ভাসমান এলএনজি টার্মিনাল দেশে পৌঁছবে ২৩ এপ্রিল
জাতীয় গ্রিডে তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি) যুক্ত করার জন্য প্রস্তুত বাংলাদেশ। আগামী মাসের প্রথম সপ্তাহে উদযাপন করা হবে সেই ঐতিহাসিক মাহেন্দ্রক্ষণ।
প্রথম দফায় যুক্ত হবে ৫০০ মিলিয়ন ঘনফুট এলএনজি। এজন্য মহেশখালীর টার্মিনাল থেকে চট্টগ্রাম পর্যন্ত পাইপলাইন নির্মাণের কাজ প্রায় চূড়ান্ত পর্যায়ে রয়েছে। এক্সিলারেটর এনার্জি বাংলাদেশ লিমিটেডের (ইইবিএল) মাধ্যমে বাস্তবায়িত ভাসমান টার্মিনাল থেকে এই গ্যাস গরম করে প্রাকৃতিক গ্যাসে রূপান্তরিত করে জাতীয় গ্রিডে যুক্ত করা হবে।
আগামী ২৩ এপ্রিল ভাসমান এলএনজি টার্মিনালটি বাংলাদেশে এসে পৌঁছবে। যুক্তরাষ্ট্রের শীর্ষ কোম্পানি এক্সিলারেট এনার্জি এই ভাসমান টার্মিনালটি স্থাপন করবে কক্সবাজারের মহেশখালীতে।
এলএনজি আমদানির জন্য ইতিমধ্যে কাতারের সঙ্গে চুক্তি সম্পূর্ণ হয়েছে। এছাড়া ওমান, মালয়েশিয়া ও ইন্দোনেশিয়ার সঙ্গেও জি-টু-জি ভিত্তিতে এবং স্পট মার্কেট থেকে এলএনজি ক্রয়ের পরিকল্পনা রয়েছে।
এক্সিলারেট এনার্জি ছাড়াও দেশীয় কোম্পানি সামিট এলএনজি টার্মিনাল কোম্পানি প্রাইভেট লিমিটেডের মাধ্যমে চলতি বছরের মধ্যে আরও ৫০০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস যুক্ত হবে জাতীয় গ্রিডে।
এছাড়া কুতুবদিয়া ও পায়রাতে আরও এক বা একাধিক স্থলভিত্তিক এলএনজি টার্মিনাল স্থাপনের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে বলে জানায় জ্বালানি ও খনিজসম্পদ বিভাগের সংশ্লিষ্ট সূত্র।
জ্বালানি ও খনিজসম্পদ বিভাগের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেন, জাতীয় গ্রিডে এলএনজি যুক্ত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে পেট্রোবাংলার আওতাধীন গ্যাস বিতরণ কোম্পানির মধ্যে তিতাস, কর্ণফুলী, বাখরাবাদ গ্যাস বিতরণ কোম্পানির ২৩৯০টি নতুন শিল্প-কারখানায় নতুন গ্যাস সংযোগ দেয়া হবে। সরকার ধাপে ধাপে মে মাস থেকে অক্টোবর মাসের মধ্যে অনুমোদিত এই ২৩৯০টি শিল্প-কারখানায় নতুন করে গ্যাস সংযোগ দেবে।
ওই কর্মকর্তা আরও বলেন, এই মুহূর্তে দেশীয় প্রাকৃতিক গ্যাসের উৎপাদন ও আমদানিকৃত এলএনজি দিয়ে প্রাথমিকভাবে শিল্প প্রতিষ্ঠানে গ্যাস সংযোগ করা হবে। ২০১৮ সালের চাহিদা মোতাবেক গ্যাস সরবরাহ করা সম্ভব হলে দেশে প্রায় ১০ লাখ লোকের কর্মসংস্থান হবে এবং জিডিপি বৃদ্ধিতে সরাসরি ভূমিকা রাখবে। পাশাপাশি সরকার ঘোষিত রূপকল্প ২০২১ বাস্তবায়ন এবং মধ্যম আয়ের দেশ হিসেবে বাংলাদেশের অগ্রযাত্রায় দেশের শিল্পায়ন ও বিদ্যুৎ উৎপাদনসহ সব ক্ষেত্রে এ গ্যাস সরবরাহ নতুন মাত্রা যোগ করবে।
জ্বালানি বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, আমদানিকৃত এলএনজির প্রথম চালান দেশে আসবে আগামী এপ্রিলে। এ ধাপে ৫০ কোটি ঘনফুট এলএনজি আনা হবে। এছাড়া কক্সবাজারের মহেশখালীতে ৫০০ এমএমসিএফডি ধারণক্ষমতার দুটি ভাসমান এলএনজি টার্মিনাল বা ফ্লোটিং স্টোরেজ রি-গ্যাসিফিকেশন ইউনিট (এফএসআরইউ) স্থাপন করা হচ্ছে। এর একটি স্থাপন করবে এক্সিলারেট এনার্জি বাংলাদেশ লিমিটেড (ইইবিএল) ও অন্যটি সামিট এলএনজি টার্মিনাল কোম্পানি (প্রাইভেট)। টার্মিনাল স্থাপন ও ব্যবহার নিয়ে এরই মধ্যে প্রতিষ্ঠান দুটির সঙ্গে আলাদা চুক্তি করেছে পেট্রোবাংলার। এছাড়া এলএনজি আমদানিতে কাতারের রাশগ্যাস কোম্পানি এবং সরবরাহ নিরবচ্ছিন্ন রাখতে সুইজারল্যান্ডের সঙ্গে চুক্তি করা হয়েছে।
পেট্রোবাংলার একজন কর্মকর্তা বলেন, এলএনজি আমদানি ও টার্মিনাল স্থাপনে জ্বালানি নিরাপত্তা তহবিল থেকে অর্থসংস্থানে অনুমোদন দেয়া হয়েছে। টার্মিনাল স্থাপনের কাজও এগিয়ে চলেছে। আগামী মাসের প্রথম সপ্তাহ থেকে জাতীয় গ্রিডে এলএনজি থেকে গ্যাস সরবরাহ করা সম্ভব হবে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করেন তিনি।
জানা গেছে, জ্বালানি নিরাপত্তা তহবিল থেকে এলএনজির অর্থায়নে গত বছরের নভেম্বরে বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশনের (বিইআরসি) কাছে অনুরোধ করে জ্বালানি ও খনিজসম্পদ বিভাগ। পরবর্তীকালে পেট্রোবাংলা কমিশনের কাছে এ বিষয়ে আবেদন করে। প্রতিষ্ঠানটির আবেদনে বলা হয়, এলএনজি ক্রয়, এফএসআরইউ পরিচালনা ও টার্মিনাল চার্জ বাবদ চলতি বছরের অক্টোবর পর্যন্ত ৮৪ কোটি ৪২ লাখ ডলার বা প্রায় ৬ হাজার ৯২২ কোটি টাকা (১ ডলার=৮২ টাকা হিসেবে) প্রয়োজন হবে। রি-ভলভিং ফান্ড হিসেবে এ অর্থসংস্থানে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে কমিশনের কাছে আবেদন করে প্রতিষ্ঠানটি।
চলতি বছরের মে থেকে ইইবিএলের টার্মিনাল থেকে সর্বোচ্চ ৩ দশমিক ৭৫ এমটিপিএ এলএনজি আমদানি করে রি-গ্যাসিফিকেশনের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে। আর সামিটের টার্মিনাল থেকে চলতি বছর শেষে ৩ দশমিক ৭৫ এমটিপিএ এলএনজি রি-গ্যাসিফিকেশন করা সম্ভব হবে। অর্থাৎ আগামী বছর নাগাদ এ দুটি টার্মিনাল থেকে সাড়ে ৭ এমটিপিএ এলএনজি আমদানি করে তা রি-গ্যাসিফিকেশনের লক্ষ্যমাত্রা রয়েছে।
পেট্রোবাংলা সূত্রে জানা গেছে, এলএনজি আমদানি ও রি-গ্যাসিফিকেশনের জন্য রি-ভলভিং ফান্ড হিসেবে ৮৪ কোটি ৪২ লাখ ডলার প্রয়োজন হবে। এর মধ্যে এলএনজির এলসিতে ৩ কোটি ডলার, ল্যাটেন্ট হিট ক্যাপচার সিস্টেমের (এলএইচসিএস) জন্য ১ কোটি ৪২ লাখ ডলার এবং এলএনজি আমদানি ও পরিচালনার জন্য রি-ভলভিং ফান্ড হিসেবে এসবিএলসিসহ প্রয়োজন হবে আরও ৮০ কোটি ডলার।
বিইআরসি (বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন) সূত্রে জানা গেছে, ভবিষ্যতের জ্বালানি নিরাপত্তায় ২০১৫ সালে গঠন করা হয় জ্বালানি নিরাপত্তা তহবিল। এখন পর্যন্ত এ তহবিলে জমা হয়েছে সাড়ে ৫ হাজার কোটি টাকার বেশি। এটি একটি রি-ভলভিং ফান্ড হিসেবে পরিচালিত হবে। এ তহবিলের অর্থ থেকে অর্জিত সুদ ও সারচার্জ তহবিলে জমা হবে। তহবিল পরিচালনায় জ্বালানি নিরাপত্তা তহবিল নীতিমালা তৈরির কাজ চলছে।
আন্তর্জাতিক মান অনুযায়ী, এলএনজিতে মিথেনের পরিমাণ ৮৯ দশমিক ৬৩ শতাংশ। এছাড়া ইথেন ৬ দশমিক ৩২ শতাংশ, প্রপেন ২ দশমিক ১৬ শতাংশ ও বিউটেন ১ দশমিক ১২ শতাংশ। আমদানিকৃত এলএনজি গ্যাসের মান নিশ্চিতকরণে তিনটি টিম কাজ করবে। এগুলো হল ক্রেতা পেট্রোবাংলার পক্ষে একটি, বিক্রেতা রাশগ্যাসের পক্ষে একটি ও অন্যটি ক্রেতা-বিক্রেতার সমন্বয়ে একটি স্বাধীন কমিটি।
রূপান্তরিত প্রাকৃতিক গ্যাস কোম্পানি লিমিটেডের একজন কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, মহেশখালীতে টার্মিনাল নির্মাণ এবং সেখান থেকে চট্টগ্রামের আনোয়ারা পর্যন্ত ৩০ ইঞ্চি ব্যাসের ৯১ কিলোমিটার দীর্ঘ পাইপলাইন স্থাপনের কাজ শেষ হয়েছে। এখন চলছে চট্টগ্রামের আনোয়ারায় সিটি গেট স্টেশন এবং আনোয়ারা থেকে চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ড পর্যন্ত ৪২ ইঞ্চি ব্যাসের আরও ৩০ কিলোমিটার পাইপলাইন স্থাপনের কাজ। এসব ভৌতকাঠামোর কাজ আগামী এপ্রিলের মধ্যে শেষ করার পরিকল্পনা রয়েছে বলে ওই কর্মকর্তারা জানান।
প্রাকৃতিক গ্যাস সাধারণ চাপ ও তাপমাত্রায় গ্যাসীয় অবস্থায় থাকে। শীতলীকরণ (রেফ্রিজারেশন) প্রযুক্তির মাধ্যমে তাপমাত্রা কমিয়ে মাইনাস ১৬০ ডিগ্রি সেলসিয়াসে নামিয়ে আনলে তা তরলে পরিণত হয়। এই তরল প্রাকৃতিক গ্যাসকেই বলা হয় এলএনজি। একটি জাহাজে দুই থেকে আড়াই হাজার মিলিয়ন বা ২০০ থেকে ২৫০ কোটি ঘনফুট এলএনজি আনা সম্ভব।
এই রকম সংবাদ আরো পেতে হলে এই লেখার উপরে ক্লিক করে আমাদের ফেসবুক ফ্যান পেইজে লাইক দিয়ে সংযুক্ত থাকুন। সংবাদটি সম্পর্কে মন্তব্য করতে হলে এই পেইজের নীচে মন্তব্য করার জন্য ঘর পাবেন