সিএনজির ছাদে গাছ লাগিয়ে ঢাকার পরিবেশ রক্ষার চেষ্টা
রাজধানী ঢাকা থেকে যখন একটু একটু করে সবুজ হারিয়ে যাচ্ছে, যখন ঘণ্টার পর ঘণ্টার যানজটে মোটামুটি স্থবির এই শহর, তখন সড়কের এক পাশ দিয়ে সবুজ গাছপালায় ছেয়ে থাকা একটি অটোরিকশাকে চলতে দেখলে সেটা খুব সহজেই নাগরিকদের নজর কাড়ে।
গাড়িতে পুরোপুরি ঠাসা রাস্তায় জ্যামের ভেতরে কদাচিৎ চোখে পড়বে তিন চাকার এই গাড়িটি যা ঢাকার মানুষের কাছে সিএনজি নামেই পরিচিত।
এই গাড়িটি দেখতে চমকে ওঠার মতো, সবুজ দেহের চারপাশে খাঁচার মতো লোহার গ্রিল লাগানো, কিন্তু এর ছাঁদের ওপরে আছে একগাদা সবুজ গাছ, সামান্য বাতাসেও যার লতাপাতা দুলে উঠছে।
শহরের বাড়ি ঘর ও কংক্রিকেটর তৈরি উঁচু উঁচু ভবনের ছাদে গাছপালা লাগানো গত কয়েক বছর ধরে শহুরে মানুষদের কাছে জনপ্রিয় হয়ে উঠলেও গাড়ির ছাদে এরকম গাছ লাগানো- খুব একটা চোখে পড়ে না।
কিন্তু এরকমই এক সিএনজির মাথায়, পরিবেশ রক্ষায় যে গাড়িটিকে বেবি ট্যাক্সির পরিবর্তে একসময় রাস্তায় নামানো হয়েছিল, এক ঝাঁকা সবুজ গাছ নিয়ে সেই অটোরিকশাটি ছুটে বেড়াচ্ছে শহরের এক মাথা থেকে আরেক মাথায়।
ছাদে গাছ নিয়ে তিন বছর ধরে ছুটছে এই গাড়িটি। চালক সাদেক আলী গাজী। যশোরের ঝিকরগাছার নবীনপুরের গ্রামের মানুষ তিনি। শহরে ছুটে আসার পর থেকে ঢাকার রাস্তায় সিএনজি চালাচ্ছেন ১৪ বছর হলো।
তিনি জানান, ২০১৪ সালে বাংলাদেশে একবার খুব গরম পড়েছিল। “তখন থেকেই ভাবছিলাম যে এতো গরম থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্যে কী করা যায়। সারাদিন গাড়িতে থাকি আমার তো কষ্ট হয়ই, গাড়িতে যেসব মা, বোন, মুরুব্বীসহ যেসব যাত্রী ওঠেন তাদেরও খুব কষ্ট হয়। তখন আমি ভাবলাম যদি একটু পরিবর্তন করা যেতে তাহলে ভালো হতো।”
এটা ভাবতে ভাবতেই তার মাথায় এলো- সিএনজির ছাদের ওপরে কিছু সবুজ গাছপালা লাগালে হয়তো তার যাত্রীদের গায়ে গরমের হলকা একটু কম লাগতে পারে। গাড়ির ভেতরে একটি ফ্যান লাগানোর কথাও ভাবলেন তিনি।
“ভেতরের গরম বাতাসটা একজস্ট ফ্যানের মাধ্যমে আউট করা হবে। তারপর উপরের গাছ থেকে যদি তাপমাত্রা দুই ডিগ্রি মায়নাস করা সম্ভব হয়, তাহলে ফ্যানের মাধ্যমে আরো তিন ডিগ্রি মায়নাস করা সম্ভব। তখন সব মিলিয়ে চার থেকে পাঁচ ডিগ্রি তাপমাত্রা মায়নাস হয়ে যাবে।”
সোমবার জাতিসংঘের জলবায়ু বিজ্ঞানীরাও বিশ্ব নেতাদের সতর্ক করে দিয়ে বলেছেন, পৃথিবীর বায়ুমণ্ডল যেভাবে উত্তপ্ত হয়ে উঠছে তাতে মানব সভ্যতা বড় রকমের বিপদের মুখে পড়তে পারে। আগে এই তাপমাত্রা ই ডিগ্রির বেশি বাড়তে না দেওয়ার কথা বলেছিলেন তারা। কিন্তু এখন এই সীমা দেড় ডিগ্রিতে নামিয়ে আনার কথা বলছেন তারা।
যেভাবে শুরু
সাদেক আলী গাজী জানান, প্রথম দিকে তার এই পরিকল্পনা খুব ভালোভাবে এগোয়নি কারণ সিএনজি মালিকের আপত্তি ছিল। কিন্তু পরের বছর থেকেই, ২০১৫ সাল থেকে ছাদের ওপরে গাছপালা নিয়ে তিনি রাস্তায় নেমে গেলেন।
তিনি বলেন, তার এই উদ্যোগকে এখন তার সিএনজির মালিক, যাত্রী, ট্রাফিক পুলিশ, পথচারী- সকলেই প্রশংসা করছেন।
“সাধারণ একটা জ্ঞানেই বোঝা যায়, বেশি ইঞ্জিনিয়ারিং জ্ঞান থাকার দরকার নাই। যেমন ধরুন রাস্তা দিয়ে হেঁটে যাচ্ছি সামনে একটা বৃক্ষ বা বটগাছ পেলাম। ওখানে গিয়ে বসলে পর কি তাপ একটু কম লাগে না আমাদের? গাছের নিচে বসে হয়তো একটু বেশি অক্সিজেন পেলাম। কিম্বা খুব ঘেমে গিয়েছিলাম তখন শীতল ছায়ায় বসলে ঘামটা একটু কমে গেল। এরকম তো হয়, তাই না?”
সম্প্রতি প্রকাশিত আন্তর্জাতিক কিছু গবেষণায় দেখা গেছে ঢাকায় বায়ু দূষণের মাত্রাও মারাত্মক পর্যায়ে গিয়ে পৌঁছেছে। এবছরেই বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বড় বড় শহরের বায়ু দূষণের ওপর যে জরিপ চালিয়েছে তাতে ঢাকা শহরের অবস্থান সবচেয়ে দূষিত শহরগুলোর তালিকার তিন নম্বরে।
সাদেক আলী গাজী জানান, ঢাকার পরিবেশের কথা ভেবেই তিনি এই উদ্যোগ নিয়েছিলেন। তার ধারণা তার এই “সামান্য চেষ্টা” হয়তো ঢাকার বাতাসকে কিছুটা হলেও বিশুদ্ধ করতে পারবে।
কী গাছ আছে ছাদে
মি. গাজী জানান, শুরুতে তার গাড়ির ছাদে তিনি লাগিয়েছিলেন কিছু পাতাবাহার গাছ। রাস্তায় চলতে গিয়ে আশেপাশের নার্সারি থেকে মানিপ্ল্যান্টের কিছু চারা কিনে লাগিয়েছেন তিনি। আরো পরে লাগিয়েছেন মিষ্টি আলুর লতা, কাল কিসিন্দা নামে লতা জাতীয় আরো একটি ঔষধি গাছ, আছে পাথরচুনা পাতা, কিছু ঘাসসহ নাম জানা না জানা আরো কিছু গাছপালা।
আজকাল বাড়িঘরের ছাদে নানা ধরনের গাছপালা লাগানো ঢাকা শহরের বাসিন্দাদের কাছে জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। কাঁচামরিচ কিম্বা পুইশাকের মতো ছোট ছোট গাছ নয়, আম, পেয়ারারও চাষ হচ্ছে।
কিন্তু মি. গাজী জানিয়েছেন তার কখনো শাক সবজি লাগানোর কথা মনে হয়নি। তবে তাকে অনেকেই সেরকম পরামর্শ দিয়েছিলেন।
তিনি জানান, শুরুর দিকে মালিকের আপত্তি থাকা সত্ত্বেও তিনি তার পরিকল্পনা থেকে পিছু হটেন নি। তার একাগ্রতা দেখে পরে মালিকও তাকে উৎসাহ দিতে শুরু করেন।
“মালিক প্রথমে এলাও করতে চাননি। তবে আমার অন্যান্য ভালো গুণের কারণে, যেমন সারাদিন কাজ করলেও তিনি জমা পুরা পান, আধা-বেলা কাজ করলেও জমা পুরা পান। তখন মহাজন হিসাব নিকাশ করে আর বাধার সৃষ্টি করেন নি।”
গাছের পরিচর্যা
সাদেক আলী গাজী ২০১৩ সাল থেকে ঢাকার মিরপুর থেকে ভাড়া নেওয়া এই একই সিএনজিটি চালিয়ে আসছেন। দুই কন্যা আর স্ত্রীকে নিয়ে তিনি সেখানেই থাকেন।
নিজে ‘এক কলম’ লেখাপড়া না করলেও বড় মেয়ে এখন অনার্সে পড়ছে, আর ছোট মেয়ে কলেজে। সিএনজি চালিয়েই চলে সংসার।
তিনি জানান, শুরুর দিকে তার দুই মেয়ে গাছের পরিচর্যা করার ব্যাপারে সাহায্য করতেন। কিন্তু তারা এখন পড়াশোনা নিয়ে খুব ব্যস্ত হয়ে পড়েছে। সেকারণে তিনি নিজেই পানি দেন, মরে যাওয়া পেতে ছাঁটেন, ছাঁদের ওপরে নতুন মাটি দেওয়ার মতো কাজগুলো করেন।
“এই যে এখন আপনার সাথে বলছি আর গাছের পরিচর্যা করছি। যখন একটু চায়ের দোকানে গেলাম তখন পানি দিলাম। নিজে যখন পানি খাই তখন গাছগুলোকেও একটু পানি খাওয়ালাম। গাড়িটা নিয়ে যখন সকাল সকাল বের হই, তখন পানি দেই, কাজ শেষে রাতে গাড়িটা জমা দেওয়ার সময়েও একটু পানি দেই,” বলেন তিনি।
মি. গাজী বলেন, “আমি তো লেখাপড়া শিখিনি কিন্তু আমার গাড়ির পেছনে ছন্দ মিলিয়ে একটা বয়ান লিখে দিয়েছি- গাছ লাগান, দেশ বাঁচান, দেশ ও জাতির সেবা করুন। একটি সন্তান জন্মের পূর্বে একটি গাছ কমপক্ষে হলেও লাগানোর চেষ্টা করুন। নিজের জায়গায় না হলেও সরকারি জায়গায় লাগান।”
‘পার্কে বসে যাচ্ছি’
তিনি বলেন, গাড়ির পেছন থেকে লোকজন যখন এই লেখাটা পড়েন তখন তাদের মনটা হয়তো একটু হলেও ভালো লাগে। তিনি জানান, তার যাত্রীদের বেশিরভাগই তার এই উদ্যোগের প্রশংসা করেছেন। তাদের মধ্যে দু’একজন অবশ্য তার গাড়িতে উঠতে চায় না বলেও তিনি জানান।
“বেশিরভাগ প্যাসেঞ্জার খুশি হন। বলেন, আরে আমি তো দেখছি গার্ডেনে বসে যাচ্ছি, পার্কে বসে বসে যাচ্ছি। সবুজ ছায়ার নিচে বসে রোড পারি দেওয়া হয়ে গেল।” তিনি আরো জানান, অনেকেই খুশি হয়ে তাকে বকশিসও দেন। “৫০টা টাকা বেশি দিয়ে তারা বলেন, ভাই, এই নেন, আপনি আরেকটা গাছ লাগিয়ে নিয়েন,” বলেন তিনি।
ছাদের ওপরে গাছপালার কারণে গাড়ি চালাতে অসুবিধা হয় কিনা বা ভারসাম্য রক্ষা করতে কোন সমস্যা হয় কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, ওগুলো ব্যবস্থাপনা করেই তিনি ‘রোডে’ নেমেছেন।
রাস্তায় ট্রাফিক পুলিশও তাকে খুব একটা ঝামেলা করে না। তবে মাঝে মধ্যে দু’একজন তার সাথে এনিয়ে মজা ঠাট্টা করেছেন। “গাড়ির ছাদে গাছ লাগানো হয়তো আইনে নাই। আইন মেনে চলতে হবে সেটাও ঠিক। কিন্তু বিষয়টা হলো হয়তো আইনে নাই, কিন্তু যেখানে সমাজ আছে, পরিবেশ আছে, জনগণ আছে, সেখানে এরকম একটা কাজ আইন আটকাবে বলে মনে হয় না।”
সাদেক আলী গাজী জানান, তার গাড়ি দেখে আরো কয়েকজন চালক তাদের সিএনজির ওপরেও গাছপালা লাগিয়েছেন।
তিনি বলেন, এই শহরে বসবাস করা অনেক যন্ত্রণার। এখানে তো খালি জায়গা নেই। যেখানেই একটু জায়গা পাওয়া যাবে, সেখানে দুএকটা গাছ লাগালে “গাছের ভালো অক্সিজেনটা আমরা নিলাম আর দূষিত অক্সিজেনটা গাছে গ্রহণ করলো। তাতে পরিবেশের যদি একটুখানিও উন্নতি হয় তাহলে অসুবিধা কী!”
-বিবিসি বাংলা
এই রকম সংবাদ আরো পেতে হলে এই লেখার উপরে ক্লিক করে আমাদের ফেসবুক ফ্যান পেইজে লাইক দিয়ে সংযুক্ত থাকুন। সংবাদটি সম্পর্কে মন্তব্য করতে হলে এই পেইজের নীচে মন্তব্য করার জন্য ঘর পাবেন