ফের রোহিঙ্গা স্রোত : এক সপ্তাহে এসেছে সোয়া লাখ শরণার্থী
গত ২০ সেপ্টেম্বরের পর কয়েক দিনের জন্য রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ কিছুটা কমে এসেছিল। কদিন ধরে আবার নতুন করে বেড়েছে মিয়ানমার থেকে পালিয়ে আসা মানুষের স্রোত। পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের ভাষ্য অনুযায়ী, মিয়ানমারে সেনাদের নির্যাতনের বিস্তৃতি বাড়ছে।
জাতিসংঘের অভিবাসন সংস্থার (আইওএম) তথ্য, গত দুই দিনে মিয়ানমার থেকে ২১ হাজার ৮০০ রোহিঙ্গা বাংলাদেশে এসেছে। আর গত এক সপ্তাহে ১ লাখ ২০ হাজার রোহিঙ্গা মুসলিম পালিয়ে এসেছে বলে দাবি করছেন রোহিঙ্গা নেতারা।
দুর্গম পাহাড়ি পথ, নদী আর সাগর পাড়ি দিয়ে বাংলাদেশে আসছে এসব নির্যাতিত মানুষ।
রোহিঙ্গা প্রবেশ বেড়ে যাওয়ায় বাড়ছে আবাসন, স্যানিটেশন ও চিকিৎসা সমস্যা। সরকারি বনভূমি ও পাহাড় কেটে গড়ে তোলা হচ্ছে ঝুপড়ি ঘর। তবে পরিস্থিতি এখনো নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়নি বলে দাবি করছেন সার্বিক বিষয়ে দায়িত্বরত সেনা কর্মকর্তারা।
সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, গত ২৫ আগস্ট থেকে মিয়ানমার সেনাবাহিনীর ও রাখাইন মগদের অত্যাচারে দেশটির মংডু থানার প্রায় সব রোহিঙ্গা বাংলাদেশে এসেছে। এখন বুচিদং ও রাছিদং থানার মুসলিম অধ্যুষিত এলাকায় হামলা চালানো হচ্ছে।
বাংলাদেশ সীমান্ত বদর মোকাম থেকে ওই দুই থানার দূরত্ব ২৫ কিলোমিটার। বেশ কয়েকটি পাহাড়, বঙ্গোপসাগরের অংশ সামিলার দরিয়া পাড়ি দিয়ে তারা বাংলাদেশ সীমান্ত লাগোয়া মিয়ানমারের নাইক্ষাংদিয়া জড়ো হচ্ছে। মিয়ানমার ত্যাগ করতে তারা নিচ্ছে জীবনের ঝুঁকি। বঙ্গোপসাগর পাড়ি দিতে গিয়ে উখিয়া উপকূলে ট্রলারডুবির ঘটনায় ইতিমধ্যেই ২১ জন নিহত হয়েছে। নিখোঁজ রয়েছে আরও অর্ধশতাধিক।
রোহিঙ্গাদের নেতা ডা. জাফর আলম জানান, বুচিদং ও রাছিদং থানার ইয়াংমং, তিতারবিল, জাংগামা, মইদং, ছালিপাড়া, গোদাম পাড়া, সাংগামা, জোপাড়া ও প্রিংডম গ্রাম থেকে এক সপ্তাহে ১ লাখ ২০ হাজার রোহিঙ্গা মিয়ানমারের সামিলার দরিয়া পার হয়ে এপারের জিনজিরা ও শাহপরীর দ্বিপে ওঠে। পরে তারা টেকনাফ হয়ে উখিয়ার বিভিন্ন স্থানে আশ্রয় নিয়েছে।
সাংগামা থেকে কুতুপালাং ক্যাম্পে আশ্রয় নেয়া মোহাম্মদ লালু (৪৫) জানান, ২০ সেপ্টেম্বর অং সান সু চি সেখানে বসবাসরত রোহিঙ্গাদের নিরাপত্তার আশ্বাস দিয়েছিল। কিন্তু ২১ তারিখ থেকে সেনারা গ্রামে ঢুকে ঘরবাড়িতে আগুন দেয়। গরু-ছাগল হাঁস-মুরগি লুট করে। তারা যুবতী মেয়েদের দাবি করে। এতে আতঙ্কিত রোহিঙ্গারা সাগরপথে পালিয়ে আসতে শুরু করে।
মিয়ানমারের বুচিদং থানার থামি থেকে পালিয়ে আসা কামাল হোসেনের স্ত্রী দিলদার বেগম (২৫) বিভিন্ন পাহাড় টিলা ও মেটোপথ পাড়ি দিয়ে ছয় দিন খেয়ে না খেয়ে নাইক্ষংদিয়া পৌঁছেন। সেখান থেকে সাগরপথে আসেন টেকনাফের শাহপরীর দ্বীপ। পরে কুতুপালং অস্থায়ী রোহিঙ্গা ক্যাম্পে আশ্রয় নেন তিনি।
তিন সন্তানের মা দিলদার জানান, ৯ দিন আগে তার স্বামী কামাল হোসেনকে গুলি করে হত্যা করে মিয়ানমারের সেনারা। প্রাণ বাঁচাতে সন্তানদের নিয়ে তিনি পাড়ি জমান নাইক্ষংদিয়ায়। সেখান থেকে মাছের ট্রলারে করে নাফ নদী পার হয়ে তিনি অস্থায়ী ক্যাম্পে আসেন।
একইভাবে পালিয়ে এসে কুতুপালং ক্যাম্পে আশ্রয় নিয়েছেন মিয়ানমারের বছিদং থানার মাস্টার হেদায়েতুল ইসলাম। তিনি জানান, তাদের গ্রামে ১২০ পরিবারের মতো রোহিঙ্গা মুসলিমের বসতি ছিল। ইতিমধ্যে শতাধিক পরিবার এপারে চলে এসেছে। মিয়ানমার সেনারা দিনের বেলায় গ্রামে হানা দেয়ার ভয়ে বাকি ২০ পরিবার জঙ্গলে লতাপাতা খেয়ে দিন কাটাচ্ছে।
কুতুপালং রোহিঙ্গা শরণার্থী ক্যাম্প পরিদর্শনের সময় এই প্রতিবেদক দেখতে পান, এক ঘণ্টার ব্যবধানে ওই ক্যাম্পে ৩৬টি পরিবার আশ্রয়ের জন্য আইওএম অফিসে তালিকাভুক্ত হয়। এসব পরিবারের সদস্যসংখ্যা প্রায় ২০০।
আইওএম কক্সবাজার অফিস সূত্র জানায়, ২৭ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত মিয়ানমার থেকে ৫ লাখ ১ হাজার ৮০০ রোহিঙ্গা বাংলাদেশে এসেছে। ২৫ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত সংখ্যাটি ছিল ৪ লাখ ৮০ হাজার। মাত্র দুই দিনের ব্যবধানে ২১ হাজার রোহিঙ্গা আইএমওর নথিতে তালিকাভূক্ত হয়। প্রকৃত সংখ্যা এর চেয়ে অনেক বেশি হতে পারে বলে ধারণা সংশ্লিষ্টদের।
বালুখালি ক্যাম্পের ইনচার্জ লে. কর্নেল মোসাদ্দেক আবু সাঈদ জানান, নতুন করে রোহিঙ্গা আসছে। ফলে চাপও কিছুটা বাড়ছে। তবে পরিস্থিতি এখনো নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাওয়ার মতো পারবেশ হয়নি।
এই রকম সংবাদ আরো পেতে হলে এই লেখার উপরে ক্লিক করে আমাদের ফেসবুক ফ্যান পেইজে লাইক দিয়ে সংযুক্ত থাকুন। সংবাদটি সম্পর্কে মন্তব্য করতে হলে এই পেইজের নীচে মন্তব্য করার জন্য ঘর পাবেন