প্যারাডাইস পেপারস কেলেঙ্কারি : তদন্তে প্রস্তুত নয় বাংলাদেশ

পানামা পেপারসে আসা বাংলাদেশি কারও বিষয়ে অনুসন্ধান শেষ না হতেই প্যারাডাইস পেপারস কেলেঙ্কারি নতুন আলোড়ন তুলেছে। তবে পানামার পরে প্যারাডাইস পেপারসে বাংলাদেশি কারও নাম এলে বিষয়টি কারা তদন্ত করবে, তা নিয়ে পানামা পেপারসের বিষয়ে অনুসন্ধানরত দুদক কর্মকর্তাদের মধ্যে বিভ্রান্তি আছে।

এই বিভ্রান্তির কারণে গত ১৮ মাসেও পানামা পেপারসে প্রকাশিত বাংলাদেশিদের বিষয়ে দুদকের তদন্তে সেই অর্থে গতি নেই। ২০১৬ সালের দুদক আইনের তফসিলে অর্থ পাচার বা মানি লন্ডারিং বাদ দিয়ে দুদককে শুধু ‘ঘুষ ও দুর্নীতি’ তদন্তের এখতিয়ার দেওয়া হয়।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে দুদকের জ্যেষ্ঠ আইনজীবী খুরশীদ আলম খান বলেন, এখন যদি প্যারাডাইস পেপারসে দুদক বাংলাদেশিদের সংশ্লিষ্টতা পায়, তাহলে দুদক, অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি) এবং বাংলাদেশ ফিন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (বিএফআইইউ) অনুসন্ধান করতে পারে। তবে তাঁর মতে, এসব বিষয়ে ব্যবস্থা নিতে দুদকই সবচেয়ে বেশি সামর্থ্য রাখে। তিনি তথ্য দেন যে অর্থ পাচারের অনুসন্ধানে দুদকের এখতিয়ারের প্রশ্ন গত চার মাসের ব্যবধানে হাইকোর্টের দুটি আলাদা বেঞ্চে নিষ্পত্তি হয়েছে।

ওই আইনজীবী বলেন, ‘আমি সাউথইস্ট ব্যাংক এবং একুশে টেলিভিশনের অর্থ পাচারের দুটি আলাদা মামলায় আদালতে বলেছি, দুদক তার এখতিয়ার নিয়ে ধাঁধায় আছে। কিন্তু এটা ঠিক নয়।’ তিনি জানান, আইন সংশোধন করা হলেও পানামা পেপারসের মতো বিষয় তারাই দেখবে। আদালতের দুটি রায়ে এটা সমর্থিত হয়েছে যে অর্থ পাচারের বিষয়টি দুদক দেখবে।

জানতে চাইলে পানামা পেপারস তদন্তের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট দুদকের একজন কর্মকর্তা বলেন, ‘আমরা মনে করি, বিদেশে পাচার হওয়া অর্থ যদি সরকারি খাতের হয়, তাহলে তাঁরা এর অনুসন্ধান করতে পারেন। পানামার বিষয়ে ব্যবসায়ীদের কর ফাঁকির প্রসঙ্গ এসেছে। এটা জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) দেখতে পারে।’

গত বছরের এপ্রিলে বিশ্বজুড়ে বহুল আলোচিত অর্থ পাচারের পানামা পেপারস কেলেঙ্কারি প্রকাশ পায়। এতে বাংলাদেশের ২১ ব্যক্তি ও ৩টি প্রতিষ্ঠানের নাম এবং ১৮টি ঠিকানা প্রকাশ করা হয়। যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াশিংটনভিত্তিক অনুসন্ধানী সাংবাদিকদের সংস্থা ইন্টারন্যাশনাল কনসোর্টিয়াম অব ইনভেস্টিগেটিভ জার্নালিস্ট (আইসিআইজে) বাংলাদেশি এসব ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের নাম প্রকাশ করে।

এতে বলা হয়, এসব ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান কর ফাঁকি দিয়ে অন্য দেশে অর্থ পাচার করেছে। এর আগে ২০১৩ সালে আইসিআইজে বাংলাদেশের আরও ২৯ ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের নামের তালিকা প্রকাশ করেছিল, যা অফশোর লিকস নামে পরিচিতি পায়। গত বছর প্রকাশিত তালিকায় আগের প্রকাশিত ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের নামও ছিল।

তবে আইসিআইজের ওয়েবসাইটে প্রকাশিত প্যারাডাইস পেপারস অংশে অনুসন্ধান চালিয়ে দেখা গেছে, পানামা পেপারস নামাঙ্কিত ১৪টি এবং অফশোর লিকস-সংক্রান্ত ২১টি এন্ট্রিতে বাংলাদেশের ঠিকানা রয়েছে। আইসিআইজে ওয়েবসাইটের সাধারণ বার্তা হলো, ‘আমরা সামনের সপ্তাহগুলোতে প্যারাডাইস পেপারস-সংক্রান্ত তথ্য প্রকাশ করব। তার আগ পর্যন্ত কারা জড়িত এবং তাদের বিষয়ে তথ্য দৃশ্যমান না-ও হতে পারে।’

দুদকের জনসংযোগ কর্মকর্তা প্রণব কুমার ভট্ট গতকাল নিশ্চিত করেন, পানামা পেপারসের বিষয়ে দুদকের তিন সদস্যের তদন্ত কমিটি ইতিমধ্যে কমিশনের কাছে অন্তর্বর্তী প্রতিবেদন জমা দিয়েছে।

তবে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক দুদকের একজন কর্মকর্তা বলেছেন, ওই প্রতিবেদনে কাউকে অভিযুক্ত করা দূরের কথা, কারও বিষয়েই বিস্তারিত বা সম্পূর্ণ তথ্য নেই।

বর্তমানে বিদেশ সফররত দুদকের চেয়ারম্যান ইকবাল মাহমুদ গত জুলাইয়ে বলেছিলেন, ‘১১টি দেশে ১১ জনের ব্যাপারে এমএলএআর (মিউচুয়াল লিগ্যাল অ্যাসিস্ট্যান্স রিকোয়েস্ট) পাঠানো হয়েছিল। এর মধ্যে কয়েকজনের ব্যাপারে তথ্য এসেছে। তবে আরও কিছু তথ্য চাওয়া হয়েছে। ১১ জনের মধ্যে কয়েকজন আছেন দ্বৈত নাগরিক।’

গতকাল এ বিষয়ে মুঠোফোনে অগ্রগতি জানতে চাইলে অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম বলেন, পানামা পেপারস-সংক্রান্ত কোনো অগ্রগতি তিনি তাৎক্ষণিক মনে করতে পারছেন না। অপরাধ-সংক্রান্ত বিষয়ে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ও অনেক সময় এমএলএআর করে থাকে। তবে অর্থ পাচারের বিষয়ে বিদেশি রাষ্ট্রের সঙ্গে প্রতিটি ঘটনায় যোগাযোগ রক্ষা করাটা তাঁর দপ্তরের এখতিয়ারভুক্ত।

অ্যাটর্নি জেনারেল বিদেশে পাচার হওয়া অর্থ উদ্ধারে এ পর্যন্ত সফল উদাহরণ হিসেবে সিঙ্গাপুর থেকে আনা আরাফাত রহমান কোকোর টাকা প্রসঙ্গ উল্লেখ করেন। অবৈধ অফশোর লেনদেন প্রসঙ্গে তিনি ব্রিটেনের কাছে একটি ছোট দ্বীপে বিএনপির নেতা ও সাবেক মন্ত্রী মোশাররফ হোসেনের অর্থ বাজেয়াপ্ত থাকার কথা উল্লেখ করেন। তিনি আরও জানান, ওই অর্থ কবে আনা যাবে, তা অনিশ্চিত। কারণ ওই মামলার ওপর উচ্চ আদালতে স্থগিতাদেশ রয়েছে।

এ বিষয়ে এক প্রশ্নের জবাবে সিআইডির অর্থনৈতিক অপরাধ বিভাগের প্রধান (এসএস) মোল্ল্যা নজরুল ইসলাম গত রাতে বলেন, আইন অনুযায়ী তাঁরা পানামা পেপারসের মতো বিষয়ের অনুসন্ধান করতে পারেন। এই পদে তিনি আট মাস দায়িত্ব পালন করছেন। এই সময়ে পানামা পেপারস অনুসন্ধান বিষয় তাঁর কাছে যায়নি।

মোল্ল্যা নজরুল বলেন, অর্থ পাচারের আইন সংশোধনের পর তাঁরা এ-সংক্রান্ত ২৭টি অপরাধের মধ্যে ২৪টির তদন্ত করতে পারেন। তাঁর মতে, সরকার, বাংলাদেশ ব্যাংকের অনুরোধ এমনকি স্বতঃপ্রণোদিতভাবেও তাঁরা প্যারাডাইস বা পানামা পেপারসের মতো বিষয় অনুসন্ধান করতে পারেন।

সিআইডির আরেকজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ২০১৫ সালে অর্থ পাচার আইন সংশোধনের পরে বিদেশে বাড়ি ক্রয়ের ৪-৫টি এবং বিদেশে অবৈধ লেনদেনের প্রায় ১০টি মামলার অনুসন্ধান করছে সিআইডি। এর মধ্যে পানামা পেপারসের কোনো বিষয় নেই।

পানামা বা প্যারাডাইসের মতো বিষয় অনুসন্ধানের সামর্থ্য সম্পর্ক জানতে চাইলে সিআইডির ফরেনসিক প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউটের কমান্ড্যান্ট ও অতিরিক্ত উপমহাপরিদর্শক শাহ আলম বলেন, সিআইডি এবং বাংলাদেশ ফিন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট অর্থ পাচার বিষয়ে অনুসন্ধানে ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করছে।

বাংলাদেশ ফিন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের একজন পদস্থ কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে গত রাতে বলেন, ‘পানামা পেপারসের বিষয়ে আমরা দুদককে সহযোগিতা দিয়ে যাচ্ছি।’ এ বিষয়ে আলাদাভাবে তাঁরা অনুসন্ধান করছেন না।

উল্লেখ্য, পানামা পেপারস কেলেঙ্কারির পর ভারতের সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশে তদন্ত কমিটি হয়েছিল। প্যারাডাইস কেলেঙ্কারির পর গতকাল ভারতের কর বিভাগের প্রধানের নেতৃত্বে সরকারের বিভিন্ন সংস্থার প্রতিনিধিদের সমন্বয়ে তদন্ত কমিটি হয়েছে। সূত্র : প্রথম আলো