খালেদা জিয়ার সাজা হলে যা করবে বিএনপি
জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট মামলার রায় ঘোষণা হবে আগামী ৮ ফেব্রুয়ারি। দলের চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে করা এই মামলার রায়কে কেন্দ্র করে স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা গুছিয়ে আনছে বিএনপি। দলের সিনিয়র নেতারা তাদের বাসা-অফিসে চেয়ারপারসনের মামলার নানা দিক নিয়ে পর্যালোচনা করছেন। তবে হঠাৎ করে বৃহস্পতিবার (২২ জানুয়ারি) রায়ের দিনক্ষণ ঘোষণা করায় অস্বস্তিও রয়েছে দলটিতে। বিএনপির সমমনা রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকরা বলছেন, খালেদা জিয়ার মামলার রায়কে কেন্দ্র করে দলটির পরিচালনা সুষ্ঠু ও অবাধ রাখতে একটি কমিটি করা প্রয়োজন। যে কমিটি খালেদা জিয়ার অনুপস্থিতিতে দলকে ঐক্যবদ্ধ রাখবে।
বিএনপির নেতারা বলছেন, খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে রায়ে অপ্রত্যাশিত কিছু হলে তা মোকাবিলায় যথেষ্ট পরিকল্পনা ও প্রস্তুতি রয়েছে তাদের। গত ডিসেম্বরের শেষ দিকে দলের ৭৫টি টিম তৃণমূলে এ বিষয়ে দলীয় নির্দেশনা পৌঁছে দিয়েছে।
সিলেট বিভাগের একটি জেলার দায়িত্বশীল একনেতা জানান, গত ডিসেম্বরে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায় সিলেট বিভাগে এসেছিলেন। ওই সময় তার বার্তা ছিল, ‘আগামী দিনে আন্দোলন-সংগ্রাম আসছে। সবাইকে ঐক্যবদ্ধভাবে কর্মসূচি সফল করতে হবে। দলের প্রধানকে নিয়ে ষড়যন্ত্রমূলক রায় দেওয়া হলে, তা সর্বশক্তি দিয়ে মোকাবিলা করা হবে।’
এ বিষয়ে জানতে চাইলে স্থায়ী কমিটির প্রবীণ এক সদস্য বলেন, ‘রাজনৈতিকভাবে খালেদা জিয়ার মামলার রায় মোকাবিলায় শক্তি ও সামর্থ্য যতটা আছে, তা দিয়ে আমরা মোকাবিলা করবো। কর্মসূচি আসবে।’
বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান অ্যাডভোকেট খন্দকার মাহবুব হোসেন বলেন, ‘মামলার যে পরিস্থিতি তাতে খালেদা জিয়ার সাজা হওয়ার প্রশ্নই আসে না। আর তার মতো জনপ্রিয় নেতাকে কারাগারে নিলে প্রস্তুতির দরকার হবে না। সারাদেশের জনগণ স্বতঃস্ফূর্তভাবে প্রতিক্রিয়া জানাবে। ম্যাডামের জনপ্রিয়তা দলমত নির্বিশেষে ছড়িয়ে পড়বে।’
বিএনপির নির্ভরযোগ্য সূত্রগুলো বলছে, খালেদা জিয়ার মামলা মোকাবিলায় স্বল্প মেয়াদে কিছুটা চাপ সইতে হবে দলটিকে। দীর্ঘমেয়াদে কোনও সমস্যা দেখছেন না বিএনপির নেতারা। এক্ষেত্রে খালেদা জিয়া জেলে থাকলে সরকারের ওপরই চাপ প্রয়োগ হবে বলে মনে করেন দলটির কয়েকজন নেতা। তবে বিএনপিকে রাজনৈতিক পরিপক্কতার পরিচয় দেওয়ার ওপর জোর দিয়েছেন তারা। বৃহস্পতিবার দুপুরে চেয়ারপারসনের মামলার রায়ের দিনক্ষণ ঘোষণা করার পর নিজের পূর্বঘোষিত শুক্রবারের (২৬ জানুয়ারি) প্রোগ্রাম বাতিল করেছেন মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। মুন্সিগঞ্জের লৌহজংয়ে সেক্টর কমান্ডার হামিদুল্লাহ খানের স্মরণ সভায় অংশ নেওয়ার কথা থাকলেও মির্জা ফখরুল তা বাতিল করেছেন। বিষয়টি জানান চেয়ারপারসনের মিডিয়া উইং কর্মকর্তা শায়রুল কবির খান।
দলের অন্য একটি সূত্রে জানা গেছে, দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনার বিষয়ে দলীয়ভাবে এখনও সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত হয়নি। চলতি মাসেই নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে বৈঠকের পর এ বিষয়টি ঠিক করা হবে। দলের কৌশল নির্ধারণ করার বিষয়ে স্থায়ী কমিটির একজন সদস্যের ভাষ্য— স্বল্প মেয়াদে হরতাল, বিক্ষোভ-সমাবেশের মতো কর্মসূচি দেওয়া হবে। আর দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা হিসেবে আইনি লড়াই ও সাধারণ মানুষের কাছে বিষয়টিকে তুলে ধরার চেষ্টা করবে বিএনপি।
স্থায়ী কমিটির সদস্য ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ যদিও এ নিয়ে মন্তব্য করতে রাজি হননি। তিনি বলেন, ‘আমাদের রাজনৈতিক কৌশল আমাদেরই থাকবে। এটা দেখতে পাবেন।’
এ বিষয়ে জানতে চাইলে বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান শামসুজ্জামান দুদু বলেন, ‘রায়ের দিনক্ষণ কেবল ঘোষণা হলো। পরবর্তী রাজনৈতিক পরিকল্পনা কী হবে, এটা দলীয় ফোরামে আলোচনার পর জানা যাবে। এখন পর্যন্ত আইনগত লড়াই চালিয়ে যাওয়ার বিষয়ে সিদ্ধান্ত আছে। পরবর্তী সিদ্ধান্ত নীতিনির্ধারণী ফোরামে আলোচনা হবে।’
বিএনপির সূত্র জানায়, খালেদা জিয়ার মামলার রায় অপ্রত্যাশিত হলে রাজপথে কর্মসূচি দেওয়া হবে। এক্ষেত্রে কর্মসূচি সহিংসতার দিকে যেতে পারে কিনা, এমন প্রশ্নের উত্তরে ‘সরকারের তরফে’ উস্কানি থাকার শঙ্কা করছেন বিএনপির স্থায়ী কমিটির একজন সদস্য। তিনি বলেন, ‘বিএনপি একটি গণতান্ত্রিক দল। সহিংসতার কোনও ইচ্ছা বা পরিকল্পনা নেই। এটা আওয়ামী লীগ করতে পারে।’
জানা গেছে, রায় অপ্রত্যাশিত হলে রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করবে বিএনপি। এক্ষেত্রে খালেদা জিয়াকে সুনির্দিষ্ট বাড়িতে রাখার প্রস্তাব করতে পারে দলটির আইনজীবীরা।
বৃহস্পতিবার দুপুরে বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রী যা চাইবেন, তাই হবে মামলার রায়।’
বিএনপির রাজনৈতিক শুভানুধ্যায়ীরা বলছেন, ৮ ফেব্রুয়ারি মামলার রায়কে সামনে রেখে খালেদা জিয়াকে এখনই পরবর্তী পরিকল্পনা করা প্রয়োজন। তার অনুপস্থিতিতে অন্তত পাঁচ জন সিনিয়র নেতার একটি কমিটি তৈরির কথাও পরামর্শ দিচ্ছেন তারা। যদিও বিএনপির গঠনতন্ত্রে এমন কোনও কমিটি গঠনের বাস্তবতা নেই।
এ বিষয়ে বিএনপির রাজনীতির পর্যবেক্ষক জাফরুল্লাহ চৌধুরী বলেন, ‘৮ তারিখ রায় দেবে। তার খালাস পাওয়ার সম্ভাবনা বেশি। কারণ, টাকা চুরির কোনও প্রমাণ মেলেনি। খালেদা জিয়া সিগনেটরিও না। সাজা দিলে গায়ের জোরে দেবে আরকি।’
খালেদা জিয়ার সাজা হলে বিএনপির করণীয় সম্পর্কে জাফরুল্লাহ চৌধুরী বলেন, ‘‘প্রস্তুতির কিছু নেই। তার সাজা হলে তিন বছর হবে, তার কম না। তাকে কোর্টে সারেন্ডার করতে হবে। জামিন চাইতে হবে। তবে দল কিভাবে পরিচালিত হবে, সেটা নির্ভর করছে খালেদা জিয়া কী চান। তিনি চান কিনা বিএনপি টিকে থাকুক। তিনি চাইলে কাল-পরশু পাঁচ জনের একটি কমিটি করবেন, যারা তার অবর্তমানে দল চালাবে। আর তিনি যদি না চান, ‘আমি নাই-তাহলে দল জাহান্নামে যাক।’ তাহলে দরকার নেই।’’
এদিকে, বিএনপির সমমনা অন্যান্য রাজনৈতিক দলগুলোও খালেদা জিয়ার মামলার রায়ের দিকে দৃষ্টি রেখেছেন। যদিও তারা এখনই কোনও মন্তব্য করতে রাজি নন। একাধিক রাজনীতিকের ভাষ্য— খালেদা জিয়ার মামলা ও রায় মোকাবিলায় তাদের নিজস্ব পরিকল্পনা কী হবে, এর ওপরে নির্ভর করছে অন্যান্য দলের অবস্থান। সেকারণে রায়ের আগে কেউ-ই মুখ খুলতে চাননি।
এ বিষয়ে সাবেক রাষ্ট্রপতি ও বিকল্প ধারা বাংলাদেশের সভাপতি অধ্যাপক একিউএম বদরুদ্দোজা চৌধুরী বলেন, ‘প্রথম কথা হলো, খালেদা জিয়ার মামলার রায় হবে। এটা সম্পূর্ণভাবে বিচারকদের এখতিয়ার। আমরা আশা করি, ন্যায় বিচার হবে। তবে আমার সন্দেহ, মূলত এই মামলা রাজনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে করা হয়েছে।’
সরকারের প্রভাবশালী একটি গোয়েন্দা সূত্র বলছে, সরকার খালেদা জিয়ার মামলাকে কেন্দ্র করে একাধিক বিকল্প কৌশল রেখে পরিকল্পনা করছে। তাকে গ্রেফতার করা হলে প্রথমত প্রতিক্রিয়া কেমন হয়, সেদিকে নজর রাখতে গোয়েন্দা সংস্থাগুলোকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। সূত্রটির দাবি, সরকার চাইছে, যেকোনও মূল্যে খালেদা জিয়াকে নির্বাচনের বাইরে রাখা। এক্ষেত্রে কোনও একটি দুর্নীতি মামলায় তার বিরুদ্ধে রায় আনার পক্ষে সরকার। তবে চূড়ান্ত কী হবে, এটি এখনও নিশ্চিত নয় গোয়েন্দা সূত্রটি। সূত্রের ভাষ্য, প্রধান বিচারপতি নিয়োগের বিষয়টি চূড়ান্ত হলেই খালেদা জিয়ার মামলায় রায়ের দিকে পূর্ণ নজর দেবে সংস্থাটি।
প্রসঙ্গত, বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে দায়ের করা জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট দুর্নীতির মামলার রায় আগামী ৮ ফেব্রুয়ারি ঘোষণা করবেন আদালত। বৃহস্পতিবার এ মামলার যুক্তিতর্ক উপস্থাপন শেষে বকশীবাজারের আলিয়া মাদ্রাসা মাঠে স্থাপিত ঢাকার বিশেষ জজ আদালত-৫ এর বিচারক ড.মো. আখতারুজ্জামান রায়ের এ দিন ধার্য করেন। একইসঙ্গে জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট মামলাটির যুক্তি উপস্থাপনের জন্য আদালত ৩০ ও ৩১ জানুয়ারি এবং ১ ফেব্রুয়ারি দিন ধার্য করেছেন। সূত্র : বাংলা ট্রিবিউন
এই রকম সংবাদ আরো পেতে হলে এই লেখার উপরে ক্লিক করে আমাদের ফেসবুক ফ্যান পেইজে লাইক দিয়ে সংযুক্ত থাকুন। সংবাদটি সম্পর্কে মন্তব্য করতে হলে এই পেইজের নীচে মন্তব্য করার জন্য ঘর পাবেন