সাইকেলে তেঁতুলিয়া থেকে টেকনাফ
‘সাইকেলে ভ্রমণের শেষ দিকে, আমরা তখন কক্সবাজার টু টেকনাফের মেরিন ড্রাইভ রোডে। আমাদের হাতের বাম পাশে সবুজ পাহাড়রাজি, ডান পাশে উত্তাল সমুদ্র। প্রচণ্ড বাতাস, সমানতালে বৃষ্টিপাতও হচ্ছিল। মনে হলো, অপূর্ব প্রকৃতি যেন আমাদের বিজয়ের পথে স্বাগত জানাচ্ছে। এমন প্রাকৃতিক রূপ সত্যি মন ভালো করে দিয়েছিল। আমাদের নিয়ে গিয়েছিল সাফল্যের শেষ গন্তব্যে।’
কথাগুলো বলছিলেন সম্প্রতি তেঁতুলিয়া টু টেকনাফ সাইক্লিংয়ে ক্রসকান্ট্রি রাইডে অংশ নেওয়া তরুণ লিংকন দাস রায়।
তেঁতুলিয়া টু টেকনাফ সাইক্লিংয়ে অংশ নিয়েছিল মৌলভীবাজার সাইক্লিং কমিউনিটির তিন সদস্য সৌরভ রায় শুভ(২৬), লিংকন দাশ রায় (২৫) ও টিটু চন্দ্র দেব(২৫)। দেশের একপ্রান্ত পঞ্চগড় জেলার তেঁতুলিয়ার বাংলাবান্ধা জিরো পয়েন্ট থেকে কক্সবাজার জেলার টেকনাফ জিরো পয়েন্ট পর্যন্ত বাইসাইকেল চালিয়ে তারা ভ্রমণ করেছেন।
দেশের এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে বাইসাইকেলে এ ধরনের ভ্রমণকে ‘ক্রসকান্ট্রি রাইড’ বলা হয়। বাংলাবান্ধা থেকে প্রথমে যাত্রা শুরু করেছিলেন চারজন। সাইক্লিস্ট আশিকুর রহমান (২৭) তিনশ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়ে পারিবারিক কারণে বগুড়া থেকে বিদায় নেয়।
ক্রসকান্ট্রি রাইডের ভাবনা কীভাবে এলো জানতে চাইলে টিটু চন্দ্র দেব বলেন, ‘সাইক্লিং টিমের আমরা তিনজনই বন্ধু। এক সঙ্গে মৌলভীবাজার সরকারি কলেজ থেকে পড়ালেখা শেষ করেছি। ছোটবেলা থেকে ঘুরোঘুরি আমাদের পছন্দ। আমরা তিন জনই মৌলভীবাজার সাইক্লিং টিমের সদস্য। ‘সুস্বাস্থ্যের জন্য সাইক্লিং’ স্লোগানে আমাদের জেলা সদরে ও পাশের জেলায় মাঝে মাঝেই ছোটখাটো রাইড পরিচালনা করতাম। দীর্ঘদিন থেকেই আমাদের পরিকল্পনা ছিল ক্রসকান্ট্রি রাইড করা।’
গত ২১ জুন রাতে তারা মৌলভীবাজার থেকে বাসযোগে পঞ্চগড়ের উদ্দেশ্যে যাত্রা করে। পরদিন ২২ জুন সন্ধ্যা ৬:৩০ মিনিটে বাংলাবান্ধা জিরো পয়েন্ট থেকে বাইসাইকেলে তাদের ক্রসকান্ট্রি রাইডের সূচনা। পর্যায়ক্রমে ঠাকুরগাও, দিনাজপুর, জয়পুরহাট, বগুড়া, সিরাজগঞ্জ, টাঙ্গাইল, ঢাকা, কুমিল্লা, ফেনী, চট্রগ্রামসহ কয়েকটি জেলা ভ্রমণ শেষে ৩০ জুন শনিবার ভোরে কক্সবাজারের টেকনাফ জিরো পয়েন্টে তারা পৌঁছান। গুগল ম্যাপে তেঁতুলিয়া বাংলাবান্ধা থেকে টেকনাফের দূরত্ব ৯২১ কিলোমিটার হলেও, তিন সাইক্লিস্টকে পাড়ি দিতে হয়েছে প্রায় ১ হাজার ৬৪ কিলোমিটার পথ। গড়ে প্রতিদিন তাদের পাড়ি দিতে হয়েছে প্রায় ১২০ কিলোমিটার পথ। দূরত্ব মাপতে পুরো পথে তারা ব্যবহার করেছেন মন্ড অ্যাপ।
এ সময় তাদের রুটিন ছিল সকাল ৬টা থেকে রাত ১১টা পর্যন্ত সাইক্লিং। পথে খেয়ে নিতেন দুপুরের খাবার, খাবারের পর আধা ঘণ্টা ঘুমিয়ে নিতেন রাস্তার পাশেই। আট দিনের এই সাইকেল ভ্রমণে তিন সাইক্লিস্টকে পড়তে হয়েছে অনেক সমস্যায়। তাপমাত্রা বেশি হওয়ার কারণে দিনে সাইকেল চালিয়ে ক্লান্ত হয়ে পড়তেন। রাতে সাইক্লিংয়ে ডাকাতের ভয় ছিল। রাতে থাকার জন্য অনেক সমস্যায় পড়তে হয়। চট্টগ্রামে পটিয়ায় থাকার জাগয়া না পেয়ে রাত কাটিয়েছেন থানার ওয়েটিং রুমে। কক্সবাজারে থাকতে হয়েছে নির্মাণাধীন ভবনে।
সৌরভ রায় শুভ জানান, দেশের সাম্প্রতিক কিছু বড় সমস্যা- মাদক, জঙ্গিবাদ, ধর্ষণ, সাম্প্রদায়িকতা, শিশুশ্রম প্রতিরোধে সাধারণ মানুষের মাঝে সচেতনতা সৃষ্টি ও সাইক্লিংয়ের প্রতি মানুষকে উৎসাহিত করার লক্ষে তারা বাইসাইকেল চালিয়ে এক হাজার কিলোমিটার পথ পাড়ি দেন।
তিন তরুণই কর্মজীবী হওয়ায় ঈদের ছুটির সময়কে বেছে নিয়েছিলেন। লিংকন দাশ রায় কমিউনিটি রেডিও পল্লী কণ্ঠের প্রযোজক, সৌরভ রায় একটি বেসরকারি কোম্পানির মার্কেটিং অফিসার এবং টিটু চন্দ্র দেব বেসরকারি একটি প্রতিষ্ঠানের অফিস সহকারী।
সাইক্লিস্ট সৌরভ রায় শুভ জানান, ‘তেঁতুলিয়া থেকে টেকনাফ সাইক্লিং করে যা শিখলাম, আমার মতে সাইক্লিং মানে শুধু সাইকেল চালানো না, আর শুধু সাইকেল চালালে আপনি সাইক্লিস্ট হতে পারবেন না। এই ক্রস কান্ট্রি দিয়ে অনেক লোকের সঙ্গে দেখা হলো, কথা হলো, অনেক জায়গা সম্পর্কে জানা হলো। এক জেলা থেকে আরেক জেলায় সাইক্লিং করে যাবার ফলে যেমন একদিকে সাইক্লিং-এর প্রতি মানুষ অনুপ্রাণিত হচ্ছে আরেকদিকে বিভিন্ন জেলার সাইক্লিস্ট ভাই ও সাইক্লিং সংগঠনের সঙ্গে নিজের বা নিজের সংগঠনের একটা ভালো সম্পর্ক তৈরি হচ্ছে। এই ট্যুর দিয়ে আমার যা মনে হলো, আপনি যদি একটি সাইকেল নিয়ে দেশ ভ্রমণে বের হন, আপনার একটি বারের জন্য নিজেকে একা মনে হবে না। পথে ঘাটে বা বিভিন্ন শহরে সবাই আপনাকে সহযোগিতার জন্য এগিয়ে আসবে। যার বাস্তব প্রমাণ আমি নিজে পেয়েছি। আমি সাইক্লিং করি তাই এখন নিজেকে অনেক ভাগ্যবান মনে হচ্ছে। সাইক্লিং-এর জন্য এত মানুষের ভালোবাসা পেলাম।’
সাইক্লিস্ট লিংকন দাশ রায় তাদের ভবিষ্যত পরিকল্পনার কথা জানান। তিনি জানান, চলতি জুলাই মাসের শেষ দিকে মুজিব নগর টু আখাউড়া এবং পরের মাসে তামাবিল টু ভোমরা ক্রসকান্ট্রি রাইড করার ইচ্ছা আছে তাদের। ভবিষ্যতে সার্কভুক্ত দেশগুলোতে সাইক্লিং করার পরিকল্পনার কথাও জানান তিনি।
এই রকম সংবাদ আরো পেতে হলে এই লেখার উপরে ক্লিক করে আমাদের ফেসবুক ফ্যান পেইজে লাইক দিয়ে সংযুক্ত থাকুন। সংবাদটি সম্পর্কে মন্তব্য করতে হলে এই পেইজের নীচে মন্তব্য করার জন্য ঘর পাবেন