বুলবুল আহমেদের সেরা কিছু চলচ্চিত্র
বাংলাদেশে যতদিন চলচ্চিত্রে অহংকারের এক নাম বুলবুল আহমেদ। অভিনয় ও পরিচালনা দিয়ে নিজেকে তিনি করেছেন কালজয়ী। চারবার জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার অর্জন করেছেন। তার চলচ্চিত্রগুলোতে দর্শক শুদ্ধ রুচির পরিচয় পেতেন, সমৃদ্ধ হতো বিনোদনের মানসিকতা। বুলবুল আহমেদ আজ আর আমাদের মাঝে নেই। ২০১০ সালের ১৫ জুলাই তিনি না ফেরার দেশে পাড়ি জমান।
চোখের দেখায় তিনি নেই। রয়ে গেছে তার কাজ ও সৃষ্টি শিল্প। তাকে পাওয়া যায় তার চলচ্চিত্রগুলোতে। বেশ কয়েকটি প্রজন্ম পেরিয়েও তার চলচ্চিত্রগুলো মনকে প্রফুল্ল করে। জেনে নেয়া যাক বুলবুল আহমেদ অভিনীত কিছু সেরা চলচ্চিত্রের ব্যাপারে-
ধীরে বহে মেঘনা (১৯৭৩)
বুলবুল আহমেদের ক্যারিয়ারকে সমৃদ্ধ করা একটি অন্যতম ছবির নাম ‘ধীরে বহে মেঘনা’। আলমগীর কবির পরিচালিত এই ছবিতে বুলবুলের নায়িকা ছিলেন ববিতা। তাদের সঙ্গে আরও ছিলেন গোলাম মুস্তাফা, আনোয়ার হোসেন, খলিল উল্লাহ খান প্রমুখ। অতিতী শিল্পী হিসেবে অভিনয় করেন সুচন্দা।
এটি ১৯৭১ সালের বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের পটভূমিতে নির্মিত। ২০০২ সালে ব্রিটিশ ফিল্ম ইন্সটিটিউটের দক্ষিণ এশিয়ার চলচ্চিত্র তালিকায় সেরা ১০টি চলচ্চিত্রের মধ্যে ৮ নম্বর অবস্থানে স্থান পেয়েছে ‘ধীরে বহে মেঘনা’।
সূর্য কন্যা (১৯৭৫)
‘ধীরে বহে মেঘনা’ ছবির সাফল্যের পর বুলবুল আহমেদের সঙ্গে দারুণ সখ্যতা গড়ে ওঠে নির্মাতা আলমগীর কবিরের। দুজনে জুটি হয়ে বেশ কিছু চলচ্চিত্র উপহার দিয়েছেন এদেশের চলচ্চিত্রকে। সেগুলো মানে যেমন ছিলো সেরা, দর্শকপ্রিয়তাও পেয়েছিলো দারুণ।
সেইসঙ্গে এই জুটির সিনেমাগুলো বাংলাদেশি সিনেমার আর্কাইভকেও করেছে সমৃদ্ধ। তাদের জুটির দ্বিতীয় ছবিটি হলো ‘সূর্য কন্যা’। ১৯৭৫ সালে মুক্তি পাওয়া এই ছবিতে বুলবুলের নায়িকা ছিলেন জয়শ্রী কবির। তাদের সঙ্গে আরও ছিলেন রাজশ্রী বোস, সুমিতা দেবী, আহসান আলী, অজয় ব্যানার্জীর মতো নন্দিত তারকা শিল্পীরা।
সীমানা পেরিয়ে (১৯৭৭)
বুলবুল আহমেদকে অন্য এক উচ্চতায় পৌঁছে দেয়া ছবির নাম ‘সীমানা পেরিয়ে’। এটিও পরিচালনা করেন আলমগীর কবির। ১৯৭০ সালে উপকূলীয় অঞ্চলে এক ভয়াবহ জলোচ্ছ্বাসের ঘটনাকে কেন্দ্র করে ছবিটি নির্মিত হয়েছিলো। এখানে মূল চরিত্রে অভিনয়ের জন্য সেরা অভিনেতা হিসেবে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার ঘরে তুলেছিলেন বুলবুল আহমেদ।
ছবিতে তার বিপরীতে ছিলেন জয়শ্রী কবির। এছাড়াও কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ চরিত্রে অভিনয় করেছেন মায়া হাজারিকা, কাফী খান, গোলাম মোস্তফা ও তনুজা।
চলচ্চিত্রটি ১৯৭৭ সালের জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারে শ্রেষ্ঠ অভিনেতাসহ মোট তিনটি বিভাগে পুরস্কার লাভ করেছিল। এছাড়াও ব্রিটিশ ফিল্ম ইন্সটিটিউট-এর ‘বাংলাদেশের সেরা ১০ চলচ্চিত্র’ তালিকায় স্থান পেয়েছে ‘সীমানা পেরিয়ে’।
রূপালী সৈকতে (১৯৭৯)
এই ছবিটিও বুলবুল আহমেদ, আলমগির কবির, জয়শ্রী কবির জুটির। চমৎকার গল্পের পাশাপাশি শ্রুতিমধুর কিছু গান সিনেমাটিকে দিয়েছিলো অনন্য জনপ্রিয়তা। এখানে বুলবুল-জয়শ্রী ছাড়া আরও অভিনয় করেছেন শর্মিলী আহমেদ, আনোয়ার হোসেন, নুতন, অঞ্জনা রহমান, রোজী সামাদ ও উজ্জল।
দেবদাস (১৯৮২)
অনেকেই বুলবুল আহমেদকে ‘দেবদাস’ বলে অভিহিত করে থাকেন। তার কারণ, তিনি শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের তুমুল জনপ্রিয় এই চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন ‘দেবদাস’ ছবিতে। ১৯৮২ সালে এটি মুক্তি পেয়েছিলো। নির্মাণ করেছিলেন নন্দিত চলচ্চিত্রকার চাষী নজরুল ইসলাম।
এটি ছিল বাংলাদেশে প্রথম ‘দেবদাস’ উপন্যাসের চলচ্চিত্রায়ণ। ছবিতে বুলবুলের বিপরীতে পারু’র ভূমিকায় কবরী সারোয়ার ও চন্দ্রমুখী’র ভূমিকায় আনোয়ারা অভিনয় করেন।
চলচ্চিত্রটি ১৯৮২ সালের জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার কয়েকটি বিভাগে মনোনয়নের জন্য জমা দেয়া হয়। কিন্তু জুরিবোর্ড সদস্যরা চলচ্চিত্রিটিকে পুননির্মিত/রিমেক অভিহিত করে কোনো শাখাতেই মনোনয়ন দেয়নি। তবে বাচসাস) বাংলাদেশ চলচ্চিত্র সাংবাদিক সমিতির পুরস্কারে সেরা অভিনেতাসহ দশটি বিভাগে পুরস্কার জিতে নিয়েছিলো। পরিচালক হিসেবে পুরস্কার না পেলেও চাষী নজরুল ইসলাম ‘দেবদাস’ চলচ্চিত্রের মাধ্যমে জনপ্রিয়তা লাভ করেন।
মহানায়ক (১৯৮৪)
বাংলাদেশি চলচ্চিত্রে মহানায়ক বলা হয় বুলবুল আহমেদকে। মূলত এই ছবিটির পর থেকেই তার উপাধি হয়েছিলো মহানায়ক। আলমগির কবির এই ছবিতে দুর্দান্ত এক অভিনেতাকে দেখিয়েছেন। বুলবুল আহমেদ এখানে তিনজন নায়িকার বিপরীতে কাজ করেছেন। তারা হলেন কাজরী, জুলিয়া ও রিনা খান।
ছবিতে সুবীর নন্দীর গাওয়া ‘আমার এ দুটি চোখ পাথর তো নয়’, ‘পৃথিবীতে প্রেম বলে কিছু নেই’ গান দুটি সর্বকালের সেরা বাংলা গানের তালিকায় স্থান পেয়েছে। শেখ সাদী খানের সুর-সংগীতে গানগুলোর গীত রচনা করেছেন মাসুদ করিম। এই দুটি গানে বুলবুল আহমেদকে পর্দায় দেখাটা দারুণ ব্যপার হয়ে ধরা দিয়েছিলো তৎকালীন দর্শকদের কাছে। আজও তার ব্যতিক্রম নয়। ছবিটিতে বেকার এক যুবকের ধোঁকাবাজ হয়ে ওঠা, অপরাধকে আকড়ে ধরার গল্প রয়েছে। জীবনের বৈরীতাতেও সেই যুবকের প্রেম ও বিরহের টানাপোড়েন দর্শককে নিয়ে যায় সুন্দর এক মুগ্ধতার অনুভূতির পথে।
শুভদা (১৯৮৬)
বুলবুল আহমেদের ক্যারিয়ারকে সমৃদ্ধ করা আরও একটি ছবির নাম ‘শুভদা’। এটিও শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের উপন্যাস অবলম্বনে নির্মাণ করেছিলেন চাষী নজরুল ইসলাম। এখানে বুলবুল আহমেদ অভিনয় করেছেন জমিদার চরিত্রে। যে জমিদারের কাছে আশ্রিতা ছিলো ‘শুভদা’র মেয়ে ললনা।
এখানে ‘শুভদা’ চরিত্রে আনোয়ারা ও তার স্বামী হারানের চরিত্রে গোলাম মোস্তফা অভিনয় করেছেন। ছবিতে নায়করাজ রাজ্জাককে দেখা গেছে ললনার প্রেমিক সদানন্দের ভূমিকায়। আর ললনা চরিত্রে অভিনয় করেছেন জিনাত।
রাজলক্ষ্মী শ্রীকান্ত (১৯৮৭)
বুলবুল আহমেদ সবসময়ই সাহিত্যধর্মী চলচ্চিত্রে নিজেকে নিয়োজিত রেখেছেন। আর শরৎচন্দ্রের সাহিত্যের প্রতি তার ছিলো বিশেষ অনুরাগ। ‘দেবদাস’ চরিত্রে জনপ্রিয়তা পাওয়ার পর তিনি একই সাহিত্যিকের তুমুল জনপ্রিয় আরেকটি চরিত্র ‘শ্রীকান্ত’ হিসেবেও নিজেকে রুপালি পর্দায় নিয়ে আসেন।
এই ছবিটির পরিচালনা করেছিলেন তিনি নিজেই। চিত্রনাট্য ও সংলাপ লিখেছেন বুলবুল আহমেদ, মমতাজউদ্দীন আহমদ ও জহিরুল হক। এখানে তার বিপরীতে রাজলক্ষী চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন নন্দিত অভিনেত্রী শাবানা।
অন্যান্য ভূমিকায় অভিনয় করেছেন প্রবীর মিত্র, নূতন, রাজ্জাক, সৈয়দ হাসান ইমাম ও আরও অনেকে। ছবিটি ১৯৮৭ সালের ১৩ ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশে মুক্তি পায়। ছবিটি ১২তম জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারে দুটি অভিনয় (শ্রেষ্ঠ পার্শ্বচরিত্রে অভিনেতা ও শ্রেষ্ঠ শিশু শিল্পী) ও একটি সংগীত (শ্রেষ্ঠ নারী কণ্ঠশিল্পী) বিভাগে মোট চারটি পুরস্কার অর্জন করে এবং বাচসাস চলচ্চিত্র পুরস্কারে শ্রেষ্ঠ চলচ্চিত্রসহ ১১টি বিভাগে পুরস্কার লাভ করে।
দীপু নাম্বার টু (১৯৯৬)
বুলবুল আহমেদের তুমুল জনপ্রিয় চলচ্চিত্রের তালিকায় অন্যতম ‘দীপু নাম্বার টু’। শিশুতোষ এই চলচ্চিত্রে তিনি ববিতার স্বামী চরিত্রে অভিনয় করেন। মুহাম্মদ জাফর ইকবালের ১৯৮৪ সালের একই নামের কিশোর উপন্যাস অবলম্বনে সরকারি অনুদানে নির্মিত হয় চলচ্চিত্রটি। এটি পরিচালনা করেছেন মোরশেদুল ইসলাম।
এই ঘর এই সংসার (১৯৯৬)
নির্মাতা মালেক আফসারীকে বলা হয় বিগ বাজেটের নির্মাতা। তিনি তারকাবহুল চলচ্চিত্র নির্মাতা হিসেবেও সুপরচিত। তার ছবিতে একসঙ্গে দেখা যেত অনেক তারকা। আর সব ছবিই ছিলো সুপারব্লাস্ট হিট। তেমনি একটি ছবি ‘এই ঘর এই সংসার’।
এটি ১৯৯৬ সালে মুক্তি পায়। এখানে সালমান শাহ ও আলীরাজের দুলাভাই চরিত্রে অভিনয় করে দর্শকদের মন ছুঁয়ে গিয়েছিলেন বুলবুল আহমেদ। তার স্ত্রীর চরিত্রে আছেন রোজী আফসারী। চমৎকার এক পারিবারিক গল্পের ছবিটি বুলবুল আহমেদ নিজেও খুব পছন্দ করতেন।
এই সিনেমা মুক্তির এক মাস পর কোটি কোটি ভক্তকে কাঁদিয়ে পৃথিবী থেকে চিরবিদায় নেন অমর নায়ক সালমান শাহ।
শ্বশুরবাড়ী জিন্দাবাদ (২০০২)
এক নতুনের আবির্ভাব হয়েছিলো এই চলচ্চিত্রে। তিনি দেবাশীষ বিশ্বাস। অমর পরিচালক দিলীপ বিশ্বাসের পুত্র। এই ছবিটি দিয়েই আনুষ্ঠানকিভাবে চলচ্চিত্র নির্মাতা হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেন দেবাশীষ। তৎকালীন সবচেয়ে জনপ্রিয় ও সফল জুটি রিয়াজ-শাবনূরের উপস্থিতির কারণেই ছবিটি ছিলো আলোচিত। চমৎকার গল্প, তারকাবহুল কাস্টিং, শ্রুতিমধুর গানের জন্য ছবিটি নিয়ে প্রত্যাশা ছিলো আকাশ ছোঁয়া।
হয়েছিলোও তাই। মুক্তির পর বাম্পার হিট হয় ছবিটি। নায়ক-নায়িকার গ্ল্যামার আর প্রচারের চাকচিক্যের বাইরে গিয়ে ছবিটিতে দর্শকের মন জয় করে নিয়েছিলেন বুলবুল আহমেদ। কড়া স্বভাবের লোভী স্ত্রী রিনা খানের নিতান্তই ভদ্রলোক স্বামী চরিত্রে বুলবুল আহমেদ ছিলেন অনবদ্য।
ছবিতে তার কৌশলী প্রতিবাদ বারবার হাততালি পেয়েছে দর্শকের কাছে। শাবনূরের স্বামী রিয়াজকে সমর্থন ও তাকে শ্বশুরবাড়িতে মেয়ের জামাইয়ের অধিকার আদায়ের লড়াইয়ে শ্বশুর বুলবুল আহমেদের সমর্থন উপভোগ করেছে দর্শক।
শেষকথা, এক জীবনে অসংখ্য চলচ্চিত্রে অভিনয় করেছেন বুলবুল আহমেদ। তার বহু ছবি টিকে গেছে মহাকোলের স্রোতে। তিনি চিরদিন এই ইন্ডাস্ট্রির মহানায়ক হয়ে থাকবেন। তার অতোসব চলচ্চিত্রের মাঝ থেকে উপরোক্ত ছবিগুলোকে বাছাই করা হলো কেবল দর্শকের দৃষ্টিকোণ থেকে। মূলত, সেরাদের সব সৃষ্টিই সেরা।
এই রকম সংবাদ আরো পেতে হলে এই লেখার উপরে ক্লিক করে আমাদের ফেসবুক ফ্যান পেইজে লাইক দিয়ে সংযুক্ত থাকুন। সংবাদটি সম্পর্কে মন্তব্য করতে হলে এই পেইজের নীচে মন্তব্য করার জন্য ঘর পাবেন