পর্ণোগ্রাফির আসক্তি থেকে মুক্তির উপায়
ইদানিং পর্ণোগ্রাফিতে আসক্তের সংখ্যা খুব ভয়াবহ আকারে বেড়ে যাচ্ছে। ছোটো ছোটো বাচ্চা থেকে শুরু করে প্রাপ্ত বয়স্কদের মাঝেও আসক্তির মাত্রা প্রবল থেকে প্রবলতর হচ্ছে। সম্পর্কগুলো দিন দিন বেশ জটিলতার দিকে এগোচ্ছে। কখনো কখনো তা সম্পর্কচ্ছেদের করুণ পরিণতিতে গিয়ে শেষ হয়।
যৌনতা প্রাণীজগতে খুব স্বাভাবিক একটা ব্যাপার। কিন্তু সমস্যাটা তখনই হয়, যখন তা পর্নোগ্রাফির মতো একটি বিষয়ে আসক্তির পর্যায়ে চলে যায়। আজ চলুন এ পর্নোগ্রাফির ভয়াবহ ছোবল থেকে কীভাবে নিজেকে এবং সেই সাথে আমাদের সমাজটাকে রক্ষা করা যায়, সেই সম্পর্কে জানা যাক।
প্রথমেই আসা যাক, পর্ণ দেখার কোন লেভেলকে আমরা আসক্তি বলছি কিংবা আপনার জীবনসঙ্গী কি আসক্ত কিনা তা বুঝবেন কীভাবে।
*. অধিকাংশ আসক্তের ক্ষেত্রে দেখা গেছে, তারা বেশ ছোটবেলা থেকে পর্ণ দেখে অভ্যস্ত এবং কৈশোরে পদার্পণের পর ধীরে ধীরে পর্ণ দেখার মাত্রা বাড়তে থাকে। কখনো কখনো যৌবনে পদার্পণের পূর্বেই বেশ ভালো ভাবে আসক্ত হয়ে পড়ে। দৈনিক ৩-৪ ঘন্টা পর্ণ দেখা বাধ্যতামূলক হয়ে দাঁড়ায়, প্রতিদিনের রুটিনও বলতে পারেন।
*. পর্ণ আসক্তি মাদকাসক্তির মতোই। যতই দেখবেন ততই দেখতে ইচ্ছা হবে। সাময়িক সুখের বিনিময়ে আপনাকে বিষণ্ণ এবং নিঃসঙ্গ মানুষে পরিণত করবে। যা আপনাকে আপনার স্ত্রী, সন্তান এবং পরিবার থেকে দূরে সরিয়ে দিতে পারে।
*. বৈবাহিক জীবনে স্ত্রীর সাথে মিলনের আগ্রহ হারিয়ে ফেলা।
*. আসক্তির মাত্রা কখনো কখনো এমন স্তরে পৌছায় যে তা ধর্ষণ, শারীরিক নির্যাতন এবং অনভিপ্রেত ঘটনার জন্ম দেয়, সবচেয়ে ভয়ঙ্কর ব্যাপার হলো তরুণদের মাঝে যৌনতা নিয়ে মস্তিষ্ক বিকৃতি দেখা দেয়।
*. কখনো কখনো আসক্তের কামশক্তি বা যৌন চেতনা ধীরে ধীরে লোপ পেতে থাকে এবং শারীরিক মিলন খুব বিরক্তকর ব্যাপার হয়ে দাঁড়ায়।
নারীদের তুলনায় পুরুষদের মাঝে পর্ণ আসক্তির মাত্রা বেশি। চলুন এবার দেখে নেই পর্ণ আসক্তি আপনাকে কীভাবে তিলে তিলে ধ্বংস করে দিচ্ছে।
শারীরিকভাবে পর্ণ আপনাকে ধীরে ধীরে যৌন অক্ষম করে তোলে। পর্ণ কিংবা শারীরিক মিলনে আপনার মস্তিষ্কের কিছু হরমোন এবং রাসায়নিক বিক্রিয়া ঘটে যা আপনার দেহে যৌন উদ্দিপনার সঞ্চার করে।
* শারীরিক মিলনে এবং পর্ণ দেখার সময় মস্তিষ্কে ডোপামিন নিঃসৃত হয় যা আমাদের আনন্দ, হাসি কান্নাসহ যৌন অনুভূতি নিয়ন্ত্রণ করে। শারীরিক মিলনে এবং পর্ণ দেখার সময় এই ডোপামিন আমাদের মনোযোগকে একীভূত করে এবং যৌনক্ষুধা জাগিয়ে তোলে।
* অক্সিটোসিন এবং ভেসোপ্রসিন নামক দুইটি হরমোন ও এসময় নিঃসৃত হয় যা এই সুখের অনুভুতিকে মেমোরিতে জমা রাখে।
* এছাড়াও শারীরিক উত্তেজনাকে চরমে নিতে এন্ডোরফিন নামক হরমোনের নিঃসরণ ঘটে। মিলনের শেষ মুহূর্তে সেরাটোনিন নিঃসৃত হয়।
বুঝতেই পারছেন, আপনার মস্তিষ্ক আপনার সর্বোচ্চ সুখের অনুভুতিকে স্টোর করে এবং আপনাকে সেই সুখের অনুভুতির দিকে ধাবিত করে ফলশ্রুতিতে আপনার আবার পর্ণ দেখতে ইচ্ছা হয় কিংবা শারীরিক মিলনে ইচ্ছুক হন। পর্ণোগ্রাফি আপনার মস্তিষ্ককে অস্বাভাবিকভাবে উত্তেজিত করে তোলে। এতে প্রচুর ডোপামিন ক্ষরণ হয়। ফলে আপনার মস্তিষ্ক ধীরে ধীরে ডোপামিন নিঃসরণ কমিয়ে দেয়। তখন আপনার আর সাধারণ পর্ণ ভিডিও দেখতে ইচ্ছে করে না, নতুন নতুন খুব তীব্র উত্তেজক ভিডিওর চাহিদা বাড়ে। এভাবে বার বার একই প্রক্রিয়া দীর্ঘ দিন চলতে থাকলে আপনার মস্তিষ্কে ভারসাম্যহীনতা দেখা দেয়, শারীরিক মিলনের ক্ষমতা ধীরে ধীরে লোপ পেতে থাকে। যার ফলাফল আপনি নিজেই দেখতে পান। যেমন – স্ত্রীর সাথে অনুত্তেজক সম্পর্ক, বিষণ্ণতা, সহজেই মনোযোগ হারিয়ে ফেলা, অতিরিক্ত হস্তমৈথুন করেও উত্তেজনা ফিরে না পাওয়া ইত্যাদি।
পর্ণ কামশক্তি ধ্বংস করে : পূর্বেই উল্লেখ করেছি, যৌনতা খুব স্বাভাবিক একটি ঘটনা। বিপরিত লিঙ্গের দুটি মানুষ কাছাকাছি কিংবা শারীরিক সংসর্গে এলে ভালবাসার অনুভূতি জন্মায় এবং যৌন উত্তেজনার সৃষ্টি হয়। কিন্তু আসক্তদের ক্ষেত্রে দুঃখজনক হলেও সত্য এই যে তারা স্ত্রীর সংস্পর্শে স্বাভাবিক উত্তেজনা কিংবা কামনা অনুভব করে না। এ সমস্যা বিবাহিত আসক্তদের মাঝে প্রবল।
পর্ণ আসক্তি ভালবাসার অন্তরায় : পর্ণ ভিডিওতে যেসব মডেল কিংবা অভিনেতা – অভিনেত্রী অভিনয় করেন তারা সাধারণত পেশাদার শিল্পী হয়ে থাকেন। সেই মডেলদের শারীরিক সৌন্দর্যের মোহে অভিভূত হয়ে আপনি আপনার সঙ্গিনী কিংবা স্ত্রীর শারীরিক সৌন্দর্যের সাথে তুলনা করেন। এতে খুব স্বাভাবিকভাবেই আপনি হতাশ হবেন। এই হতাশা আপনার সঙ্গী/সঙ্গিনীর মনে বিরুপ প্রভাব ফেলে যা সম্পর্ক ভাঙ্গনের দিকে গড়ায়। শুধু তাই নয় আসক্তদের মাঝে সম্পর্কে অবিশ্বাস এবং অনাস্থাও দেখা যায়। বিবাহ বহির্ভূত সম্পর্ক কিংবা বহুগামিতাও দেখা যায়।
পৃথিবীতে প্রতিদিন হাজারো মানুষ শারীরিক মিলনে লিপ্ত হচ্ছে কিন্তু ঠিক কতজন মানুষ সেই মিলনকে ভালবাসার মিলনে পরিণত করতে পেরেছেন তা নিয়ে বেশ সন্দেহ রয়েছে। শুধুমাত্র শারীরিক তাড়নার থেকে যে মিলন হয় তার চেয়ে বেশি শক্তিশালী হলো ভালবাসার মিলন। এতে আপনার বৈবাহিক সম্পর্ক যেমন পোক্ত হবে তেমনি বিষণ্ণতা থেকে পাবেন মুক্তি।
পর্ণ আসক্তরা সারাজীবন এক ধরণের ঘোরের মাঝে কাটায়। তাদের কাছে সেই মডেল অভিনেত্রীরাই সৌন্দর্যের প্রতীক, তাদের মস্তিষ্ক ভার্চুয়াল উত্তেজনায় অভ্যস্ত হয়ে যায় ফলে স্ত্রীর সাথে মিলন তাদের বিরক্তকর হয়ে দাঁড়ায়। তরুণ আসক্তদের ক্ষেত্রে মানসিক বিকৃতি দেখা যায়। তাদের চিন্তা ভাবনা এমন স্তরে নেমে যায় যে, তারা মনে করে নারী মাত্রই ভোগ্যবস্তু। স্কুল, কলেজ রাস্তাঘাট এবং আশেপাশের সকল নারীদের নিয়ে বিকৃত ধারণা পোষণ করে। যৌনতা নিয়ে সঠিক ধারণা না থাকায় উঠতি বয়সী মেয়েরা লজ্জা, ভয় এবং ঘৃণায় কখনোবা আত্মহত্যার পথ বেছে নেয়। শুধু তাই নয়, পর্ণের সহজলভ্যতা ছোট ছোট শিশুদের অন্ধকারের দিকে ঠেলে দিচ্ছে, শিক্ষার্থীদের পড়াশুনায় ব্যাপক ব্যাঘাত সৃষ্টি করছে।
পর্ণ আসক্তির কুফল জানা হলো, চলুন সমাধানটাও শুনে নেই।
* পর্ণ আসক্তি থেকে মুক্তি পেতে হলে নিজেকে নিজের প্রতি সৎ থাকতে হবে। প্রথমেই আপনার সংগ্রহে থাকা পর্ণ ভিডিওগুলো ডিলিট করুন। কারণ এ ব্যাপারে আসক্তদের সংগ্রহশালা বেশ উন্নত এবং পরিবর্ধনশীল!
* নিয়মিত যেসব সাইটে ভিজিট করে আপনি আসক্ত হয়েছেন সেসব সাইট ব্লক করুন।
* আপনার পরিবারের সদস্যদের পর্ণ জগতের ধরা ছোঁয়ার বাহিরে রাখতে হলে Parental Controls ব্যবহার করতে পারেন। প্রথমে Settings > Control Panel > Family Safety > Manage settings on the family safety websites। তারপর প্রয়োজন মতো বাকি কাজ নিজের মতো করে করবেন। কিংবা আপনি চাইলে বাচ্চার কম্পিউটার টেবিল বাসার এমন জায়গায় সেট করতে পারেন যেখান থেকে তার মনিটর দেখা যায়। এতে আপনার সন্তান কিছুটা হলেও এর থেকে রেহাই পাবে।
* অনেক আসক্তদের কিছুক্ষণ পর পর পর্ণ দেখতে হয় কিংবা কাজের মাঝামাঝি সময়ে পর্ণ দেখতে হয়। আপনি যদি সেই দলের অন্তর্ভুক্ত হন তবে পর্ণ ছাড়া আপনার পছন্দের কোনো সখ বা বিনোদনের উৎস খুঁজে বের করুন। কাজের মাঝে মাঝে পর্ণ না দেখে সেই পছন্দের কাজ করুন কিংবা গান শুনতে পারেন অথবা ৫ মিনিট হেঁটে আসতে পারেন বাহিরের মুক্ত বাতাসে। এতে আপনার মস্তিষ্ক এবং দেহ থাকবে সতেজ এবং ফুরফুরে।
* নিয়মিত পর্ণ দেখে যাদের অভ্যাস কিংবা ১০ – ১৫ বছরের পুরনো অভ্যাস পর্ণ দেখা, তাদের জন্য আসক্তি থেকে মুক্তি পাওয়া বেশ কঠিন কিন্তু অসম্ভব নয়। এখন থেকে একটি রুটিন তৈরি করুন, চাইলে গুগল ক্যালেন্ডারের সাহায্য নিতে পারেন। আজকের তারিখ থেকে ১ দিন পর পর ১৫ – ২০ মিনিট পর্ণ দেখুন। এভাবে ৭ দিন চলবে। তারপর ধীরে ধীরে ২ দিন পর পর দেখবেন এবং সেটাও ৭ দিন নিয়মিত। অতঃপর ৪, ৪, ৬, ৬ … দিন পর পর দেখুন। ৬ – ৮ মাস পর নিজের দিকে ফিরে তাকাবেন দেখবেন কত্ত বদলে গেছেন আপনি। চাইলে এই অভ্যাস স্ত্রীর কড়া শাসনেও করতে পারেন কারণ আপনি একজন আসক্ত।
পর্ণের কালোজাদুর মোহ থেকে বেরিয়ে এসে পরিবার, সমাজ এবং রাষ্ট্রকে একজন সুন্দর মনের মানুষ উপহার দিন। পাঠকের মনে হতে পারে এই পোস্ট শুধুমাত্র বয়স্কদের জন্য লেখা উচিত কিংবা রোয়ারের মতো প্ল্যাটফর্মে যেখানে কম বয়স্ক পাঠকরাও রয়েছেন সেখানে এমন পোস্ট দেয়া উচিত নয়। তাদের জন্য বলছি, পর্ণের কালোজাদুর মোহে আপনার শিশু সন্তানও অন্ধকারের পথে পা বাড়াতে পারে। যে পর্ণ দেখে, তার এই লেখা বোঝারও বয়স হয়েছে। আমাদের দেশে যদিও যৌনতা এখনও ট্যাবু। কিন্তু এই ট্যাবু ভেঙ্গে বাবা- মা, শিক্ষক এবং বয়স্কদের উচিত শিশু কিশোরদের সঠিক তথ্য জানানো।
এই রকম সংবাদ আরো পেতে হলে এই লেখার উপরে ক্লিক করে আমাদের ফেসবুক ফ্যান পেইজে লাইক দিয়ে সংযুক্ত থাকুন। সংবাদটি সম্পর্কে মন্তব্য করতে হলে এই পেইজের নীচে মন্তব্য করার জন্য ঘর পাবেন