সালমানের মৃত্যু : সেদিন যা ঘটেছিল…
মৃত্যুর ২১ বছর পর বাংলাদেশের সিনেমার আধুনিক যুগের সেরা নায়ক সালমান শাহকে নিয়ে হঠাৎ করেই আলোচনা তুঙ্গে।
আর নতুন করে এই আলোচনার সূত্রপাত করেছে একটি ভিডিও বার্তা। আমেরিকা প্রবাসী এক নারী তার ভিডিও বার্তায় সালমানকে হত্যা করা হয়েছিল বলে দাবি করেন। ভিডিও বার্তা প্রচারকারী রাবেয়া সুলতানা রুবি সালমান মৃত্যুর পর করা হত্যা মামলার একজন আসামি।
তিনি দাবি করেন, সালমান শাহকে হত্যায় জড়িত ছিলেন তার স্ত্রী সামিরা ও তার পরিবার, রুবির চীনা স্বামী চ্যাং লিং চ্যাং। উনি বাংলাদেশে জন চ্যাং নামে পরিচিত ছিল এবং রুবির ভাই রুমি ও চীনা কমিউনিটির কয়েকজন সদস্য।
আর এ দাবির পর নতুন করে আলোচনায় চলে এসেছে সালমান হত্যাকাণ্ডের বিষয়টি। সালমানের পরিবারের দাবি নতুন করে রুবিকে জিজ্ঞাসাবাদ করার মাধ্যমে হত্যাকাণ্ডের তদন্ত দ্রুত শুরু করা হোক। আর সামিরার পরিবারের দাবি একটি মীমাংসিত বিষয়কে উদ্দেশ্যমূলকভাবে সামনে নিয়ে আসা হয়েছে।
সালমানের মৃত্যুর দিন ১৯৯৬ সালের ৬ সেপ্টেম্বর রাতে কি ঘটেছিল, তার অনুসন্ধানের চেষ্টা করেছে বিবিসি বাংলা। প্রতিবেদনে যা বলা হয়েছে তা পাঠকদের জন্য তুলে ধরা হল-
১৯৯৬ সালের ৬ সেপ্টেম্বর দিনটি ছিল শুক্রবার। সেদিন সকাল সাতটায় বাবা কমর উদ্দিন চৌধুরী ছেলে শাহরিয়ার চৌধুরী ইমনের সঙ্গে দেখা করতে ইস্কাটনের বাসায় যান। কিন্তু ছেলের দেখা না পেয়ে তিনি ফিরে আসেন।
এই শাহরিয়ার চৌধুরী ইমন ঢাকার তৎকালীন সিনেমা জগতের সুপারস্টার সালমান শাহ।
সেদিনের ঘটনার বর্ণনা দিতে গিয়ে সালমান শাহ’র মা নীলা চৌধুরী বলেন, বাসার নিচে দারোয়ান সালমান শাহ’র বাবাকে তার ছেলের বাসায় যেতে দিচ্ছিল না ।
নীলা চৌধুরীর বর্ণনা ছিল এ রকম, “বলেছে স্যার এখনতো উপরে যেতে পারবেন না। কিছু প্রবলেম আছে। আগে ম্যাডামকে (সালমান শাহ’র স্ত্রীকে) জিজ্ঞেস করতে হবে। এক পর্যায়ে উনি (সালমান শাহ’র বাবা) জোর করে উপরে গেছেন। কলিং বেল দেবার পর দরজা খুললো সামিরা (সালমান শাহ’র স্ত্রী)।”
“উনি (সালমান শাহ’র বাবা ) সামিরাকে বললেন ইমনের (সালমান শাহ’র ডাক নাম) সঙ্গে কাজ আছে, ইনকাম ট্যাক্সের সই করাতে হবে। ওকে ডাকো। তখন সামিরা বললো, আব্বা ওতো ঘুমে। তখন উনি বললেন, ঠিক আছে আমি বেডরুমে গিয়ে সই করিয়ে আনি। কিন্তু যেতে দেয় নাই। আমার হাজব্যান্ড প্রায় ঘণ্টা দেড়েক বসে ছিল ওখানে।”
বেলা এগারোটার দিকে একটি ফোন আসে সালমান শাহ’র মা নীলা চৌধুরীর বাসায়।
ওই টেলিফোনে বলা হলো, সালমান শাহকে দেখতে হলে তখনই যেতে হবে।
যাওয়ার পর সালমানের বেডরুমের পরিবেশ বর্ণনা করতে গিয়ে সালমানের মা নীলা চৌধুরী বলেন, টেলিফোন পেয়েই সালমান শাহ’র বাসার দিকে রওনা হই। তবে সালমানের ইস্কাটনের বাসায় গিয়ে ছেলে সালমান শাহকে বিছানার ওপর দেখতে পাই।
“খাটের মধ্যে যেদিকে মাথা দেবার কথা সেদিকে পা। আর যেদিকে পা দেবার কথা সেদিকে মাথা। পাশেই সামিরার (সালমান শাহ’র স্ত্রী) এক আত্মীয়ের একটি পার্লার ছিল। সে পার্লারের কিছু মেয়ে ইমনের হাতে-পায়ে সর্ষের তেল দিচ্ছে। আমি তো ভাবছি ফিট হয়ে গেছে।”
“আমি দেখলাম আমার ছেলের হাতে পায়ের নখগুলো নীল। তখন আমি আমার হাজব্যান্ডকে বলেছি, আমার ছেলে তো মরে যাচ্ছে,” বিবিসি বাংলাকে বলছিলেন নীলা চৌধুরী।
ইস্কাটনের বাসা থেকে সালমান শাহকে হলি ফ্যামিলি হাসপাতালে নেয়া হলে সেখানকার ডাক্তাররা তাকে মৃত ঘোষণা করে। এরপর ঢাকা মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালে ময়নাতদন্ত শেষে বলা হয় সালমান শাহ আত্মহত্যা করেছে।
তবে সালমানের পরিবার দাবি করে- সালমান শাহকে হত্যা করা হয়েছে।
নীলা চৌধুরীর অভিযোগ ছিল তারা হত্যা মামলা করতে গেলে পুলিশ সেটিকে অপমৃত্যুর মামলা হিসেবে নথিভুক্ত করে।
পুলিশ বলেছিল, অপমৃত্যুর মামলা তদন্তের সময় যদি বেরিয়ে আসে যে এটি হত্যাকাণ্ড, তাহলে সেটি স্বয়ংক্রিয়ভাবে হত্যা মামলায় মোড় নেবে।
বাংলাদেশের চলচ্চিত্রে অন্যতম শ্রেষ্ঠ নায়কের আকস্মিক মৃত্যুতে স্তম্ভিত হয়ে যায় পুরো দেশ।
সে সময় সারা দেশজুড়ে সালমানের অসংখ্য ভক্ত তার মৃত্যু মেনে নিতে না পারায় বেশ কয়েকজন তরুণী আত্মহত্যা করেন বলেও খবর আসে পত্রিকায়।
সালমানের মৃত্যুর সঠিক কারণ জানতে না পারায় তার ভক্তদের মাঝে তৈরি হয় নানা প্রশ্নের।
সালমান শাহ’র মৃত্যুকে ঘিরে যখন একের পর এক প্রশ্ন উঠতে থাকে, তখন পরিবারের দাবির মুখে দ্বিতীয়বারের মতো ময়নাতদন্ত করা হয়। মৃত্যুর আটদিন পরে সিলেট ওসমানী মেডিকেল কলেজে তিন সদস্য বিশিষ্ট মেডিকেল বোর্ড গঠন করা হয়।
তিনি বিবিসি বাংলাকে বলছিলেন, “লাশটা আমি দেখেছি মরচুয়েরিতে। আমার কাছে মনে হয়েছে যেন সদ্য সে মারা গেছে। এ রকম থাকলে তার মৃত্যুর কারণ যথাযথভাবে নির্ণয় করা যায়। আত্মহত্যার প্রত্যেকটা সাইন (চিহ্ন) সেখানে অত্যন্ত নিবিড়ভাবে ছিল। তার শরীরে আঘাতের কোনো নিশানা ছিল না।”
দ্বিতীয় ময়নাতদন্তে আত্মহত্যার বিষয়টি নিশ্চিত করা হলে মামলার কাজ সেখানেই থেমে যায়।
সালমান শাহ’র পারিবারিক বন্ধু চলচ্চিত্র পরিচালক শাহ আলম কিরণ বলছিলেন, শেষের দিকে অনেক মানসিক চাপে ছিলেন সালমান শাহ। পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে সম্পর্কের টানাপোড়েন এবং প্রযোজকদের সঙ্গে বোঝাপড়ার ঘাটতি তৈরি হয়েছিল।
সালমান শাহ’র মৃত্যুর পরে বাংলাদেশের চলচ্চিত্র অভাবনীয় ক্ষতির মুখে পড়ে।
এই রকম সংবাদ আরো পেতে হলে এই লেখার উপরে ক্লিক করে আমাদের ফেসবুক ফ্যান পেইজে লাইক দিয়ে সংযুক্ত থাকুন। সংবাদটি সম্পর্কে মন্তব্য করতে হলে এই পেইজের নীচে মন্তব্য করার জন্য ঘর পাবেন