রোহিঙ্গাদের ত্রাণ বিতরণে বাণিজ্য : ৯ এনজিওকে তলব

হত্যা-নির্যাতনের মুখে মিয়ানমার থেকে পালিয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়া রোহিঙ্গাদের জন্য দেয়া ত্রাণ বিতরণে নয়টি এনজিওর বিরুদ্ধে বাণিজ্যের প্রমাণ পাওয়া গেছে। এসব এনজিও খোলাবাজার থেকে কম দামে পণ্য কিনে প্যাকেটে ভরে বেশি খরচ দেখিয়েছে। এর ফলে রোহিঙ্গাদের জন্য বিদেশ থেকে আসা অর্থ গেছে এনজিওগুলোর পকেটে। এছাড়া এখতিয়ারবহির্ভূত কার্যক্রম চালুর সত্যতা পেয়েছে কক্সবাজার জেলা প্রশাসকের কার্যালয়। তাই এসব এনজিওকে বাণিজ্যের বিষয়ে ব্যাখ্যা দেয়ার জন্য গত ১০ জানুয়ারি চিঠি দিয়েছে এনজিওবিষয়ক ব্যুরো। সাত কর্মদিবসের মধ্যে চিঠির জবাব দিতে বলা হয়েছে। মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ ও এনজিওবিষয়ক ব্যুরো সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।

সূত্র জানায়, সম্প্রতি কক্সবাজারের জেলা প্রসাশক মো. আলী হোসেন এ নয়টি এনজিওর নানা অনিয়ম সংবলিত একটি প্রতিবেদন মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের সচিব বরাবর পাঠান। একই সঙ্গে এসব এজিওর বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়ার অনুরোধ জানান।

ওই প্রতিবেদন অনুযায়ী নয়টি এনজিও হলো- অগ্রযাত্রা বাংলাদেশ, কাতার চ্যারিটি, আল্লামা ফজলুল্লাহ ফাউন্ডেশন, সোশ্যাল অ্যাজেন্সি ফর ওয়েলফেয়ার অ্যান্ড অ্যাডভান্সমেন্ট ইন বাংলাদেশ (ছওয়াব), প্ল্যান ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ, নেটওয়ার্ক ফর ইউনিভার্সেল সার্ভিসেস অ্যান্ড রুরাল অ্যাডভান্সমেন্ট (নুসরা), দুস্থ স্বাস্থ্যকেন্দ্র, ইউনাইটেড সোশ্যাল অ্যাডভান্সমেন্ট (ঊষা) এবং সেভ দ্য চিলড্রেন ইন্টারন্যাশনাল।

এসব বিষয়ে জানতে চাইলে এনজিওবিষয়ক ব্যুরোর ভারপ্রাপ্ত মহাপরিচালক মো. শাহাদাৎ হোসাইন বলেন, একই প্রতিবেদন এনজিওবিষয়ক ব্যুরোতেও পাঠিয়েছে কক্সবাজার জেলা প্রশাসক। সে অনুযায়ী ইতোমধ্যে আমরা অভিযুক্ত নয়টি এনজিওকে সাত কর্মদিবসের মধ্যে এসব বিষয়ে ব্যাখা চেয়ে চিঠি দিয়েছি। সাত কর্মদিবস শেষ হবে বৃহস্পতিবার। বৃহস্পতিবার তারা যে ব্যাখ্যা দেবে সে অনুযায়ী পরবর্তী ব্যবস্থা নেয়া হবে।

ওই প্রতিবেদনের বিষয়ে শাহাদাৎ হোসাইন বলেন, জেলা প্রশাসক যে প্রতিবেদন পাঠিয়েছেন এ প্রতিবেদনেও কিছুটা অস্পষ্টতা রয়েছে। আমরা যে এনজিকে এফডি-৭ (ফরেন ফান্ডের জরুরি ত্রাণ) বিতরণের অনুমতি দেই সেসব এনজিও তো নিজেই ত্রাণ বিতরণ কর্যক্রম চালাতে পারে না। নিয়ম হলো এফডি-৭ ক্ষেত্রে এনজিওগুলো ত্রাণ সামগ্রী নিয়ে জেলা প্রশাসকের কাছে হস্তান্তর করবে। তারপর জেলা প্রশাসক সুবিধা অনুযায়ী ওসব ত্রাণসামগ্রী বিতরণ করবে। কিন্তু প্রতিবেদনে কে বিতরণ করেছে বা আদৌ বিতরণ হয়েছে কি-না বিষয়টি স্পষ্ট নয়।

জেলা প্রশাসকের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ‘বাংলাদেশে আশ্রয় গ্রহণকারী বলপ্রয়োগে বাস্তচ্যুত মিয়ানমার নাগরিকদের জন্য ৯০টি এনজিওর ১৯২টি এফডি-৭ সংক্রান্ত বরাদ্দপত্র জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে উপস্থাপিত হয়। এনজিওগুলো জেলা প্রশাসক কক্সবাজারের তত্ত্বাবধানে তাদের কার্যাবলি চলিয়ে যাচ্ছে। তন্মধ্যে নয়টি এনজিওর কার্যাবলিতে অনিয়ম পরিলক্ষিত হয়েছে, যা অনাকাঙ্ক্ষিত।

যে ধরনের অনিয়ম করেছে নয় এনজিও-

আগ্রযাত্রা বাংলাদেশ : এ এনজিওটির ১৪০ টাকা কেজির পাঁচ কেজি ডাল এফডি-৭ এ দেয়ার কথা থাকলেও সংস্থাটি ৭০ টাকা কেজির তিন কেজি ডাল দিয়েছে। এফডি-৭ এ দুইশ’ টাকা দামের দুটি গামছা দেয়া কথা থাকলেও ৮০ টাকা দামের একটি গামছাকে ছিঁড়ে দু’টুকরো করে দুই প্যাকেটে দেয়া হয়েছে। এফডি ৭-এ ডাস্টফেন, ব্রাশ, ডাস্টবিনের একটি ৩২০ টাকার সেট দেয়ার কথা থাকলেও ৪৫ টাকা মূল্যের ছোট মায়লার ঝুড়ি ও বেলচা দেয়া হয়েছে। এছাড়া অন্যান্য দ্রব্যসামগ্রীর মানও এফডি-৭-এর অনুমোদিত দাম অনুসারে পাওয়া যায়নি।

কাতার চ্যারিটি : ২৮ হাজার টাকা মূল্যের এক হাজারটি তাবু এ এনজিওটির দেয়ার কথা থাকলেও দিয়েছে ২৪ হাজার টাকা মূল্যের এক হাজারটি তাবু। এছাড়া এফডি-৭ অনুসারে রান্না করা খাবার প্রাথমিকভাবে দেয়া শুরু করলেও পরবর্তীতে শুকনো খাবার সরবরাহ করে যাওয়ার সংশোধিত এফডি-৭ কাক্সবাজার জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে পেশ করার অঙ্গীকার করা সত্ত্বেও তা পেশ করেনি।

আল্লামা ফজলুল্লাহ ফাউন্ডেশন : এ এনজিওর নামে বিভিন্ন স্মারকে ১৮টি বরাদ্দপত্র পাওয়া যায়। প্রাথমিকভাবে এনজিওর প্রতিবেদন দিলেও পরবর্তীতে এ এনজিওর কার্যাবলি সংশ্লিষ্ট অফিসকে অবহিত করা হচ্ছে না।

ছওয়াব : এনজিওটির ১১ লাখ টাকার ত্রাণ সহায়তা দেয়ার কথা থাকলেও সরেজমিনে চার লাখ টাকার ত্রাণসামগ্রী বিতরণের সত্যতা পাওয়া গেছে।

নুসরা : এনজিওটি ত্রাণসামগ্রী বিতরণের কোনো তথ্য কক্সবাজার জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে জমা দেয়নি।

প্ল্যান ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ : এ এনজিওটির তিন হাজার টাকার ডিগনিটি কিটস দেয়ার কথা থাকলেও সরেজমিনে নয়শ’ টাকার ডিগনিটি কিটস দেয়ার পমাণ পাওয়া গেছে।

উষা : এনজিওটি ত্রাণসামগ্রী বিতরণের কোনো তথ্য কক্সবাজার জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে জমা দেয়নি।

সেভ দ্য চিলড্রেন ইন্টারন্যাশনাল : এ এনজিওটির এফডি-৭ এর আওতায় ১৩৩ টাকা কেজির ডাল দেয়ার কথা থাকলেও তারা ৮৫ টাকা কেজির ব্রানডেড (তীর মার্কা) ডাল আর কিছু খোলা বাজারের ৬৫ টাকা কেজির মোটা ডাল বিতরণ করেছে। এক্ষেত্রে প্যাকেজিংয়ের খরচ ৯২ টাকা ৯৬ পয়সা ধরা হলেও প্রকৃত খরচ হয় ১৬ টাকা। ফলে শুধু প্যাকেজিংয়ের ক্ষেত্রে ১৭ লাখ টাকা অতিরিক্ত খরচ দেখানোর প্রমাণ পাওয়া গেছে।

এছাড়া জেলা প্রশাসকের অনুমতি ছাড়াই চাইল্ড রিক্রিয়েশন সেন্টার নির্মাণ করেছে সেভ দ্য চিলড্রেন, যা অনাকাঙ্ক্ষিত এবং অনভিপ্রেত বলে উল্লেখ করা হয়েছে প্রতিবেদনে। সেভ দ্য চিলড্রেন ইন্টারন্যাশনালের কয়েকটি অনুমোদিত বরাদ্দের চিঠি এনজিওবিষয়ক ব্যুরো থেকে পাওয়া গেছে, যার রিপোর্ট কক্সবাজার জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে জমা দেয়নি তারা।