এ কলঙ্ক বহুকাল বহন করতে হবে : হাইকোর্ট
বহুল আলোচিত বিডিআর বিদ্রোহের ঘটনায় মামলার রায়ের পর্যবেক্ষণে হাইকোর্ট বলেছেন, এ কলঙ্কের চিহ্ন বিডিআর জোয়ানদের বহুকাল বহন করতে হবে।
রোববার এ মামলার রায় ঘোষণা শুরু করেছেন হাইকোর্ট। তবে আদেশের অংশসহ মূল রায় সোমবার (২৭ নভেম্বর) ঘোষণা করা হবে। রায়ের পর্যবেক্ষণে ভিন্নমত থাকলেও আদেশের অংশের বিষয়ে তিন বিচারপতিই একমত হয়েছেন।
হাইকোর্টের বিচারপতি মো. শওকত হোসেনের নেতৃত্বে তিন সদস্যের বিশেষ বেঞ্চ এ রায় ঘোষণা করছেন। বেঞ্চের অপর দুই সদস্য হলেন বিচারপতি মো. আবু জাফর সিদ্দিকী ও বিচারপতি মো. নজরুল ইসলাম তালুকদার।
বেঞ্চের নেতৃত্বদানকারী বিচারপতি মো. শওকত হোসেন রায় রোববার বেলা ১০টা ৫৫ মিনিটে রায় ঘোষণা শুরু করেন। তার কিছু পর্যবেক্ষণ দেয়ার পরই বেঞ্চের অপর সদস্য বিচারপতি মো. আবু জাফর সিদ্দিকী তার পর্যবেক্ষণ দেয়া শুরু করেন। বিকেল পর্যন্ত তিনি পর্যবেক্ষণ দেন। সোমবার সকালে বেঞ্চের কনিষ্ঠ বিচারপতি মো. নজরুল ইসলাম তালুকদার তার পর্যবেক্ষণ ঘোষণা করবেন। এরপরই মূল রায় (আদেশের অংশ) দেয়া শুরু হবে।
সোমবার সকাল সাড়ে ১০টার পর থেকে আদেশের অংশ ঘোষণা শুরু হতে পারে বলে জানিয়েছেন আদালত। এ বিষয়ে রাষ্ট্রের প্রধান আইন কর্মকর্তা অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম বলেন, আশা করি আগামীকাল (সোমবার) চূড়ান্ত রায় ঘোষণা করা হবে।
তিনি বলেন, রায়ে কতজনের মৃত্যুদণ্ড, কতজনের যাবজ্জীবন কারাদণ্ড হবে, কার সাজা বহাল থাকবে, কাকে খালাস দেয়া হবে-সে বিষয়ে তিন বিচারপতিই একমত হয়েছেন।
বিচারপতি মো. আবু জাফর সিদ্দিকী রায়ের পর্যবেক্ষণে বলেন, যুগান্তকারী এ মামলায় সাজা প্রদানে আমরা তিনজন বিচারক একমত হয়ে মামলাটি নিষ্পত্তির সিদ্ধান্ত নিয়েছি। নজীরবিহীন ঐতিহাসিক এ মামলায় পক্ষগণের যুক্তিতর্ক, আইনের ব্যাখ্যাসহ উপস্থাপিত উচ্চ আদালতের নজির, মামলার প্রেক্ষাপট, পারিপার্শ্বিক অবস্থা, ঘটনার গাম্ভীর্যতা, আসামি ও সাক্ষীর সংখ্যা, তদন্ত কার্যক্রম ও তর্কিত রায়ের বিশ্লেষণসহ দণ্ড এবং সাজা প্রদানের ক্ষেত্রে আমাদের অনুভূতি ও সার্বিক পর্যবেক্ষণের প্রয়োজনীয়তা রয়েছে বলে মনে করি।
পর্যবেক্ষণে বলা হয়, আইনের শাসন ও ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে মামলার ঐতিহাসিক গুরুত্ব বিবেচনায় সংগত কারণেই আইনবিজ্ঞান, অপরাধবিজ্ঞান, সমাজবিজ্ঞান, চিকিৎসাবিজ্ঞান, (কুরআনের) ধর্মীয় দৃষ্টিকোন, বিভিন্ন দেশে অপরাধের সাজা ও আইনের শাসন সম্পর্কে সংবিধানের নির্দেশনা বিবেচনার দাবি রাখে।
পর্যবেক্ষণে আরো বলা হয়, ‘এ মামলায় অভিযুক্তরা বিদ্রোহের জন্য অপরাধমূলক ষড়যন্ত্র, নৃসংশ হত্যাকাণ্ড, অমানবিক নির্যাতন, বাড়ি ও গাড়িতে অগ্নিসংযোগ, লুটতরাজ, অস্ত্রাগার ও ম্যাগজিন ভেঙে অস্ত্র ও গোলাবারুদ লুণ্ঠন করে গ্রেনেড বিস্ফোরণ, সশস্ত্র মহড়ার মাধ্যমে সন্ত্রাস ও জনজীবনে ভীতিকর পরিস্থিতির সৃষ্টি, লাশ গুম, রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্ব ও স্থিতিশলীতা বিনষ্টের চক্রান্তসহ নানাবিধ জঘন্য অপরাধ সংঘটিত করে।’
‘ঘটনার ভয়াবহতা, নৃসংশতা, পৈশাচিকতা, বিশৃঙ্খতা, রাষ্ট্রের স্থিতিশীলতা বিনষ্টের চক্রান্ত ও সামাজিক নিরাপত্তাসহ সামগ্রিক বিবেচনায় এটি রাষ্ট্রের একটি গুরুত্বপূর্ণ ফৌজদারি মামলা। এটা ফৌজদারি অপরাধ জগতে বিরল ঘটনা।’
পর্যবেক্ষণে আরো বলা হয়, ‘৫৭ জন মেধাবী সেনা কর্মকর্তাসহ ৭৪ জন নিরস্ত্র মানুষকে হত্যা করে দেশের আইনের শাসনকে বৃদ্ধাঙুলি দেখিয়ে রাষ্ট্রের স্থিতিশীলতা বিনষ্টের চক্রান্তে লিপ্ত হয় বিডিআর সৈনিকরা।’
দেশের অর্থনৈতিক মেরুদণ্ড ভেঙে দেয়াসহ স্বাধীনতা সার্বভৌমত্বের ওপর প্রত্যক্ষ হুমকির বহিঃপ্রকাশ ঘটিয়ে নারকীয় নৃশংস ও বর্বরোচিত হত্যাযজ্ঞ চালিয়ে এক কলঙ্কজনক অধ্যায় সৃষ্টির মাধ্যমে নিজেদের ইতিহাসের আস্তাকুঁড়ে নিক্ষেপ করেছেন তারা। এ কলঙ্কের চিহ্ন বিডিআর (বিজিবি) জোয়ানদের বহুকাল বহন করতে হবে।
এ বিচারপতি তার পর্যবেক্ষণে আরো বলেন, ‘পিলখানার হত্যাকাণ্ড একটি নজীরবিহীন ঘটনা। মাত্র ৩০ ঘণ্টার বিদ্রোহে ৫৭ জন সেনা কর্মকর্তাসহ ৭৪ জনকে হত্যার ঘটনা ছিল বর্বরোচিত ও নজীরবিহীন। যেখানে ১৯৭১ সালে ৯ মাসে স্বাধীনতা যুদ্ধে মাত্র ৫৫ জন সেনা কর্মকর্তা পাকিস্তান হানাদার বাহিনীর হাতে নিহত হন।
আফ্রিকার রুয়ান্ডা ও কঙ্গোর গৃহযুদ্ধে ১৭ জন, দক্ষিণ ফিলিপাইনে এক বিদ্রোহে ছয়জন, ১৯৬৭ সালে ইন্দোনেশিয়ায় সাতদিনের বিদ্রোহে একশজন নিহত হন বলে পরিসংখ্যানে পাওয়া যায়। পিলখানার ঘটনা এসব নজিরকে হার মানিয়েছে।
পর্যবেক্ষণে আরও বলা হয়, ‘অর্থনৈতিক ও সামাজিক নিরাপত্তা বিঘ্ন করার জন্য একটি স্বার্থান্বেষী মহলের পরিকল্পিত ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে দক্ষ ও প্রশিক্ষিত বাহিনীকে ধ্বংসের চেষ্টা করা হয়। তবে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অসীম ধৈর্য, বিচক্ষণতা ও দৃঢ় সাহস এবং বলিষ্ঠ পদক্ষেপ নিয়ে বিদ্রোহ দমনের যৌক্তিক ব্যবস্থা গ্রহণ করেন, যা প্রশংসনীয়। তার রাষ্ট্রনায়কোচিত দৃঢ় পদক্ষেপ অবশ্যই প্রশংসার দাবি রাখে।
‘অন্যদিকে আইনের শাসনের প্রতি শ্রদ্ধা, দেশের সার্বভৌম আর্থ সামাজিক ও রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা রক্ষায় প্রশিক্ষিত, দক্ষ ও সৃশৃঙ্খল প্রতিষ্ঠান হিসেবে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী, বিমান ও নৌবাহিনী দেশের সংবিধান ও গণতন্ত্রের প্রতি অগাধ বিশ্বাস ও অবিচল আস্থা রেখে চরম ধৈর্যের সঙ্গে উদ্ভুত ভয়ঙ্কর পরিস্থিতি মোকাবেলার মাধ্যমে পেশাদারিত্বের পরিচয় দিয়ে দেশের ভালোবাসা ও সুনাম অর্জন করেছে।’
বাংলাদেশ রাইফেলসের ২১৮ বছরের ইতিহাস, স্বাধীনতা যুদ্ধে তাদের (ইপিআর বাহিনী হিসেবে) অসামন্য ও গৌরবোজ্জ্বল ভূমিকা রায়ে তুলে ধরা হয়েছে।
রায়ে বলা হয়, ২১৮ বছরের অধিককালের ঐতিহ্যবাহী আধা সামরিক বাহিনী হিসেবে বিডিআরের নেতৃত্ব শুরু থেকেই সেনাবাহিনীর হাতে ছিল। ফলে সাধারণ জওয়ান ও সেনা কর্মকর্তাদের মধ্যে মর্যাদা, শৃঙ্খলা ও স্বার্থ সংশ্লিষ্ট বিষয় নিয়ে ক্রমান্বয়ে দূরত্ব সৃষ্টি হয়।’
ফলে বিডিআর সদস্যদের মধ্যে সেনা অফিসারদের কতৃত্ব মেনে না নেয়ার এক প্রচ্ছন্ন মানসিকতা নীরবে সক্রিয় ছিল। ওই ঔদ্ধত্যপূর্ণ মানসিকতায় বিডিআরের বিভাগীয় কতিপয় উচ্চাভিলাষী সদস্যের প্ররোচণায় ও উস্কানিতে সাধারণ ও নবাগত সৈনিকরা প্ররোচিত ও বিভ্রান্ত হয়েছে বলেও রায়ে বলা হয়।
২০০৯ সালের ২৫ ও ২৬ ফেব্রুয়ারি পিলখানায় বিডিআর বিদ্রোহে ৫৭ সেনা কর্মকর্তাসহ ৭৪ জনকে নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়। এ ঘটনায় প্রথমে রাজধানীর লালবাগ থানায় হত্যা এবং বিস্ফোরক আইনে দুটি মামলা হয়। পরে এসব মামলা নিউমার্কেট থানায় স্থানান্তরিত হয়। মামলায় সিআইডি দীর্ঘ তদন্ত শেষে হত্যা মামলায় ২৩ বেসামরিক ব্যক্তিসহ প্রথমে ৮২৪ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দাখিল করে। পরে সম্পূরক অভিযোগপত্রে আরও ২৬ জনের নাম অন্তর্ভুক্ত করায় আসামির সংখ্যা হয় ৮৫০ জন।
এছাড়া বিস্ফোরক আইনে করা মামলায় ৮০৮ জনের বিরুদ্ধে চার্জশিট দেয় সিআইডি। পরে আরও ২৬ জনকে অভিযুক্ত করে মোট ৮৩৪ জনের বিরুদ্ধে সম্পূরক অভিযোগপত্র দেয়া হয়। বিচার চলার সময়ে বিডিআরের ডিএডি রহিমসহ চার আসামির মৃত্যু হয়।
মামলায় আসামিদের মধ্যে বিএনপি নেতা ও সাবেক সংসদ সদস্য নাসির উদ্দিন আহমেদ পিন্টু এবং স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা তোরাব আলীরও দণ্ড দেয়া হয়। সাজা ভোগকালীন বিএনপি নেতা নাসির উদ্দিন আহমেদ পিন্টু কারাগারে অসুস্থ হয়ে মৃত্যুবরণ করেন।
রক্তাক্ত ওই বিদ্রোহের প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশ সীমান্তরক্ষী এ বাহিনীর নাম পরিবর্তন করা হয়। নাম বদলের পর এ বাহিনী এখন বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি) হিসেবে পরিচিত।
এই রকম সংবাদ আরো পেতে হলে এই লেখার উপরে ক্লিক করে আমাদের ফেসবুক ফ্যান পেইজে লাইক দিয়ে সংযুক্ত থাকুন। সংবাদটি সম্পর্কে মন্তব্য করতে হলে এই পেইজের নীচে মন্তব্য করার জন্য ঘর পাবেন