মালিকানা ও ব্যবস্থাপনায় বড় পরিবর্তনের ধাক্কা!
কমেছে আমানত ও আয় : অর্থ সংকটে ইসলামী ব্যাংক
পরিচালনা ও ব্যবস্থাপনায় বড় পরিবর্তনের পর বেসরকারি খাতের সবচেয়ে বড় ব্যাংক ইসলামী ব্যাংকের আর্থিক অবস্থার অবনতি ঘটেছে। একদিকে ব্যাংকটিতে আমানত আসা কমে গেছে, পাশাপাশি কমেছে আয়ও। অন্যদিকে বেড়ে গেছে ঋণ বিতরণ। ফলে নগদ অর্থের সংকট তৈরি হয়েছে ব্যাংকটিতে। শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত এই ব্যাংকটির আর্থিক প্রতিবেদন বিশ্লেষণ করে এসব তথ্য পাওয়া গেছে।
আর্থিক প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, গত চার বছরের সঙ্গে তুলনা করলে সবচেয়ে কম আমানত এসেছে চলতি বছরের প্রথমার্ধে। এ ছয় মাসে ব্যাংকটিতে আমানত এসেছে ২ হাজার ২৯৮ কোটি টাকা। অথচ গত বছরের প্রথম ছয় মাসে আমানত এসেছিল ৩ হাজার ৩১০ কোটি টাকা। ২০১৫ সালের প্রথমার্ধে আমানত আসে ৩ হাজার ৫৯৯ কোটি এবং ২০১৪ সালের একই সময়ে ছিল ৫ হাজার ২০৯ কোটি টাকা।
চলতি বছরের ৫ জানুয়ারি ইসলামী ব্যাংকের পরিচালনা ও ব্যবস্থাপনায় বড় ধরনের রদবদল ঘটে। ওই দিন রাজধানীর একটি পাঁচ তারকা হোটেলে দিনভর অনুষ্ঠিত পর্ষদ সভায় ব্যাংকটির পর্ষদের চেয়ারম্যান, ভাইস চেয়ারম্যান ও ব্যবস্থাপনা পরিচালকের পদ থেকে জামায়াত-সমর্থিতদের সরিয়ে দেওয়া হয়। বেনামে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের নামে শেয়ার কিনে ব্যাংকটিতে কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করে চট্টগ্রামভিত্তিক দেশের শীর্ষ পর্যায়ের একটি শিল্প গ্রুপ। এরপর ধাপে ধাপে ব্যাংকটির ব্যবস্থাপনায় রদবদল ঘটানো হয়। নিজেদের পছন্দের লোকদের বসানো হয় বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদে। পরিচালক পদেও দুই দফায় পরিবর্তন আনা হয়।
চট্টগ্রামভিত্তিক শিল্প গ্রুপটির নিয়ন্ত্রণে যাওয়ার পর শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত এই ব্যাংকের শেয়ারের দামও লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়তে থাকে। মাত্র ২০ দিনে প্রতিটি শেয়ারের দাম বাড়ে প্রায় ১৮ টাকা। কিছুদিন বাড়ার পর ধীরে ধীরে কমতে থাকে শেয়ারের দাম।
নিয়ম অনুযায়ী, শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত কোম্পানি হিসেবে ইসলামী ব্যাংককে প্রতি তিন মাস পরপর তাদের আয়-ব্যয়ের আর্থিক প্রতিবেদন প্রকাশ করতে হয়। সর্বশেষ গত রোববার ব্যাংকটি চলতি বছরের অর্ধবার্ষিক আর্থিক প্রতিবেদন প্রকাশ করে। চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে জুন—এই সময়কালটি ছিল ব্যাংকটির রদবদল-পরবর্তী ছয় মাস।
এ ছয় মাসে ব্যাংকটির ঋণ বিতরণও গত চার বছরের তুলনায় বেশি হয়েছে। চলতি বছরের প্রথম ছয় মাসে ব্যাংকটি ৫ হাজার ৩১ কোটি টাকা ঋণ বিতরণ করে। ২০১৬ সালের জানুয়ারি থেকে জুন সময়ে যার পরিমাণ ছিল ৩ হাজার ৫২১ কোটি টাকা। ২০১৫ ও ২০১৪ সালের প্রথম ছয় মাসে বিতরণ করা ঋণের পরিমাণ ছিল যথাক্রমে ২ হাজার ৬৯৫ ও ২ হাজার ২৬৩ কোটি টাকা।
সার্বিকভাবে আর্থিক অবস্থার অবনতি সম্পর্কে ইসলামী ব্যাংকের চেয়ারম্যান আরাস্তু খান বলেন, কোম্পানির আয় এবং আমানত প্রবৃদ্ধি কমেছে। আর্থিক প্রতিবেদনে যেসব আর্থিক সূচকে আগের চেয়ে অবস্থার অবনতি ঘটেছে, সেসব তথ্য অস্বীকার করার তো কোনো উপায় নেই। তবে এটি সাময়িক। দ্রুতই অবস্থার উন্নতি ঘটবে।
আমানতের প্রবৃদ্ধি কমলেও গত জুন শেষে ব্যাংকটির মোট আমানতের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে প্রায় ৭০ হাজার ৪০১ কোটি টাকায়। আমানতের দিক থেকে এটি দেশের দ্বিতীয় শীর্ষ ব্যাংক। এর চেয়ে বেশি আমানত নিয়ে শীর্ষে রয়েছে রাষ্ট্রমালিকানাধীন সোনালী ব্যাংক, এর আমানতের পরিমাণ প্রায় ৯৮ হাজার কোটি টাকা।
তবে ঋণের দিক থেকে দেশের সবচেয়ে বড় ব্যাংক ইসলামী ব্যাংক। গত জুন শেষে ব্যাংকটির মোট ঋণের পরিমাণ ছিল প্রায় ৬৬ হাজার ১৭৩ কোটি টাকা।
বাংলাদেশ ব্যাংকের নীতিমালা অনুযায়ী, ইসলামী ব্যাংক তার আমানতের ৯০ শতাংশ ঋণ বিতরণ করতে পারে। সেখানে জুন শেষে ব্যাংকটির ঋণ আমানতের হার নির্ধারিত সীমা ছাড়িয়ে ৯৩ শতাংশে উন্নীত হয়েছে। মূলত গত ছয় মাসে আগ্রাসী ঋণ বিতরণের কারণে এ অবস্থা তৈরি হয়েছে। এর আগে অধিকাংশ সময়ই ইসলামী ব্যাংকের ঋণ আমানত সীমা ৯০ শতাংশের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল।
কমেছে আয়
ঋণ বিতরণ বাড়িয়ে আয় বাড়ানোর চেষ্টা করা হলেও গত বছরের তুলনায় ব্যাংকটির শেয়ারপ্রতি আয় বা ইপিএস কমে গেছে। চলতি বছরের জুন শেষে শুধু ব্যাংকের নিজস্ব আয়ের ভিত্তিতে ইপিএস দাঁড়িয়েছে ১ টাকা ৬০ পয়সা। আগের বছর, অর্থাৎ ২০১৬ সালের একই সময়ে যার পরিমাণ ছিল ২ টাকা ১২ পয়সা। ২০১৫ সালের প্রথমার্ধে ব্যাংকটির ইপিএস ছিল ২ টাকা ১০ পয়সা। সেই হিসাবে গত তিন বছরের মধ্যে শেয়ারপ্রতি আয় সর্বনিম্ন ছিল চলতি বছর। বড় পরিবর্তনের পর আগের বছরের চেয়ে চলতি বছরের প্রথম ছয় মাসে ইপিএস ৫২ পয়সা বা প্রায় ২৫ শতাংশ কমেছে।
যেকোনো একটি কোম্পানি নির্দিষ্ট একটি সময়ে তার সব ধরনের ব্যয় ও কর পরিশোধ শেষে যে মুনাফা করে, সেটিকে ওই কোম্পানির মোট শেয়ার সংখ্যা দিয়ে ভাগ করে শেয়ারপ্রতি আয় বা ইপিএস হিসাব করা হয়। শেয়ারবাজারের ক্ষেত্রে ইপিএস খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি আর্থিক সূচক। এর মাধ্যমে বিনিয়োগকারীরা কোম্পানির পারফরম্যান্স তথা ব্যবসায়িক লাভ-লোকসান সম্পর্কে জানতে পারেন এবং তার ভিত্তিতে বিনিয়োগের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। এ কারণে তালিকাভুক্ত যেকোনো কোম্পানির ইপিএসের ওঠানামার সঙ্গে শেয়ারবাজারে ওই কোম্পানির শেয়ারের দামেরও হেরফের হয়। যেহেতু ইসলামী ব্যাংক শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত, তাই কোম্পানিটির মালিকানা শেয়ারের মাধ্যমে বিভক্ত। এ কারণে ইসলামী ব্যাংকের ইপিএসের সঙ্গে ব্যবসায়িক পারফরম্যান্সের বিষয়টি জড়িত।
ব্যাংকটির আয় কমে যাওয়ার বিষয়ে চেয়ারম্যান আরাস্তু খান বলেন, ‘গত বছরের চেয়ে সঞ্চিতি সংরক্ষণ বা প্রভিশনিং এবং অন্যান্য কিছু খরচ বাড়ায় আয় কিছুটা কমেছে। বিষয়টিকে আমরা গুরুত্বসহকারে নিয়ে আয় বাড়ানোর চেষ্টা চালাচ্ছি।’
বেড়েছে নগদ অর্থের সংকট
আমানত প্রবৃদ্ধির চেয়ে ঋণ প্রবৃদ্ধি বেশি হওয়ায় ব্যাংকটিতে নগদ অর্থের ঘাটতি দেখা দিয়েছে। চাহিদা মেটাতে তাই সরকারি বন্ডে বিনিয়োগ কমিয়ে আনার পাশাপাশি বন্ড ছেড়ে অর্থ সংগ্রহ করছে ব্যাংকটি।
সর্বশেষ প্রকাশিত আর্থিক প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, গত জুন শেষে ইসলামী ব্যাংকের (সহযোগী প্রতিষ্ঠান বাদে) শেয়ারপ্রতি নগদ অর্থ প্রবাহ বা ক্যাশ ফ্লো প্রায় ১৫ টাকা ঋণাত্মক হয়ে গেছে। ২০১৬ সালের প্রথম ছয় মাসে যা ৪ টাকা ৬৩ পয়সা ঋণাত্মক ছিল। তার মানে শেয়ারপ্রতি নগদ প্রবাহ ১০ টাকার বেশি কমে গেছে।
ব্যাংকসহ বিভিন্ন ধরনের প্রতিষ্ঠানের আর্থিক হিসাব নিরীক্ষা করে এ রকম একাধিক প্রতিষ্ঠানের শীর্ষস্থানীয় ব্যক্তির সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, কোনো ব্যাংকের ক্যাশ ফ্লো ঋণাত্মক হয়ে যাওয়া মানে ওই ব্যাংকটিতে নগদ অর্থের সংকট তৈরি হওয়া। শেয়ারপ্রতি ক্যাশ ফ্লো যত বেশি ঋণাত্মক, নগদ অর্থের সংকটও তত বেশি। এ অবস্থা তৈরি হলে চাহিদা মেটাতে ব্যাংকটিকে চড়া মাশুলে স্বল্প মেয়াদে টাকা ধার করতে হয়। তাতে খরচ বাড়ে। আর খরচ বাড়লে আয় কমে যাবে, এটাই স্বাভাবিক।
শেয়ারবাজারের ক্ষেত্রে যেকোনো কোম্পানির শেয়ারপ্রতি ক্যাশ ফ্লোও একটি গুরুত্বপূর্ণ নির্দেশক। এটির মাধ্যমে সংশ্লিষ্ট কোম্পানির আর্থিক অবস্থার ধারণা পাওয়া যায়। ক্যাশ ফ্লো ঋণাত্মক মানে ওই কোম্পানির কাছে নগদ অর্থের ঘাটতি রয়েছে। আর ক্যাশ ফ্লো ইতিবাচক মানে হলো ওই কোম্পানির হাতে উদ্বৃত্ত তহবিল রয়েছে।
ইসলামী ব্যাংকের নগদ অর্থের সংকটের বিষয়টি স্বীকার করে আরাস্তু খান বলেন, ‘নতুন একটি বন্ড ছেড়ে আমরা ৫০০ কোটি টাকা সংগ্রহের উদ্যোগ নিয়েছি। সেই টাকা হাতে চলে এলে নগদ সংকট কেটে যাবে।’
জানতে চাইলে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা এ বি মির্জ্জা মো. আজিজুল ইসলাম বলেন, ‘আমানত প্রবৃদ্ধি কমে যাওয়া, ইপিএস কমে যাওয়া এবং শেয়ারপ্রতি নগদ অর্থপ্রবাহ ঋণাত্মক হয়ে যাওয়া নিঃসন্দেহে আর্থিক অবস্থার অবনতির লক্ষণ। তবে আমার মনে হয়, ছয় মাসের অবস্থা বিবেচনায় ব্যাংকটি সম্পর্কে এখনই পরিপূর্ণ কোনো সিদ্ধান্তে পৌঁছানো যাবে না। আগামী ছয় মাস বা এক বছর অবস্থা পর্যবেক্ষণ করতে হবে।’প্রতিবেদন প্রথম আলোর সৌজন্যে প্রকাশিত।
এই রকম সংবাদ আরো পেতে হলে এই লেখার উপরে ক্লিক করে আমাদের ফেসবুক ফ্যান পেইজে লাইক দিয়ে সংযুক্ত থাকুন। সংবাদটি সম্পর্কে মন্তব্য করতে হলে এই পেইজের নীচে মন্তব্য করার জন্য ঘর পাবেন