৮ ফেব্রুয়ারি রায়: সকল প্রস্তুতি সেরে নিচ্ছেন খালেদা

বিএনপি চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে দুর্নীতি দমন কমিশনের করা জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলার রায়ের তারিখ ৮ ফেব্রুয়ারি। ২০০৮ সাল থেকে চলমান মামলার রায়ের তারিখ ঘোষণা করেন পুরান ঢাকার বকশিবাজার আলিয়া মাদ্রাসার মাঠে স্থাপিত বিশেষ জজ আদালত মোঃ আখতারুজ্জামান।

মামলার রায়ের তারিখ ঘোষণার পর থেকে বিএনপিতে বিরাজ করছে আতংক, শংকা, সন্দেহ, উদ্বেগ। একই সঙ্গে দলটির নেতাকর্মীদের মধ্যে বিরাজ করছে ক্ষোভ। দিচ্ছেন হুমকি-ধামকি। এসব হুমকি-ধামকি আর ক্ষোভকে রাজপথে পুঁজি করে গড়ে তুলতে চায় তীব্র আন্দোলন। পতন চায় বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকারের।

বিএনপি নেতারা হুমকি দিয়ে বলছেন, ৮ ফেব্রুয়ারির রায়ের ওপর নির্ভর করছে অনেক কিছু। যদি বেগম খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে নেতিবাচক কোন রায় আসে তাহলে আওয়ামী লীগ সরকারের পতন রচিত হবে। যে তীব্র আন্দোলন গড়ে উঠবে তা প্রতিরোধ করার শক্তি এই সরকারের নেই।

রায়ের তারিখ ঘোষণাকে কেন্দ্র করে বিএনপি নেতাকর্মীরা আগের তুলনায় সক্রিয় হয়ে উঠেছেন। অলস নেতাকর্মীদের অনেকে মাঠে নামার প্রস্তুতি নিচ্ছেন। স্থবির দলে চাঙ্গা অবস্থা দেখা যাচ্ছে। খালেদা জিয়ার রায় ঘোষণা করা হবে একথা শুনার পর থেকে দলটির নিয়মিত বৈঠক, সভাও বৃদ্ধি পেয়েছে। কেন্দ্রীয় নেতারা কর্মীদের সাহস যুগিয়ে আন্দোলন উপযোগী গড়ে তোলার চেষ্টা করছেন।

রায়ের তারিখ ঘোষণার পরপরই দলের সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারণী ফোরাম স্থায়ীয় কমিটির জরুরি বৈঠক ডাকেন বেগম খালেদা জিয়া। ২৭ জানুয়ারি শনিবার রাত সাড়ে ৯টায় গুলশানে বিএনপি চেয়ারাপর্সন কার্যালয়ে এ বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। স্থায়ী কমিটির এ বৈঠকে খালেদা জিয়ার মামলা ও পরবর্তী করণীয় নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা হয়। এসময় খালেদা জিয়াকে জেলে পাঠানো হলে কঠোর আন্দোলনে নামার পাশাপাশি তাকে ছাড়া একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে না যাওয়ার পক্ষে সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। আর আন্দোলনে সারাদেশের সর্বস্তরের নেতাকর্মীকে সম্পৃক্ত করার লক্ষ্যে রায় ঘোষণার আগেই খালেদা জিয়া জোটের শীর্ষ নেতাদের সঙ্গে মতবিনিময়ের পাশাপাশি বিএনপি ও এর বিভিন্ন অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনের নেতাদের সঙ্গে বৈঠক করার সিদ্ধান্ত নেন।

সিদ্ধান্ত মোতাবেক পরদিনই ২০ দলের শীর্ষ নেতাদের সঙ্গে বৈঠকে করেন বিএনপি চেয়ারপার্সন। রোববার বৈঠকটি চেয়ারপার্সনের গুলশান কার্যালয়ে রাত ৯ টা ১০মিনিটে শুরু হয়ে শেষ হয় রাত পৌনে ১১টায়।

বৈঠকে বেগম খালেদা জিয়া সবাইকে আশ্বস্ত করে বলেন, এর আগেও তিনি জেলে গিয়েছেন। তাই এটা নিয়ে চিন্তার কিছু নেই। পরিবেশ ও পরিস্থিতি বুঝে কর্মসূচি ঘোষণা করার প্রতি ইঙ্গিত দিয়ে সবাইকে ঐক্যবদ্ধ থাকার পরামর্শ দেন খালেদা জিয়া।

অতীতের মতো সংকটকালীন ও দুঃসময়ে খালেদা জিয়ার পাশে থাকার আশ্বাস দেন বৈঠকে অংশ নেয়া জোটের শীর্ষ নেতারা। এছাড়া খালেদা জিয়াকে ছাড়া আগামী নির্বাচনে অংশগ্রহণ না করার প্রত্যয়ও বৈঠকে ব্যক্ত করেন তারা।

রায় ঘোষণাকে সামনে রেখে বিভিন্ন দেশের কূটনৈতিকদের সঙ্গে বৈঠকও করেছেন খালেদা জিয়া। গত মঙ্গলবার সন্ধ্যায় ঢাকায় নিযুক্ত বিভিন্ন দেশের কূটনৈতিকদের সঙ্গে বৈঠকটি অনুষ্ঠিত হয় গুলশানের রাজনৈতিক কার্যালয়ে।

বৈঠকে ভারত, পাকিস্তান, চীন, জাপান, জার্মানি, কুয়েত, স্পেন, সৌদি আরব, ইটালি, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, ব্রিটিশ, ভ্যাটিক্যান সিটি, ডেনমার্ক, কানাডা, নেপাল, অস্ট্রেলিয়া, মরক্কো ও লেদারল্যান্ডস’র কূটনৈতিকরা উপস্থিত ছিলেন। এছাড়া ইউএসএআইডি’র (আন্তর্জাতিক সংস্থা) প্রতিনিধিরাও বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন। বৈঠকে খালেদা জিয়ার মামলা রায়, বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনা হয় বলে নির্ভরযোগ্য সূত্রে জানা যায়।

ইতোমধ্যে বিএনপির নির্বাহী কমিটির সভা ডেকেছেন বেগম খালেদা জিয়া। আগামীকাল শনিবার সকাল ১০টা থেকে বিকাল ৫টা পর্যন্ত ঢাকার লা মেরিডিয়ান হোটেলে এ সভা অনুষ্ঠিত হবে। বৃহস্পতিবার রাজধানীর নয়াপল্টনে কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে সংবাদ সম্মেলনে দলের সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী এ তথ্য নিশ্চিত করেন। বিএনপির নির্বাহী কমিটির এ সভায় সভাপতিত্ব করবেন বেগম খালেদা জিয়া।

এসব প্রস্তুতির আড়ালে একপ্রকার অগোচরেই আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ সেরে রেখেছে বিএনপি। দলের সংশোধিত গঠনতন্ত্র গত রোববার নির্বাচন কমিশনে জমা দিয়েছেন দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য নজরুল ইসলাম খান ও সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী আহমেদ।

তড়িঘড়ি করে এই কাজ কেন করা হলো জানতে চাইলে নজরুল ইসলাম খান বলেন, ২০১৬ সালের ১৯ মার্চ বিএনপির ষষ্ঠ জাতীয় সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। সম্মেলনে গঠনতন্ত্রে কিছু সংশোধনী প্রস্তাব পাস হয়। তবে এতো দিন দলটি সেটা নির্বাচন কমিশনে জমা দেয়নি।

বিএনপির গঠনতন্ত্রে ৭ ধারায় ‘কমিটির সদস্যপদের অযোগ্যতা’ শিরোনামে বলা আছে, ‘নিম্নোক্ত ব্যক্তিগণ জাতীয় কাউন্সিল, জাতীয় নির্বাহী কমিটি, জাতীয় স্থায়ী কমিটি বা যেকোনো পর্যায়ের যেকোনো নির্বাহী কমিটির সদস্যপদের কিংবা জাতীয় সংসদ নির্বাচনে দলের প্রার্থীতা অযোগ্য বলে বিবেচিত হবেন। তারা হলেন :(ক) ১৯৭২ সালের রাষ্ট্রপতির আদেশ নম্বর ৮-এর বলে দণ্ডিত ব্যক্তি, (খ) দেউলিয়া, (গ) উন্মাদ বলে প্রমাণিত ব্যক্তি, (ঘ) সমাজে দুর্নীতিপরায়ণ বা কুখ্যাত বলে পরিচিত ব্যক্তি।’

এই ধারার ‘ঘ’তে বলা ছিল, ‘সমাজে দুর্নীতিপরায়ণ বা কুখ্যাত বলে পরিচিত ব্যক্তি’ বিএনপির কোনো পর্যায়ের কমিটির সদস্য কিংবা জাতীয় সংসদ নির্বাচনে দলের প্রার্থী পদের অযোগ্য বলে বিবেচিত হবেন।

রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের ধারণা, খালেদা জিয়ার ৮ ফেব্রুয়ারির রায়ে সাজা হলে সরকার দল ভাঙার হাতিয়ার হিসেবে এ সুযোগ ব্যবহার করতে পারে- এ আশঙ্কায় গঠনতন্ত্রের ওই ধারা বাদ দিয়েছেন বিএনপি চেয়ারপার্সন।

৮ ফেব্রুয়ারি জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলার রায়ের আগে কি তবে বিএনপি চেয়াপার্সন জেলে যাওয়ার সকল প্রস্তুতি সেরে নিচ্ছেন? এমন প্রশ্নে বিএনপিপন্থী এক জ্যেষ্ঠ আইনজীবী নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, জিয়া অরফানেজ মামলাটি শুরুতেই খারিজ হওয়ার কথা। কিন্তু তা হয়নি। ৮ ফেব্রুয়ারি ন্যায়বিচার হলে জিয়া অরফানেজ মামলায় বেগম খালেদা জিয়া সম্মানজনক খালাস পাবেন। কিন্তু বর্তমান সরকার বিএনপি চেয়ারপার্সনকে নির্বাচন থেকে দূরে রাখতে চায়। সরকারের উদ্দেশ্য খারাপ। তাই আদালতের ওপর চাপ প্রয়োগ করে সরকার বিএনপি চেয়ারপার্সনের সাজার পটভূমি তৈরি করেছে।

জিয়া অরফানেজ ট্রাস্টের দুই কোটি ১০ লাখ ৭১ হাজার ৬৪৩ টাকা আত্মসাতের অভিযোগ এনে খালেদা জিয়া ও তারেক রহমানসহ ছয়জনের বিরুদ্ধে ২০০৮ সালের ৩ জুলাই রমনা থানায় মামলা করে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। ২০১৪ সালের ১৯ মার্চ খালেদা জিয়াসহ ছয়জনের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করেন ঢাকার তৃতীয় বিশেষ জজ আদালতের বিচারক বাসুদেব রায়। এরপর থেকে এই মামলার অনেক কার্যক্রম চলেছে।

মামলার শেষের দিকে বিএনপি চেয়ারপার্সন আত্মপক্ষ সমর্থন করে বক্তব্য দেন। আদালতে দেয়া বক্তব্যে তিনি নিজেকে সম্পূর্ণ নির্দোষ দাবি করে বলেন, প্রধানমন্ত্রী হিসেবে এবং ব্যক্তিগত কোনো উপায়ে, কোনো রকম দুর্নীতি করিনি। এ মামলার সকল সাক্ষ্য ভিত্তিহীন, তদন্ত কর্মকর্তা সরকারের আজ্ঞাবহ হয়ে ব্যক্তিগত আক্রোশের বহিঃপ্রকাশ হিসেবে তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করেছেন, যার কোন দালিলিক প্রমাণ নেই, যা মিথ্যা ও ভিত্তিহীন। রাজনৈতিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করার উদ্দেশ্যে মিথ্যা উক্তি উল্লেখ করেছেন এবং জবানবন্দি দিয়েছেন। তার মিথ্যা তদন্তের সূত্র ধরেই আমার বিরুদ্ধে জনসমক্ষে মিথ্যা প্রচারণা চালিয়ে আমার সম্মান ক্ষুণ্ন করে চলেছে সরকার।