কেন বৈশাখী ভাতা পাচ্ছেন না বেসরকারি শিক্ষক-কর্মচারী
বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষকদের ভাতা দেয়ার জন্য রোববার শিক্ষা এবং অর্থ মন্ত্রণালয়ের মধ্যে বৈঠক হলেও সুরাহা হয়নি। এ কারণে সরকারি শিক্ষকরা পেলেও বৈশাখী ভাতা পাচ্ছেন না বেসরকারি শিক্ষক-কর্মচারীরা। এ নিয়ে বেসরকারি শিক্ষকদের মধ্যে দেখা দিয়েছে তীব্র অসন্তোষ।
বাংলা নববর্ষ উদযাপনে সরকারি চাকরিজীবীসহ সরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষক-কর্মচারীরা মূল বেতনের ২০ শতাংশ হারে এই ভাতা পাবেন। বহু বেসরকারি প্রতিষ্ঠানেও এই ভাতা চালু রয়েছে। কিন্তু বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের প্রায় ৫ লাখ শিক্ষক-কর্মচারী এই ভাতা পাওয়া থেকে বঞ্চিত।
সংশ্লিষ্টরা বলেছেন, বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে এমপিওভুক্ত শিক্ষক-কর্মচারীর সংখ্যা ৫ লাখ ১৬ হাজার ৭৬৩। এই শিক্ষকদের জন্য সরকার এমপিও (মানি পে-অর্ডার) খাতে বছরে খরচ করে ১৩ হাজার কোটি টাকা। প্রতি মাসে এমপিও খাতে ব্যয় হয় ১ হাজার ৮৩ কোটি টাকা। মাসিক বেতনের ২০ শতাংশ হিসেবে শিক্ষক-কর্মচারীদের বৈশাখী ভাতা দিতে হবে ২১৬ কোটি টাকা। কিন্তু শিক্ষকদের এই টাকা দিতে হচ্ছে না অর্থ মন্ত্রণালয়কে। কারণ, গতবছর কল্যাণ এবং অবসর বোর্ডের অনিষ্পন্ন ৬৮ হাজার শিক্ষকের আবেদন নিষ্পত্তির জন্য কল্যাণ এবং অবসর ভাতার ২ ও ৪ শতাংশ চাঁদা বাড়ানোর গেজেট প্রকাশকে কেন্দ্র করে শিক্ষক নেতারা সরকারকে দেওয়া কথা রাখেননি। এরপর থেকেই বেসরকারি শিক্ষকরা সরকারের কাছ থেকে কোনো সুবিধা পাচ্ছেন না। মূলত বৈশাখী ভাতা বঞ্চিত হওয়ার পেছনে শিক্ষকরাই দায়ী।
শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের সচিব মো. সোহরাব হোসাইন বলেন, বৈশাখী ভাতা ও পাঁচ শতাংশ ইনক্রিমেন্ট নিয়ে আমরা সবার সঙ্গে দফায় দফায় বৈঠক করেছি। সবাই ইতিবাচক। তবে বাজেটে বরাদ্দ পাওয়ার ওপর এর বাস্তবায়ন নির্ভর করবে। আমাদের দিক থেকে চেষ্টার ত্রুটি নেই। শিক্ষা মন্ত্রণালয় প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। তবে বাজেটের বাইরে তো টাকা দেয়া সম্ভব নয়।
এ নিয়ে স্বাধীনতা শিক্ষক কর্মচারী ফেডারেশনের প্রধান সমন্বয়কারী অধ্যক্ষ মো. শাহজাহান আলম সাজু বলেন, প্রধানমন্ত্রীর উদ্যোগে বৈশাখী ভাতা চালু হয়েছে। এই ভাতার মাধ্যমে আরো বর্ণিল হয় নববর্ষ উৎসব। কিন্তু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে যারা উৎসব করবে দুর্ভাগ্যজনকভাবে তারা এই ভাতা থেকে বঞ্চিত। আমলাতান্ত্রিক জটিলতার জন্যই শিক্ষকরা ভাতা থেকে বঞ্চিত বলে তিনি জানান।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ২০১৫ সালে অষ্টম জাতীয় বেতন স্কেলে শিক্ষক-কর্মচারীদের বেতন ১০০ শতাংশ বাড়ায় নতুন স্কেলে কল্যাণ ও অবসরের সুবিধা প্রদান প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়ে। সঙ্কট মোকাবেলার জন্য শিক্ষামন্ত্রী ও শিক্ষা সচিব অর্থ মন্ত্রণালয় থেকে এই খাতে অর্থ বরাদ্দ আনেন। এরপরে কল্যাণ ও অবসর বোর্ডের সভায় বোর্ডের সভাপতি শিক্ষা সচিব নিজেই চাঁদা বাড়ানোর বিষয়টি উত্থাপন করেন এবং উপস্থিত বোর্ডের সব সদস্য তাতে একমত পোষণ করেন। অর্থ মন্ত্রণালয় থেকে গত অর্থবছরে শিক্ষক-কর্মচারীদের চাঁদা বাড়ানোর শর্তে এই খাতে ৬৫০ কোটি এবং বর্তমান অর্থবছরে ২০০ কোটি টাকা বরাদ্দ দেয়া হয়। এর পাশাপাশি অর্থ মন্ত্রণালয় থেকে লিখিতভাবে জানানো হয়, চাঁদা বাড়ানোর গেজেট প্রকাশ ছাড়া অর্থ ছাড় করা হবে না। এমতাবস্থায় শিক্ষা মন্ত্রণালয় গেজেট প্রকাশ করার পর যেসব শিক্ষক সংগঠন বোর্ডসভায় চাঁদা বাড়ানোর সিদ্ধান্তে একমত হয়েছিলেন, তাদের কেউ কেউ এর বিরোধিতা করেন এবং আন্দোলনের কর্মসূচি ঘোষণা করতে দেখা যায়। শিক্ষক নেতাদের এই দ্বিমুখী আচরণে শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও অর্থ মন্ত্রণালয় বিব্রত হয় এবং একপর্যায়ে গেজেট স্থগিত করে।
কল্যাণ সুবিধার জন্য শিক্ষকদের বেতন থেকে ২ শতাংশের পরিবর্তে ৪ শতাংশ এবং অবসর সুবিধা বোর্ডে ৪ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ৬ শতাংশ টাকা চাঁদার জন্য নির্ধারিত হয়েছিল। কিন্তু বৈঠকে শিক্ষক নেতৃবৃন্দ চাঁদা বাড়ানোর বিষয়টি মেনে আসলেও পরে তা অস্বীকার করেন। চাঁদা বাড়ানোর বিষয়কে কেন্দ্র করে গোটা শিক্ষক সমাজ ক্ষোভে ফেটে পড়েন। শুরু হয় তীব্র আন্দোলন। শিক্ষকদের আন্দোলনের মুখে সরকার চাঁদা বাড়ানোর সিদ্ধান্ত স্থগিত করে। একই সঙ্গে অবসর এবং কল্যাণ সুবিধার জন্য অর্থ মন্ত্রণালয়ের দেওয়া বরাদ্দও স্থগিত হয়ে পড়ে। শিক্ষকদের এমন কর্মকাণ্ডে সরকার ক্ষুব্ধ। আর এর প্রভাব পড়েছে বৈশাখী ভাতা ও অন্যান্য ভাতার ওপর।
সংশ্লিষ্টরা বলেছেন, চাঁদা বাড়ানোর বিষয়টি যদি ভুল সিদ্ধান্ত হয়ে থাকে, তাহলে বিকল্প পন্থা বের করা যেত। তা না করে শিক্ষক নেতারা একে অপরের বিরুদ্ধে অভিযোগ করতে থাকেন। এ সুযোগে শিক্ষক নামধারী একটি মহল সরকারের বিরুদ্ধে শিক্ষকদের ক্ষেপিয়ে তুলে রাজনৈতিক ফায়দা হাসিলের চেষ্টা করে। আর সরকারও বিষয়টি বুঝতে পারে। এর ফলে শিক্ষকদের কোনো দাবিই পূরণ হচ্ছে না।
জানতে চাইলে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক শিক্ষক সংগঠনের এক নেতা বলেন, শিক্ষক নেতাদের এমন আচরণে কর্তৃপক্ষ অপমান বোধ করেছে। মূলত শিক্ষক নেতাদের হঠকারিতার কারণেই শিক্ষকরা আজ বৈশাখী ভাতা থেকে বঞ্চিত।
২০১৫ সালে অষ্টম জাতীয় বেতন স্কেল কার্যকর করে সরকার। ওই বেতন স্কেল কার্যকর-সংক্রান্ত প্রজ্ঞাপনে প্রতিবছর পাঁচ শতাংশ হারে স্বয়ংক্রিয়ভাবে ইনক্রিমেন্ট বেতনের সঙ্গে যোগ করার কথা বলা হয়। ওই বেতন স্কেল কার্যকরের পর থেকে সরকারি স্কুল, কলেজ ও মাদরাসা শিক্ষকরা এই সুবিধা পাচ্ছেন। কিন্তু বেসরকারি স্কুল, কলেজ ও মাদরাসার শিক্ষকরা বৈশাখী ভাতা ও পাঁচ শতাংশ ইনক্রিমেন্ট পাচ্ছেন না। মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে পাঁচ শতাংশ ইনক্রিমেন্ট যোগ করার জন্য কোনো উদ্যোগ না নেয়ায় প্রধানমন্ত্রীর দৃষ্টি ফেরাতে বাধ্য হয়ে জাতীয়করণের একদফা দাবিতে কঠোর কর্মসূচি দিতে বাধ্য হন শিক্ষকরা। এ বছরের ১০ জানুয়ারি থেকে দাবি আদায়ে অবস্থান কর্মসূচির পর ১৫ জানুয়ারি আমরণ অনশন শুরু করেন বেসরকারি শিক্ষকরা। পাশাপাশি গত ২৯ জানুয়ারি থেকে সারা দেশে সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে লাগাতার ধর্মঘটের ডাক দেন শিক্ষক নেতারা। ওইদিন সন্ধ্যায় শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের কারিগরি ও মাদরাসা বিভাগের সচিব মো. আলমগীর এবং মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের ওই সময়ে রুটিন দায়িত্বপ্রাপ্ত সচিব মহীউদ্দীন খান শিক্ষকদের অনশন ভাঙান। তারা প্রধানমন্ত্রীর আশ্বাসের কথা জানালে শিক্ষকরা আন্দোলন কর্মসূচি প্রত্যাহার করে নেন।
এই রকম সংবাদ আরো পেতে হলে এই লেখার উপরে ক্লিক করে আমাদের ফেসবুক ফ্যান পেইজে লাইক দিয়ে সংযুক্ত থাকুন। সংবাদটি সম্পর্কে মন্তব্য করতে হলে এই পেইজের নীচে মন্তব্য করার জন্য ঘর পাবেন