রোহিঙ্গা সংকট: বাংলাদেশের কূটনীতির সাফল্য-ব্যর্থতার খতিয়ান

রোহিঙ্গা সংকট যে দ্রুততার সাথে বিস্তৃত হয়েছে সেটি বাংলাদেশ সরকারকেও বিস্মিত করে তুলেছিল।

সীমান্তে অবস্থানরত রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশে আশ্রয় দেয়া হবে কিনা সেটি নিয়েও বাংলাদেশে সরকারের মাঝেও দোদুল্যমানতা ছিল।

কিন্তু যেভাবে লাখ লাখ রোহিঙ্গা সীমান্তে এসে জড়ো হয়েছিল, তাতে তাদের আটকে রাখা বাংলাদেশের সীমান্ত রক্ষী বাহিনীর পক্ষে অনেক ক্ষেত্রেই সম্ভব ছিল না।

মাত্র এক সপ্তাহের মধ্যেই ২৭ হাজার রোহিঙ্গা বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়। এক মাসের ব্যবধানে এ সংখ্যা পাঁচ লাখ ছাড়িয়ে যায়।

রোহিঙ্গা সংকট শুরুর এক মাসের মধ্যেই বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদে দেয়া ভাষণে সংকট সমাধানের জন্য পাঁচটি সুপারিশ তুলে ধরেন।

একই সাথে সংকট সমাধানের জন্য বিশ্বের গুরুত্বপূর্ণ দেশগুলোর সমর্থন লাভের চেষ্টাও করে বাংলাদেশ।

বাংলাদেশের কূটনীতির বড় প্রচেষ্টা ছিল মিয়ানমারের উপর চাপ তৈরি করা।

রোহিঙ্গা সংকট শুরুর তিন মাসের মধ্যে মিয়ানমারের সাথে প্রত্যাবাসন সমঝোতা করে বাংলাদেশ।

কিন্তু প্রত্যাবাসনের বিষয়ে গত নয় মাসে দৃশ্যত কোন অগ্রগতি হয়নি। সাবেক রাষ্ট্রদূত হুমায়ুন কবির বলছেন, মিয়ানমারের সাথে বাংলাদেশের কূটনীতিক আলোচনা অব্যাহত আছে, সেটিও ইতিবাচক ।

মি: কবির বলেন, ” এ সমস্যা সমাধানের জন্য মিয়ানমারের সাথে আমাদের এনগেইজড (জড়িত) থাকতে হবে। সেটা তৈরি হয়েছে। কিন্তু সেখান থেকে কতটা ফল পেয়েছি সেটি এ মুহূর্তে মূল্যায়ন করা যাবে না।”

সংকট শুরুর তিন মাসের মাথায় রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন নিয়ে মিয়ানমারের সাথে সমঝোতা স্বাক্ষর করেছে বাংলাদেশ।

এ সমঝোতা বেশ দ্রুততার সাথে হয়েছে বলে মনে করেন কোন কোন বিশ্লেষক।

তাছাড়া এ সমঝোতার মাধ্যমে মিয়ানমার আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে দেখিয়েছে যে সংকট সমাধানের জন্য তারা কাজ করছে, যদিও সমঝোতা বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে তেমন কোন অগ্রগতি হয়নি।

এ সমঝোতার মাধ্যমে রোহিঙ্গা সংকটকে বাংলাদেশ এবং মিয়ানমারের দ্বিপক্ষীয় বিষয় হিসেবে আবদ্ধ করা হয়েছে, যাতে বাংলাদেশের কোন লাভ হয়নি বলে কোন কোন বিশ্লেষকদের ধারণা।

আরো কিছুদিন অপেক্ষা করলে আন্তর্জাতিক চাপের কারণে মিয়ানমার হয়তো এমন একটি সমঝোতা করতে বাধ্য হতো, যাতে বাংলাদেশ লাভবান হতে পারতো।

রোহিঙ্গা সংকট নিয়ে জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের দীর্ঘ আট বছর পর আলোচনা হয়েছে গত সেপ্টেম্বর মাসে।

এ সংকটের অবসান চেয়ে নিরাপত্তা পরিষদ একটি যৌথ বিবৃতিও দিয়েছে।

ইউরোপীয় ইউনিয়ন এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র মিয়ানমারের শীর্ষ কয়েকজন সামরিক কর্মকর্তার বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞাও দিয়েছে।

জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের একটি দলসহ বিভিন্ন দেশ এবং সংস্থার প্রতিনিধিরা রোহিঙ্গা ক্যাম্প পরিদর্শন করে নির্যাতনের বর্ণনা শুনেছেন।

সাবেক রাষ্ট্রদূত নাসিম ফেরদৌস মনে করেন, রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নেবার বিষয়ে মিয়ানমার যেভাবে টালবাহানা করছে তাতে দেশটির উপর বেশি আন্তর্জাতিক চাপ তৈরি হয়েছে বলে মনে হয়না।

তিনি বলেন, “বিশ্ব দেখেছে, বিশ্ব শুনেছে। নানা দেশ থেকে নানা ডেলিগেশন এসেছেন এবং দেখেছেন। এটাই আমাদের একমাত্র অ্যাচিভমেন্ট (অর্জন) আমি মনে করি।”

রোহিঙ্গা সংকট সমাধানের জন্য বাংলাদেশের দিক থেকে যখন নানামুখী তৎপরতা চলছিল তখন বাংলাদেশের ঘনিষ্ঠ মিত্র হিসেবে পরিচিত ভারত এবং চীন যেভাবে মিয়ানমারকে সমর্থন দিয়েছে তাতে বাংলাদেশের ভেতরে অনেকেই অবাক হয়েছেন।

সাবেক রাষ্ট্রদূত হুমায়ুন কবির বলেন, বাংলাদেশের কূটনীতির জন্য রোহিঙ্গা সংকট সত্যিই একটি বড় চ্যালেঞ্জ তৈরি করেছে।

মি: কবির বলেন, ভারত এবং চীনকে বাংলাদেশ বন্ধু হিসেবেই বিবেচনা করে।

কিন্তু সে বন্ধুত্বের মধ্যে অনেক শর্ত বিরাজমান বলে তিনি উল্লেখ করেন।

এক্ষেত্রে রোহিঙ্গা ইস্যুতে এ দুটি দেশকে বাংলাদেশের পক্ষে আনা কূটনীতির জন্য সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ।

যদিও সরকার মনে করেন ভারত ও চীন এ সংকট সমাধানের জন্য কাজ করছে।

গত এক বছরে মিয়ানমারের দুইজন মন্ত্রী যেমন বাংলাদেশ সফর করেছেন তেমনি বাংলাদেশের তরফ থেকেও সে ধরনের সফর হয়েছে।

সর্বশেষ বাংলাদেশর পররাষ্ট্রমন্ত্রী এবং সচিবসহ একটি দলকে মিয়ানমারের রাখাইন অঞ্চলে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের ক্যাম্প দেখিয়েছে সে দেশের সরকার।

পররাষ্ট্রমন্ত্রী শহিদুল হক মনে করেন, গত এক বছরে বাংলাদেশ কূটনীতিতে সফল হয়েছে তবে সংকট সমাধানে সময় লাগে।

মি: হক বলেন, “এ ধরণের প্রত্যাবর্তন খুবই জটিল এবং সময় স্বাপেক্ষ বিষয়।

তারপরেও গত এক বছরে যে অগ্রগতি হয়েছে সেটা অনেক ক্ষেত্রেই হয়না। দেখা যাক কবে নাগাদ এরা ফিরে যেতে পারে।”

বিশ্লেষকরা বলছেন, কূটনৈতিক তৎপরতা যেভাবেই চালানো হোক না কেন নিকট ভবিষ্যতে রোহিঙ্গা সংকটের কোন সমাধানের কোন লক্ষণ তারা দেখছেন না।

-বিবিসি বাংলা