যা পারেনি সিঙ্গাপুর তাই পারছে ঢাকা মেডিকেলের চিকিৎসকরা
মুক্তামণির হাতের টিউমার কেটে বাদ দেয়া সম্ভব নয়-সাফ জানিয়ে দিয়েছিল সিঙ্গাপুরের নামকরা একটি হাসপাতাল। কিন্তু চ্যালেঞ্জ নিয়েছিলেন ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের চিকিৎসকরা। ঝুঁকি আছে জেনে সব খুলে বললেন শিশুটির মা-বাবার কাছে। তারাও অনুমতি দিলেন। বাকিটা ইতিহাস।
যা অসম্ভব বলেছিল উন্নত বিশ্বের চিকিৎসালয়, সেটিই সম্ভব করলেন উন্নয়নশীল দেশ বাংলাদেশের চিকিৎসকরা। জটিল ও দীর্ঘ সময় ধরে মুক্তামণির হাতে থাকা টিউমার অপসারণ করলেন তারা।
শিশুটি সুস্থ হয়ে স্বাভাবিক জীবন ফিরে পেতে আরও কয়েকটি অপারেশন লাগবে, জানিয়েছেন চিকিৎসকরা। তবে তার প্রথম অস্ত্রোপচার সফল হয়েছে, এটাই ভীষণ স্বস্তিদায়ক খবর হয়ে এসেছে গণমাধ্যমে।
এর আগেও বেশ জটিল কয়েকজন রোগীর সফল চিকিৎসা করেছেন ঢাকা মেডিকেলের শিক্ষার্থীরা। আর দেশের চিকিৎসা ব্যবস্থা নিয়ে হতাশার মধ্যে এগুলো আলোর রেখা হিসেবেই দেখছেন চিকিৎসা সংশ্লিষ্টরা। ঢাকা মেডিকেলের সফলতা নিয়ে বিদেশি গণমাধ্যমগুলোও ফলাও করে সংবাদ প্রচার করছে।
বিরল রোগে আক্রান্ত হয়ে হাতে পায়ে গাছের মতো শেকড় গজিয়ে যায়া আবুল বাজানদারকে প্রায় সুস্থ করে তুলেছেন ঢাকা মেডিকেলের চিকিৎসকরাই। এই ধরনের চিকিৎসা এর আগে কখনও বাংলাদেশে হয়নি, করা সম্ভব-এমন কথাও ভাবেনি কেউ।
সম্প্রতি জোড়া লাগানো দুই বোন তোফা-তহুরাকেও অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে আলাদা করা হয়েছে ঢাকা মেডিকেলে।
ক্যাথেটার দিয়ে একটি কনডম প্রসূতির জরায়ুর ভেতর ঢুকিয়ে তা বাতাস দিয়ে ফুলিয়ে রক্তক্ষরণ বন্ধ করা যায় তার আবিষ্কারকও ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের এক চিকিৎসক। যা বর্তমানে উন্নত বিশে^র দেশগুলোতেও ব্যবহার হচ্ছে।
সম্প্রতি এই পদ্ধতির আবিষ্কারক গাইনির চিকিৎসক সায়েবা আক্তারকে নিয়ে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম বিবিসি একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। এখন থেকে ১৪ বছর আগে তিনি এ পদ্ধতিটি আবিস্কার করেছিলেন।
ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বার্ন ইউনিটের সমন্বয়ক সামন্ত লালসেন বলেন, ‘ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের সক্ষমতা বেড়েছে আগের তুলনায় অনেক বেশি। আামাদের সীমিত জনবল সম্পদ দিয়েই আমরা কাজ করছি। আমার মনে হয়ে পর্যাপ্ত সুযোগ সুবিধা পেলে বাংলাদেশের পরবর্তী প্রজন্মের চিকিকৎকেরা আরো ভাল করবে।’
মুক্তামণিকে নিয়ে ঝুঁকি সফল
ছোট সময় থেকে মুক্তামণি হাতের সমস্যায় ভুগছে। বিশাল আকৃতির হাত নিয়েই চলাফেরা করেছে শিশুটি। গণমাধ্যমে বিষয়টি নিয়ে সংবাদ প্রকাশ করা হলে চিকিৎসার উদ্যোগ নেয় ঢাকা মেডিকেল কলেজের চিকিৎকরা।
মুক্তামণির ক্ষেত্রে চিকিৎসকদের প্রথম সফলতা ছিল তার রোগ নির্ণয় করা। পরীক্ষার মাধ্যমে তারা নিশ্চিত হন মুক্তামণির হাতের রক্তনালীতে টিউমার রয়েছে। যা বাংলাদেশের অন্যান্য হাসপাতালের চিকিৎসকরা নির্ণয় করতে ব্যর্থ হন।
সিংঙ্গাপুরের জেনারেল হাসপাতালের চিকিৎসকদের কাছে তার রোগ সম্পর্কে মতামত নেওয়া হলেও তারা রোগটি থেকে ভাল হওয়ার মতো নয় বলে মত দেয়। পরে মুক্তামণির হাত কেটে ফেলা হতে পারে বলে সংবাদ প্রকাশ হয়। কিন্তু শেষ পর্যন্ত সেটাও করতে হয়নি। হাত না কেটেই সফলভাবে টিউমার অপসারণ করা হয়েছে।
গত ১১ জুলাই রক্তনালীতে টিউমার নিয়ে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বার্ন ইউনিটে ভর্তি হয় শিশুটি। তার ডান হাত অস্বাভাবিক দুগর্ন্ধযুক্ত ও ফোলা ছিল। শিশুটি স্বাভাবিকভাবেই জন্ম নিয়েছিল। কিন্তু দুই বছর বয়সে তার ডান হাতে ছোট একটি টিউমার দেখা যায়। যা ধীরে ধীরে বড় হতে শুরু করে এবং গত দুই বছর ধরে ব্যাপক আকারে বাড়তে থাকে।
মুক্তামনির রক্তের প্লেটাটিলেট বারবার কমে যাওয়ার কারণে বায়োপসি নেওয়ার প্রক্রিয়ায় বিলম্ব হচ্ছিল এবং এ কথা জেনে প্রধানমন্ত্রী তার চিকিৎসার ব্যাপারে সিঙ্গাপুর জেনারেল হাসপাতালে যোগাযোগ করার পরামর্শ দেন।
গত ২৭ জুলাই ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে সিঙ্গাপুর জেনারেল হাসপাতালের প্লাস্টিক সার্জারি বিভাগের সঙ্গে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বোর্ড মিটিং হয়। পরে ই মেইলের মাধ্যমে সিঙ্গাপুর জেনারেল হাসপাতাল জানায়, মুক্তামনির এই রোগটি ভাল হওয়ার নয়, অপারেশনের মতোও নয়। তবে তারা রোগটির পরীক্ষা নিরীক্ষার ব্যাপারে সাহায্য করার কথা জানায়।
এরপর সিঙ্গাপুর হাসপাতালের অভিমত প্রধানমন্ত্রীকে জানানো হয়। এরপরও ঢাকা মেডিকেলের চিকিৎসকদেরকে চেষ্টা চালিয়ে যেতে বলেন প্রধানমন্ত্রী। আর ২ আগস্ট বুধবার ১৩ জন চিকিৎসককে নিয়ে একটি বৈঠক হয়। সেখানে সিদ্ধান্ত হয়, ঝুঁকিপূর্ণ হলেও ৩ আগস্ট মুক্তামনির শরীর থেকে বায়োপসি নেওয়া হয়। সেখানেই সিদ্ধান্ত হয় মুক্তামনির রক্তনালীতে টিউমার হয়েছে তার রোগটি মোটেও বিরল নয়।
চিকিৎসকদের সিদ্ধান্ত মুক্তামনির বাবা-মাকে জানানো হয় এবং তারা মেয়ের চিকিৎসা চালিয়ে যেতে রাজি হন। এরপর ১২ আগস্ট শনিবার সকালে শুরু হয় মুক্তামনির হাতের অপারেশন। মুক্তামনির ডান হাত থেকে প্রায় তিন কেজি ওজনের টিউমার অপসারণ করেন চিকিৎসকেরা।
ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের চিকিৎসকেরা জানিয়েছেন, শরীর থেকে সব টিউমার সরাতে আরও পাঁচ থেকে ছয়টি অস্ত্রোপচার লাগবে। শারীরিক অবস্থা বুঝে পরবর্তী অস্ত্রোপচারের সময় ঠিক করা হবে।
এ ব্যাপারে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক মিজানুর রহমান বলেন, ‘আমাদের হাসপাতালের সক্ষমতা বেড়েছে। আমরা সীমিত জনবল ও সম্পদ দিয়ে অনেক রোগীর চিকিৎসা করে যাচ্ছি যা বিশ্বমানের চিকিৎসা।’
ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বার্ন ইউনিটের প্রধান সমন্বয়ক সামন্ত লাল সেন বলেন, ‘দেখেন মুক্তামনি আমাদের দেশের মেয়ে। তার চিকিৎসায় ঝুঁকি ছিল এখনও আছে তারপরেও আমরা চেষ্টা করেছি। সিঙ্গাপুর জেনারেল হাসপাতালের সঙ্গে যোগাযোগ করেছিলাম তার ঝুঁকি ছিল বলে ঝুঁকি নেয়নি কিন্তু আমরা নিয়েছি সফলও হয়েছি।’
সামন্ত লাল সেন বলেন, ‘মুক্তামণির অপারেশনে একটি টিম ওয়ার্ক কাজ করেছ। ওয়ার্ড বয় থেকে অধ্যাপকেরা মিলে কাজ করেছে। তাই আমরা সফল হয়েছি।’
প্রায় সুস্থ বাজানদার
বৃক্ষমানব হিসেবে পরিচিতি পাওয়া আবুল বাজনদার কখনও সুস্থ হতে পারবেন, তা ভাবতেও পারেননি। তবে তিনি এখন সুস্থ প্রায় এবং একজন স্বাভাবিক মানুষের মতই জীবন যাপনের অপেক্ষায়।
বাজানদারের রোগটি ছিল বিরল ‘এপিডারমোডাইসপ্লাসিয়া ভেরাসিফরমিস’। ১০ কেজি ওজনের আঁচিল নিয়ে ২০১৬ সালের ৩০ জানুয়ারি তিনি ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বার্ন ইউনিটে ভর্তি হন খুলনার পাইকগাছার তরুণ।
একাধিকবার অপারেশনের পর সুস্থ হয়েছেন আবুল বাজনদার। তিনি এখন ঢাকা মেডিকেলের বিছানায় বসে স্বপ্ন দেখেন সুন্দর ভবিষ্যতের।
ঢাকা মেডিকেল কলেজের বার্ন ইউনিটের প্রধান সমন্বয়ক সামন্ত লাল সেন বলেন, ‘বাজানদারের দুই হাতে পাঁচ বার করে ১০টি আর দুই পায়ে দুইবার করে চারটি অস্ত্রোপচার করা হয়েছে। তিনি এখন সুস্থ তবে তাকে ফলোআপে রাখা হয়েছে।’
আবুল বাজনদার বলেছেন, ‘সুস্থ্ হয়ে বাড়ি ফিরে তাদের সঙ্গে স্বাভাবিকভাবে ঘুরতে-ফিরতে পারব- এটা ভাবতেই কেমন জানি ভালো লাগছে।’
নিজের দুই হাত দেখিয়ে এই তরুণ বলেন, ‘আমি যখন এখানে এসেছিলাম তখন কেমন ছিলাম আর এখন দেখেন কত পরিবর্তন হয়েছে। মনে হয়ে দুই হাত, পায়ে কিছুই নাই।’
তহুরা-তৌফার ভূবন ভুলানো হাসিও ঢাকা মেডিকেলের কল্যাণে
মুক্তামনির অপারেশন শুরু করার ঠিক ১২ দিন আগে অর্থাৎ ১ আগস্ট আরো একটি সফল অপারেশন করেছিলেন ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের সার্জারি বিভাগের চিকিৎসকেরা। ‘পাইগোপেগাস’ নামের রোগে আক্রান্ত জোড়া লাগা যমজ শিশু তোফা ও তহুরাকে আলাদা করা হয়েছিল। সেই শিশুরা এখন ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের শিশু সার্জারি বিভাগের পোস্ট অপারেটিভ ওয়ার্ডে চিকিৎসাধীন রয়েছেন। তারা এখন ভালো আছে সুস্থ আছে।
তোফা-তহুরা যেভাবে জোড়া লাগানো ছিল, চিকিৎসাবিজ্ঞানের ভাষায় একে বলা হয় ‘পাইগোপেগাস’। শিশু দুটোর অস্ত্রোপচারে বিভিন্ন বিভাগের ১৬ জন সার্জন যুক্ত ছিলেন।
শিশু সার্জারি বিভাগের চিকিৎসকেরা জানান, বাংলাদেশের ইতিহাসে ‘পাইগোপেগাস’ শিশু আলাদা করার ঘটনা এটি প্রথম। এর আগে অন্যান্য হাসপাতালে তিন জোড়া শিশুকে অস্ত্রোপচার করে আলাদা করা হয়েছে, তাদের ধরন ছিল আলাদা। নয় ঘণ্টার জটিল অস্ত্রোপচারে দুই শিশুর স্পাইনাল কর্ড, মেরুদণ্ড, পায়ুপথ ও প্রস্রাবের রাস্তা আলাদা করা হয়। জন্মের সময় দুজনের পায়খানার রাস্তা ছিল একটি। তবে মাথা ও পা ছিল আলাদা।-প্রতিবেদন ঢাকাটাইমসের সৌজন্যে প্রকাশিত।
এই রকম সংবাদ আরো পেতে হলে এই লেখার উপরে ক্লিক করে আমাদের ফেসবুক ফ্যান পেইজে লাইক দিয়ে সংযুক্ত থাকুন। সংবাদটি সম্পর্কে মন্তব্য করতে হলে এই পেইজের নীচে মন্তব্য করার জন্য ঘর পাবেন