আল মাহমুদের ‘জীবন যখন বাঁক ঘোরে’ : আবেগ ও নারীত্বে নিমজ্জন

ডক্টর ফজলুল হক তুহিন : আল মাহমুদের নতুন লেখা মানেই নতুন স্বাদে-গন্ধে সমৃদ্ধ কোন নির্মাণ। কবিতা, কথাসাহিত্য বা অন্য যে কোন লেখার ক্ষেত্রেই একথা সত্য। আশি বছর পেরিয়ে আল মাহমুদ এখনো সৃজনে সক্রিয়। বাংলা সাহিত্যের জন্য তা সুখবর বৈকি। জীবনের এই পড়ন্ত বেলায় এসে কবি লিখেছেন ‘জীবন যখন বাঁক ঘোরে’। আত্মজৈবনিক একটি উপন্যাস। শৈশব-কৈশোর-তারুণ্যের সূচনা-জীবন নিয়ে অসামান্য উপন্যাস ‘যেভাবে বেড়ে উঠি’ ও পরিণত বয়সের স্মৃতিলেখ্য ‘বিচূর্ণ আয়নায় কবির মুখ’-এর মধ্যবর্তী জীবনের বাঁক এই গ্রন্থটি।

কবির জীবনে বিবাহের পর একজন নারীর আগমনে যে ব্যাপক আলোড়ন, পরিবর্তন ও বাঁক ঘুরে যাওয়া তারই কাব্যময় শিল্পবিন্যাস এই উপন্যাস। বিয়ে করার পরে নৌকায় বাড়িফেরা, বাসরযাপন, দাম্পত্যজীবনের সূচনা এবং কবির পুলকিত, উদ্বেলিত ও উত্তেজিত মনোভাব এখানে বাক্সময়। অনার্য বাঙালি নারীর নানা মাত্রিক বৈশিষ্ট্য ও বিশ্লেষণ এই আখ্যানে চিত্রকল্পময় হয়ে উঠেছে। স্বল্প আয়োতনের এ-লেখায় রোমান্টিক মনের উষ্ণতা, প্রথম নারী সম্ভোগের সুখানুভূতি, জৈবিক আস্বাদের দ্বিধা থরথর আনন্দ-শিহরণ, প্রেম ও ভালোবাসায় অবগাহন, সহধর্মীনীর অনুভব-উপলব্ধি-অভিব্যক্তি, বউ-রমণী ও রন্ধনশৈলীর নিজস্ব ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ এবং পরিশেষে উত্তর প্রজন্মের আগমনের সুসংবাদে খুশির জোয়ারে ভেসে কবি জীবনের নতুন বাঁককে বিশেষত্ব দান করেছেন। এখানে আবহমান বাঙালি সংস্কৃতি, স্থানিক পরিবেশ, পারিবারিক আবহে নব দাম্পত্য জীবনের সুখযাপনকে কবি অনেকটা মহিমা দেবার চেষ্টা করেছেন। কবির জীবনে একজন নারী যে বিশাল একটি ঘটনা এ আখ্যানে সেটা সহজে লক্ষণীয়। সংলাপ ও বর্ণনার ব্যঞ্জনায় কবির মনোভাব প্রকাশিত_
আমি বললাম, খুশিতেও একটা ক্লান্তি আছে কিন্তু তোমার দিকে চেয়ে থাকতে এতই ভালো লাগছে যে আমি চোখ ফেরাতে একবারেই রাজি নই।
আমার বউ হেসে বললো, আমার কোলে মাথা রাখলে আমি তোমাকে ঘুম পাড়িয়ে দিতে পারি। আমি তাড়াতাড়ি বললাম, এই সুযোগ আমি ছাড়তে পারি না।
বলেই আমি বউয়ের কোলের ওপর মাথাটা বিছিয়ে দিয়ে তার শাড়ির গন্ধ নাকে টানতে গিয়ে বললাম, ওগো শাড়ির গন্ধ নয়, নারীর গন্ধ পাচ্ছি।
অথবা
বউ হলো এমন একটা শব্দ যার সাথে অনুচ্চারিতভাবে গোপন হয়ে আছে শোও সজ্জা গ্রহণ করো। আমি নিজ হাতে তোমাকে অনাবৃত করবো, দেখবো, শুঁকবো, চুম্বন এবং লেহন করবো। যদিও তুমি ভীতা ত্রস্তা কিন্তু আমার আকাক্সক্ষায় অগ্নি প্রজ্জ্বালনকারিণী। এভাবেই মানুষের সংসার সম্ভবত শুরু হয়। আমারও সংসার অকস্মাৎ এভাবেই শুরু হয়ে গেলো।

সংসার জীবনের সূচনায় কবির কল্পনা, সৃজন, মনন ও স্বপ্নের ডানা মেলেছে বিস্তৃতভাবে। কবি আবেগে উদ্বেলিত হয়ে বারবার নিমজ্জিত হয়েছেন স্ত্রীর শরীর ও মনে। এই উপন্যাসে প্রধান চরিত্র কবি ও কবির পত্নী। পার্শ্বচরিত্রগুলো উল্লেখযোগ্য নয়। প্রধান দুটি চরিত্রের ঘটনা পরম্পরায় আখ্যান নির্মিত হয়েছে। আকর্ষণীয় ও উপযুক্ত সংলাপে চরিত্রের প্রকৃতি প্রকাশিত। কখনো বর্ণনা, কখনো স্বগতোক্তি, কখনো সংলাপ মিলে পাঠে একটা টান ও আগ্রহ বোধ করবে পাঠক। পাঠান্তে পাঠক বুঝতে পারবে কবির জীবনে সত্যিই বাঁকবদল ঘটেছে।

বিরাশি বছর বয়সে ডিকটেশন দিয়ে এমন একটি আত্মজৈবনিক রচনার সৃষ্টি আল মাহমুদের সাহিত্যে বিশেষ সংযোজন নিশ্চয়। বিখ্যাত নাসির আলী মামুনের তোলা আলোকচিত্রে প্রচ্ছদ বেশ তাৎপর্যবহ। বইঘর ও লিটলম্যাগ-লাটাই পরিবেশিত, ‘সরল রেখা’ প্রকাশনীর বইটির মূল্য: ২০০ টাকা। গ্রন্থটির বহুল প্রচার কামনা করছি।