রোহিঙ্গা ক্যাম্পেও ধর্ষণের অভিযোগ : যা বলছে প্রশাসন

বাংলাদেশের কক্সবাজারে রোহিঙ্গা শিবিরে নারী ও মেয়ে শিশুরা ক্যাম্পের ভেতরেই ধর্ষণের শিকার হচ্ছে বলে অভিযোগ করেছে একটি আন্তর্জাতিক দাতব্য সংস্থা।

চিকিৎসা দাতব্য সংস্থা, মেদসাঁ স্যঁ ফ্রঁতিয়ে বা এমএসএফের মিডওয়াইফ অ্যাক্টিভিটি ম্যানেজার স্টেলা উইয়েলা বিবিসির সাথে এক সাক্ষাতকারে বলেন, ক্যাম্পের ভেতরেই ধর্ষণের শিকার নারীরা নিয়মিত তাদের কাছে চিকিৎসা নিতে আসছেন।

তিনি বলেন, অনেক ক্ষেত্রে আত্মীয় পুরুষদের দ্বারাই ঘটছে ধর্ষণের ঘটনা।

কিন্তু এ নিয়ে অভিযোগ তো নয়ই, এমনকি চিকিৎসকের কাছেও গোপন করতে চায় পরিবার। সেই সঙ্গে ক্যাম্পগুলোর রোহিঙ্গা প্রতিনিধিরাও বিষয়টি স্বীকার করতে চায় না।

পুলিশও বলছে তাদের কাছে এ নিয়ে খুব কমই অভিযোগ আসে।

তবে, এমন ঘটনা ঘটছে স্বীকার করে বাংলাদেশের শরণার্থী প্রত্যাবাসন বিষয়ক কমিশনার জানিয়েছেন, এ ধরণের ঘটনা ঠেকাতে নিরাপত্তা বাড়ানোসহ বিভিন্ন ধরণের পদক্ষেপ নেয়া হচ্ছে।

কক্সবাজারে আন্তর্জাতিক দাতব্য প্রতিষ্ঠান মেদসাঁ স্যঁ ফ্রঁতিয়ে এমএসএফের মেডিকেল ক্যাম্পে প্রতিদিন পাঁচজন থেকে দশজন রোগী আসেন যৌন হয়রানি কিংবা নির্যাতনের কারণে চিকিৎসা নিতে।

বিবিসির সাথে সাক্ষাৎকারে স্টেলা উইয়েলা জানিয়েছেন, চিকিৎসা নিতে আসা নারীদের প্রায় কেউই বিষয়টি নিয়ে মুখ খুলতে চান না বা অভিযোগ করেন না।

“আমাদের এখানে অনেক তরুণী চিকিৎসার জন্য এসেছে যারা ধর্ষণের শিকার হয়েছে। যারা মিয়ানমারে ধর্ষণের শিকার হয়েছে তাদের সবাই বলেছে, একের অধিক পুরুষ মিলে ধর্ষণ করেছে তাদের।”

তিনি জানান, “মিয়ানমারে ধর্ষণ হয়েছে সত্য, কিন্তু এখানে ক্যাম্পেও অনেকে ধর্ষণের শিকার হচ্ছে।”

মিজ স্টেলা জানিয়েছেন, ধর্ষণের শিকার হয়ে চিকিৎসা নিতে প্রতিদিন তাদের কাছে যে নারী ও মেয়ে শিশুদের নিয়ে তাদের অভিভাবকেরা আসেন, তাদের অনেকেই গর্ভবতী।

“বাংলাদেশের আইনে গর্ভধারণের দুই তিন মাসের মধ্যে গর্ভপাত করা যায়, আমাদের এখানে অনেকেই আসেন ধর্ষণের ফলে গর্ভে আসা বাচ্চা গর্ভপাত করাতে। এতে বোঝা যায় ক্যাম্পেও ধর্ষণের শিকার হচ্ছে তারা।”

“এসব হচ্ছে একেবারে কাছের মানুষের মাধ্যমে, যেমন বোনের স্বামী,” বলেন তিনি।

এমএসএফ বলছে নারীদের সঙ্গে অনাথ বা মাতৃহীন মেয়ে শিশুরাও ধর্ষণের ঝুঁকিতে রয়েছে। তবে, পরিবার বিষয়টি স্বীকার করতে চায় না।

অভিভাবকেরা বেশির ভাগ সময় এমনকি চিকিৎসকের কাছেও লুকিয়ে রাখতে চান বিষয়টি। ডাক্তার বা প্রশিক্ষিত ধাত্রীদের প্রশ্নের জবাবে তারা ‘খেলতে গিয়ে ব্যথা পেয়েছে’ জাতীয় মিথ্যা কথা বলেন।

গোপনীয়তার কারণে তারা নিজেরাও বিষয়টি প্রশাসনকে জানাননি।

বিষয়টি স্বীকার করতে চাননি রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোর রোহিঙ্গা প্রতিনিধি নেতারাও।

বিবিসি পাঁচটি ক্যাম্পের রোহিঙ্গা প্রতিনিধি নেতা যাদেরকে হেড মাঝি বলা হয়, তাদের সঙ্গে কথা বলেছে, যাদের কেউই বিষয়টি স্বীকার করতে চাননি।

এদিকে, বাংলাদেশের শরণার্থী প্রত্যাবাসন বিষয়ক কমিশনার আবুল কালাম জানিয়েছেন, এ ধরণের ঘটনা কিছু কিছু ঘটছে, সেটি তাদের কাছে খবর এসেছে।

“এ ধরণের ঘটনা যে ঘটছে না তা নয়, ঘটছে। কিন্তু তা ঠেকাতে আমার ক্যাম্পের ভেতরে নিরাপত্তা বাড়ানোসহ নানা ধরণের পদক্ষেপ নিয়েছি।”

এর মধ্যে নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্য এবং স্বেচ্ছাসেবক বাড়ানোসহ, সন্ধ্যার পর পর্যাপ্ত আলোর ব্যবস্থাও করা হয়েছে। যেসব জায়গায় এখনো বিদ্যুৎ নেই, পিডিবির সঙ্গে কথা বলে সেসব জায়গায় সংযোগ দেবার উদ্যোগ নেয়া হচ্ছে।”

“মুশকিল হলো, বিকাল পাঁচটার পর তো বাইরের লোকজন আসা বন্ধ, ফলে এখন ভেতরের নিরাপত্তা বাড়ানোর জন্য পুলিশ ক্যাম্প বাড়ানোর ব্যবস্থা করছি আমরা।”

মি: কালাম বলছেন, এক জায়গায় প্রায় ১১ লক্ষ মানুষের মধ্যে এ ধরণের অপরাধ নিয়ন্ত্রণ কঠিন একটি ব্যাপার। কিন্তু কক্সবাজারে কর্মরত স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোকে সাথে নিয়ে তারা এ সমস্যা সমাধানের যথাসাধ্য চেষ্টা করছেন।

এদিকে, পুলিশ বলছে গত এক বছরে রোহিঙ্গা ক্যাম্পের মধ্যে ধর্ষণের ঘটনায় মোট ছয়টি মামলা হয়েছে।

কক্সবাজার পুলিশের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মোহাম্মদ ইকবাল হোসেইন জানিয়েছেন, এমএসএফের তথ্য অনুযায়ী এত ব্যাপক হারে ধর্ষণের তথ্য তাদের কাছে নেই।

“গত এক বছরে রোহিঙ্গা ক্যাম্পের মধ্যে ধর্ষণের ঘটনায় ছয়টি মামলা হয়েছে, যার আসামি সংখ্যা মোট নয়জন। তাদের গ্রেপ্তার করা হয়েছে এবং তদন্ত করে এ মামলাগুলোর চার্জশীটও দেয়া হয়েছে।”

“ভুক্তভোগীরা অভিযোগ না করলে জানা সম্ভব নয়, অপরাধ কি হারে ঘটছে। আমাদের কাছে যেসব অভিযোগ এসেছে, সেসবের ব্যাপারে আমরা ব্যবস্থা নিয়েছি।”

তবে, মি: হোসেইন জানিয়েছেন, বিষয়টি নিয়ে এখন আরো সচেতন হবে পুলিশ প্রশাসন। নিরাপত্তা এবং সচেতনতা দুইটাই বাড়ানোর ব্যপারে ব্যবস্থা নেয়া হবে।

-বিবিসি বাংলা