজ বাসা থেকে বের হন ফরহাদ মজহার। এরপর ভোর ৫টা ২৯ মিনিটে তিনি তার স্ত্রীকে ফোন করে জানান, ‘ফরিদা, ওরা আমাকে নিয়ে যাচ্ছে। ওরা আমাকে মেরে ফেলবে।’ পরে তার স্ত্রী আদাবর থানায় অভিযোগ করেন। অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে সোমবার রাতে র্যাব-৬ যশোর নওয়াপাড়া থেকে তাকে উদ্ধার করে। পরে তাকে আদাবর থানা পুলিশের কাছে হস্তান্তর করা হয়। পুলিশের সহকারী কমিশনার (এসি) হাফিজ আল ফারুকের নেতৃত্বে তাকে যশোর থেকে ঢাকায় আনা হয়। এরপর তাকে মিন্টো রোডের গোয়েন্দা কার্যালয়ে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে তাকে জিজ্ঞাসাবাদ শেষে জবানবন্দি দেওয়ার জন্য আদালতে পাঠানো হয়।
এই রকম সংবাদ আরো পেতে হলে এই লেখার উপরে ক্লিক করে আমাদের ফেসবুক ফ্যান পেইজে লাইক দিয়ে সংযুক্ত থাকুন। সংবাদটি সম্পর্কে মন্তব্য করতে হলে এই পেইজের নীচে মন্তব্য করার জন্য ঘর পাবেন