মিথ্যা শনাক্তকরণ পরীক্ষা কতটা বিশ্বাসযোগ্য?
ঘটনাস্থল মার্কিন ক্যাপিটল ভবনের সুরক্ষিত একটি কক্ষ। যুক্তরাষ্ট্রে সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতি হিসেবে প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের মনোনীত ব্রেট কাভানার বিরুদ্ধে যৌন নির্যাতনের অভিযোগের তদন্তে এফবিআই’র গোপনীয় এক প্রতিবেদন পাঠ করছেন সিনেটররা।
এই প্রতিবেদনের বিষয়বস্তু জনসম্মুখে প্রকাশ করার নয়, এবং তদন্ত বিস্তৃতভাবে সম্পাদন করা হয়নি বলে বেশ সমালোচনাও রয়েছে।
তদন্ত চলার মাঝেই মিস্টার কাভানাকে মিথ্যা শনাক্তকরণ যন্ত্রে পরীক্ষা দেয়ার জন্য দাবি তুলেছেন সিনিয়র ডেমোক্র্যাট সদস্যরা। তার বিরুদ্ধে অভিযোগকারী একজন ক্রিস্টিনা ব্লেসি ফোর্ড এরইমধ্যে এই পরীক্ষা দিয়েছেন।
কিন্তু এই পরীক্ষা কতটা নির্ভুল? কীভাবে তা কাজ করে?
পলিগ্রাফ টেস্ট কী?
সংক্ষেপে বলা যায়, পলিগ্রাফ টেস্টে বিভিন্ন ধরনের শরীরিক প্রতিক্রিয়া ধারণ করা হয় যার মাধ্যমে সিদ্ধান্তে পৌঁছানো হয় যে একজন ব্যক্তি সত্য কথা বলছে কি-না।
সাধারণত রক্তচাপ কেমন, শ্বাস-প্রশ্বাসের পরিবর্তন এবং হাতের তালু ঘামছে কি-না, নাড়ির গতি- এগুলোই তার মাপকাঠি হিসেবে কাজ করে।
“পলিগ্রাফ অন্য যেকোনো মিথ্যা শনাক্তকরণ কৌশলের মতই যা মিথ্যা বলার পরোক্ষ প্রভাব পরিমাপ করে”- বলছিলেন ফরেনসিক মনোবিজ্ঞান বিশেষজ্ঞ ড. সোফি ভান ডের জি, যিনি এবিষয়ে দীর্ঘদিন গবেষণা করেছেন।
তিনি বলেন, “মিথ্যা বলার ফলে মানসিক চাপ বেড়ে যেতে পারে …এবং মিথ্যা শনাক্তকরণ পরীক্ষার মাধ্যমে আচরণগত এবং মানসিক পরিবর্তনগুলো দেখা যায় যা মানসিক স্ট্রেস-এর সময় হয়ে থাকে।”
সুতরাং পলিগ্রাফ টেস্ট সরাসরি প্রতারণা এবং মিথ্যাকে পরিমাপ করে না, কিন্তু একজন ব্যক্তি কথা বলার সময় সাক্ষাতকার-গ্রহীতাকে প্রতারিত করছে কি-না তা দেখতে সক্ষম।
এই তথ্য পরে অন্যান্য সবকিছুর সাথে ব্যবহার করা হয় এবং ওই ব্যক্তি সত্য বলছে কিনা সেটা নির্ণয় করা হয়।
কীভাবে কাজটি করা হয়?
বিশ্বের নানা প্রান্তে পলিগ্রাফ পদ্ধতি ব্যবহার করা হয়। জাপান, রাশিয়া এবং চীনে তা প্রচলিত। সবখানেই এর প্রযুক্তি এবং প্রক্রিয়া এখনও একই রয়ে গেছে।
অধ্যাপক ডন গ্রুবিন, যিনি ব্রিটেনে পলিগ্রাফ পরীক্ষকদের প্রশিক্ষণ দিয়েছেন, তিনি বলেন, ” এখানে একটি অনুশীলন টেস্টও হয় যেখানে প্রচুর প্রশ্ন করা হয়।”
ওই ব্যক্তিকে সহজ স্বাভাবিক অনুভূতি দেয়াও এর উদ্দেশ্য যাতে সে স্বস্তির পরিবেশ পায় এবং কিভাবে প্রক্রিয়াটি কাজ করতে পারে সেটিও সে বুঝতে পারে।
সব সরঞ্জাম এক সাথে যুক্ত করার আগে সব প্রশ্নের ব্যাপারেও তার সম্মতি নেয়া হয়।
“তাকে কোনও আচমকা প্রশ্ন করা হয় না। কারণ সেটা নিজে একটা ট্রিগার জাগিয়ে তুলবে”- বলেন অধ্যাপক গ্রুবিন। “অর্থাৎ আপনাকে কী প্রশ্ন করা হতে যাচ্ছে সে সম্পর্কে আপনি অবগত।”
সরঞ্জামগুলো যুক্ত করার পর এর সাথে রক্তচাপ ঠিক আছে কিনা তা দেখার জন্য একটি মনিটর, আঙ্গুল ও হাতের তালুতে তড়িৎ প্রবাহের পরিবর্তন লক্ষ্য করার জন্যে দুটি নল বক্ষ এবং পাকস্থলীর আশেপাশে যুক্ত করা হয়।
১০ থেকে ১৫ মিনিটের মধ্যে আপনি এসব সরঞ্জামের সাথে তাকে যুক্ত করা হবে কিন্তু কক্ষটির ভেতরে তাকে থাকতে হবে কমপক্ষে দুই ঘণ্টা।
প্রশ্নকর্তা বেশকিছু নির্দিষ্ট প্রশ্ন করবেন এবং তারপরে মূল প্রশ্নগুলোর প্রতিক্রিয়া তুলনা করে দেখবেন।
পরীক্ষার পরে আরেকটি সাক্ষাৎকার দিয়ে যাচাই কাজ শেষ হয় যেখানে ওই ব্যক্তিটি যেকোনো প্রতিক্রিয়ার বিষয়ে তার ব্যাখ্যা তুলে ধরার সুযোগ পাবেন।
প্রতারণা করা সম্ভব?
বিশেষজ্ঞদের মতে তা সম্ভব।
প্রফেসর গ্রুবিন বলেন, যে কোনও ব্যক্তি পলিগ্রাফ টেস্টকে হারাতে পারে কিন্তু সেজন্য অবশ্যই তাকে প্রশিক্ষিত হতে হবে।
তিনি বলেন, বিভিন্ন ধরনের মাদকের সাহায্য নেয়ার চেষ্টা করে অনেকে, কিন্তু তারা সাফল্য পায় না। তিনি এও বলেন যে, বেশিরভাগ পরীক্ষকই শনাক্তকরণ বানচালের এধরনের কোনও প্রকাশ্য চেষ্টা ধরে ফেলতে পারেন।
আসলেই কার্যকর?
১৯২১ সালে যখন এর উদ্ভাবন হল তখন থেকেই পলিগ্রাফের বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে যন্ত্রটিকে চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তে হয়েছিল।
এটা কতোটা নির্ভুলভাবে কাজ করবে তা নিয়ে অনেক বিতর্ক রয়েছে।
অনেক বিশেষজ্ঞ মনে করেন, এর মৌলিক বিষয়ে ত্রুটি রয়ছে। এটা ছলচাতুরী ধরতে পারে না, যা এর মূল সমস্যা” এমনটাই মনে করেন অধ্যাপক অ্যালডার্ট ভ্রিজ। তিনি এই বিষয়ের ওপর প্রচুর লেখালেখি করেছেন।
“মিথ্যাবাদীরা প্রশ্নগুলোর উত্তর দেবার সময় উদ্দীপনা দেখায়, যা যারা সত্য বলছেন তারা করবেন না,” বলেন তিনি।
বিশেষজ্ঞ ড. সোফি ভান ডের জি বলেন, এটা কখনো কখনো নিষ্পাপ মানুষকেও অপরাধী বলে উপস্থাপন করতে পারে।
“ফলে যাদের এই পরীক্ষার মধ্য দিয়ে যেতে হয় তারা মানসিক চাপের মধ্য দিয়ে যাবেন। তাই মিথ্যা শনাক্ত করার ক্ষেত্রে এটি বেশ ভাল হলেও, সত্য শনাক্ত করার ক্ষেত্রে তা খুব একটা ভাল নয়,” বলেন তিনি।
তবে অধ্যাপক গ্রুবিন বলেন, কেন এই শনাক্তকরণ পরীক্ষা ভুল হতে পারে তার অনেক কারণ আছে। প্রশ্নগুলি দুর্বল হতে পারে এবং তার ফলে ফলাফল ভুল হতে পারে।
তিনি বলেন, “যদি পরীক্ষক প্রশিক্ষিত হযন, পরীক্ষা সঠিকভাবে পরিচালনা করা হয় এবং যদি সঠিক নিয়ন্ত্রণ থাকে তবে ৮০% -৯০% ক্ষেত্রে নির্ভুল উত্তর পাওয়া যেতে পারে।”
তবে বিশেষজ্ঞদের অনেকে বলেন, পলিগ্রাফির অনেক সীমাবদ্ধতা রয়েছে এবং বিভিন্ন কারণে এথেকে ভুল ফলাফল পাওয়া যেতে পারে।
-বিবিসি বাংলা
এই রকম সংবাদ আরো পেতে হলে এই লেখার উপরে ক্লিক করে আমাদের ফেসবুক ফ্যান পেইজে লাইক দিয়ে সংযুক্ত থাকুন। সংবাদটি সম্পর্কে মন্তব্য করতে হলে এই পেইজের নীচে মন্তব্য করার জন্য ঘর পাবেন