চট্টগ্রামের দরজা খুলছে, কী লাভ উত্তর-পূর্ব ভারতের?
বাংলাদেশের চট্টগ্রাম ও মংলা বন্দরকে উত্তর-পূর্বের ভারতের ব্যবহারের জন্য উন্মুক্ত করার প্রস্তাবে মন্ত্রিসভা সম্মতি দেওয়ার পর ভারতীয় কর্তৃপক্ষ তাদের অকুণ্ঠ ধন্যবাদ জানাচ্ছে।
পর্যবেক্ষকরা মনে করছেন, ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলকে বাকি দেশের সঙ্গে এক কাতারে নিয়ে আসতে এই সিদ্ধান্ত খুবই সাহায্য করবে।
ত্রিপুরা সরকার যেমন বলছে, বাংলাদেশের এই সিদ্ধান্তের ফলে তাদের রাজ্যে জিনিসপত্র আনার খরচ প্রায় আশি শতাংশ কমবে।
তবে কথিত অবৈধ বিদেশি শনাক্তকরণের প্রশ্নে আসাম-সহ উত্তর-পূর্ব ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্কে যে উত্তেজনার অবকাশ আছে, এর পাশাপাশি সেটাকেও দ্রুত ‘অ্যাড্রেস করা দরকার’ বলে বিশেষজ্ঞরা সতর্ক করে দিচ্ছেন।
আসলে ভারতের সাড়ে সাত হাজার কিলোমিটারেরও বেশি দীর্ঘ সমুদ্রতট থাকলেও উত্তর-পূর্ব ভারতের সাতটি রাজ্য পুরোপুরি ‘ল্যান্ডলকড’ বা স্থলবেষ্টিত – কোনও সমুদ্রবন্দরেই তাদের সরাসরি অ্যাকসেস নেই।
এখন ভারতীয় পণ্যের জন্য চট্টগ্রাম বন্দরের দরজা খুলে গেলে ওই অঞ্চলের দীর্ঘ দিনের একটি অভাব মিটবে, অনেক কম খরচে ও কম সময়ে বিপুল পরিমাণ পণ্য ও রসদ সেখানে নিয়ে যাওয়া সম্ভব হবে।
ত্রিপুরার পরিবহনমন্ত্রী প্রাণজিৎ সিংহরায় বিবিসিকে বলছিলেন, “আমাদের রাজ্যে এখন একমাত্র লাইফলাইন হল শিলিগুড়ি করিডর। দেশলাই বাক্স থেকে চালের বস্তা, যাই আমরা আনি না কেন – সেটা আনতে হয় শিলিগুড়ি-গুয়াহাটি-শিলংয়ের রাস্তা দিয়ে, সড়কপথে যেটা প্রায় পৌনে পাঁচশো থেকে পাঁচশো কিলোমিটার পড়ে যায়।”
“এখন চট্টগ্রাম খুলে গেলে যেটা হবে, চট্টগ্রাম থেকে ফেণীর দূরত্ব মাত্র বাহাত্তর কিলোমিটার – আর তারপরই সেই মালপত্র সীমান্ত পেরিয়ে ত্রিপুরায় ঢুকে পড়তে পারবে। কোথায় পাঁচশো কিলোমিটার, আর চট্টগ্রাম থেকে আগরতলা একশো কিলোমিটারেরও কম!”
“কাজেই আমাদের পরিবহন খরচ কমবে, সময় কম লাগবে – জিনিসপত্রেরও দামও অবশ্যই অনেক কমবে। তা ছাড়া রাজ্যে কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি হবে, ত্রিপুরা এই অঞ্চলের একটি পরিবহন ‘হাব’ হয়ে উঠবে”, বলছিলেন মি সিংহরায়।
ফলে ত্রিপুরা সরকার মনে করছে, চট্টগ্রাম বন্দরে পণ্যবাহী জাহাজ ভারতের জন্য মাল খালাস করতে পারলে ত্রিপুরা উত্তর-পূর্ব ভারতের জন্য একটি প্রবেশদ্বার হিসেবে গড়ে উঠবে।
চট্টগ্রামের পাশাপাশি ভারত মিয়ানমারের সিতওয়ে বন্দর দিয়েও উত্তর-পূর্ব ভারতের দরজা খুলতে চাইছে বহুদিন ধরে, কালাদান মাল্টিমোডাল রুট নামে যে পথটি খুললে উত্তর-পূর্ব ভারতের আর একটি গেটওয়ে হয়ে উঠতে পারে মিজোরাম।
তবে শিলংয়ে নর্থ-ইস্টার্ন হিল ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক ও আঞ্চলিক ভূরাজনীতির বিশেষজ্ঞ মুনমুন মজুমদার বলছিলেন, “নানা কারণে কালাদান প্রোজেক্ট শেষ হতে যা সময় লাগবে বলে ভাবা হয়েছিল, তার চেয়ে অনেক বেশি লাগছে। রাখাইন প্রদেশের পরিস্থিতিও এই দেরির একটা কারণ।”
“এই পটভূমিতে ভারত অনেকদিন ধরেই চট্টগ্রাম দিয়ে ঢোকার চেষ্টা করছিল, সেই অনুরোধই বাংলাদেশ এখন রাখছে। সুতরাং উত্তর-পূর্ব ভারতের জন্য এটা এক দারুণ সিদ্ধান্ত, কারণ একটা বিকল্প রুট খুলে যাচ্ছে – এই গোটা অঞ্চলটা যেন নতুনভাবে উন্মুক্ত হচ্ছে।”
তবে অধ্যাপক মজুমদার সেই সঙ্গেই সতর্ক করে দিচ্ছেন, গোটা উত্তর-পূর্ব ভারতেই বহিরাগত বা বিশেষ করে বাংলাদেশী নাগরিকদের সম্পর্কে এক ধরনের সংবেদনশীলতা আছে – আর তাই নতুন বন্দরে অ্যাকসেস মানে যে নতুন করে ঢোকার পথ নয়, সে দিকটাতেও খেয়াল রাখা দরকার।
উত্তর-পূর্ব ভারত বিষয়ক বিশেষজ্ঞ ও সেন্টার ফর পলিসি রিসার্চের অধ্যাপক সঞ্জয় হাজারিকাও এই প্রসঙ্গে বিবিসিকে বলছিলেন, “বাংলাদেশ নির্বাচনের মাসতিনেক আগে ও ভারতে সাধারণ নির্বাচনের কয়েকমাস আগে যেভাবে এই সিদ্ধান্তটা এল, সেটাকে আমি ভারতের প্রতি রিচ আউট করার চেষ্টা হিসেবেই দেখছি।”
“বাংলাদেশে আওয়ামী লীগ সরকারের প্রতি ভারতের সমর্থন যাতে অক্ষুণ্ণ থাকে, সম্ভবত সেই চেষ্টাও আছে এর মধ্যে।”
“কিন্তু এর মধ্যে যে প্রশ্নটার উত্তর নেই – তা হল আসামের এনআরসি ইস্যু নিয়ে বাংলাদেশ কী ভাবছে, কিংবা ভারতের নানা জায়গায় অবৈধ বিদেশি তাড়ানোর নামে যা বলা হচ্ছে সেগুলো নিয়েই বা তাদের বক্তব্য কী!”
উত্তর-পূর্ব ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্কে অস্বস্তির উপাদান যে কম নেই, বিশেষজ্ঞরা তা প্রায় সকলেই মানেন।
কিন্তু ভারত ভাগ হওয়ার সাত দশকেরও বেশি সময় পর ভারতের ‘সেভেন সিস্টার্স’ যে এই প্রথম চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে জিনিসপত্র আনা-নেওয়া করতে পারবে, সেটা আগের অনেক হিসেব বদলে দিতে পারে বলেও তাদের ধারণা।
-বিবিসি বাংলা
এই রকম সংবাদ আরো পেতে হলে এই লেখার উপরে ক্লিক করে আমাদের ফেসবুক ফ্যান পেইজে লাইক দিয়ে সংযুক্ত থাকুন। সংবাদটি সম্পর্কে মন্তব্য করতে হলে এই পেইজের নীচে মন্তব্য করার জন্য ঘর পাবেন