টুপিতেই যত রহস্য কলকাতার এই চা বিক্রেতার!

সেই কোন ছোটবেলা থেকেই এ চত্বরে আনাগোনা। কখনও কাঁচা বাজার, কখনও বা ফুল। এখন তো আবার তার সঙ্গে যোগ হয়েছে জামা-কাপড়ও।

দক্ষিণ কলকাতার জমজমাট এক অঞ্চল, লেক মার্কেট। রাসবিহারী অ্যাভিনিউয়ের উপরেই রয়েছে এই বিখ্যাত মার্কেট প্লেস। ২০১৫ সালে দুর্গাপুজোর সময় ওই মার্কেটই নতুন করে তৈরি করা হয়। নাম দেওয়া হয় ‘লেক মল’।

সেই লেক মলের সামনেই দেখা হল বুদ্ধদেব কর্মকারের সঙ্গে। বয়স বছর তিরিশ হবে। হাসিমুখে চা খাইয়ে চলেছেন পথচারী থেকে আশেপাশের দোকানদারদের। মল থেকে বেরিয়ে আসা অনেকেই দাঁড়িয়ে পড়ছেন বুদ্ধদেবের সামনে। পছন্দের চা-এর ফরমাশ করে নিশ্চিন্তে গল্প জুড়ে দিচ্ছেন সঙ্গীদের সঙ্গে। আর একা থাকলে, তার পাশেই বসে পড়ছেন শান বাঁধানো ফুটের উপরে।

বেশিরভাগ চা-খোরদের সঙ্গেই বুদ্ধদেবের কথার ভঙ্গিমায় বেশ স্পষ্ট ছিল যে, তাঁরা এখানকার ‘রেগুলার কাস্টমার’। দোকানিরা ছাড়াও সেই তালিকায় রয়েছেন গৃহিণী থেকে কলেজের ছাত্রছাত্রীরাও।

বুদ্ধদেব ছাড়া, ইতিউতি রয়েছে আরও চায়ের দোকান। এবং সেখানে মজুত রয়েছে নানা ধরনের মুখরোচক বিস্কুটও। তা সত্ত্বেও কোন এক অমোঘ আকর্ষণে মানুষ ভিড় জমাচ্ছেন বুদ্ধের কাছেই?

কারণ একটাই— বুদ্ধদেব কর্মকারের চা বিক্রি করার পদ্ধতি।
নানা ধরনের চায়ের পাশাপাশি কফিও পাওয়া যায় বুদ্ধদেবের কাছে। এবং তার সম্পূর্ণ তালিকাটি রংবেরঙের কালিতে লেখা রয়েছে সাদা আর্ট পেপারের টুপিতে। এই টুপিই হল বুদ্ধদেব চাওয়ালার ‘ইউএসপি’।

চা, কফি, আইস টি, লেমন টি, কোল্ড কফি, ব্ল্যাক টি বা কফি— সব রয়েছে বুদ্ধদেবের ঝোলায়!

বছর দুই আগে মার্বেলের ব্যবসা মন্দা যাওয়ার ফলে, কিছু করার তাগিদ থেকেই চা বিক্রি শুরু করেন বুদ্ধদেব। টালিগঞ্জ সার্কুলার রোডের পাশে নিউ আলিপুর অঞ্চলের বাসিন্দা বুদ্ধ, তখন দিনের বেলা কাছাকাছির বাজারগুলিতে চা বিক্রি করতেন। আর রাতের দিকে তাঁকে দেখা যেত হাসপাতাল চত্বরে। কারণ, ‘‘রাতে রোগীর বাড়ির লোকজন অনেকেই থেকে যান হাসপাতালে’’, বললেন বুদ্ধ। কিন্তু, বাধ সাধে চিত্তরঞ্জন হাসপাতাল অঞ্চলের চা বিক্রেতারা। তার পরে পুলিশ তো রয়েইছে।

তাতে অবশ্য দমে যাননি বুদ্ধ। ঘরে স্ত্রী ও পাঁচ বছরের ছোট ছেলে। স্ত্রী এক সময়ে একটি ফিটনেস সেন্টারে কাজ করতেন। কিন্তু, অন্তঃসত্ত্বা হওয়ার পরে কাজে অব্যাহতি দেন। ‘‘ছেলে একটু বড় হওয়া না পর্যন্ত কাজে বেরনোর প্রশ্নই ওঠে না’’— সোজা সাপ্টা কথা বুদ্ধের। তিনি যে একজন স্নেহময় পিতা, তা বলাই বাহুল্য। ছেলের মুখের ছবি ট্যাটু করে রেখেছেন ডান বাহুতে। সগর্বে তা দেখালেনও প্রতিবেদককে।

সংসার চালাতে হবে। একদিন সাহস করে তাই লেক মলের সামনে চলে আসেন বুদ্ধ। ব্যস! তার পরে আর অন্য জায়গার কথা ভাবতে হয়নি তাঁকে। গত দেড় বছর ধরে এখানেই সবাইকে নানা স্বাদের চা খাইয়ে চলেছেন বুদ্ধদেব কর্মকার।

কিন্তু, এই টুপির রহস্য কী? জানতে চাওয়ায় বুদ্ধদেব বলেন, ‘‘প্রথম বছর পুজোর সময় প্রচুর ভিড় ছিল এই চত্বরে। ‘গরম চা, গরম চা’ করে করে গলা ফাটিয়েও খুব একটা লাভ হয়নি।’’ বিক্রির অভিনব পথ মাথায় আসে হঠাতই— মানুষ নতুন কিছু দেখতে পছন্দ করে সব সময়ই। সৃষ্টি হল ‘আলা কার্তা’ টুপি।

লাল চা, লেবু চা, আইস টি, কোল্ড কফি, হট কফি, ব্ল্যাক কফি— পছন্দের পানীয়টি শুধুমাত্র বলার অপেক্ষায়। টুপি পরে তা হাজির করবেন বুদ্ধদেব চাওয়ালা।