সেলাইয়ের কাজ করে ছেলেকে নায়ক বানানো এক মায়ের গল্প
২১ বছর আগে স্বামী মারা যাওয়ার পর প্রায় নিঃস্ব হয়ে পড়েছিলেন চার সন্তানের জননী সাফিয়া খাতুন (নারী উদ্যোক্তা)। কিন্তু ভেঙ্গে না পড়ে শক্তভাবে হাল ধরেছিলেন বলে আজ তিনি স্বাবলম্বী। একমাত্র আয়ের উৎস সেলাই মেশিন দিয়েই করেছেন ভাগ্য পরিবর্তন। আজ তার ছেলে-মেয়েরা প্রতিষ্ঠিত। ছোট ছেলে আশিক চৌধুরী বাংলাদেশ চলচ্চিত্রের একজন নায়ক।
কিন্তু এই সফলতা একদিনে আসেনি। নিজের বুদ্ধি, সাহস, মনোবল, সততা ও অদম্য ইচ্ছার সঙ্গে কঠোর পরিশ্রম ধীরে ধীরে তাকে নিয়ে যায় সাফল্যের পথে। বিশ্ব নারী দিবস কে সামনে রেখে মুন্সিগঞ্জের এমন এক সফল নারীর সফল হয়ে ওঠার গল্প থাকছে আজ জুমবাংলার পাঠকদের জন্য।
মুন্সীগঞ্জ শহরের খালইস্ট এলাকার সাফিয়া খাতুনের স্বামী শামসুল হক ছিলেন মুন্সীগঞ্জ জেলা রেজিস্ট্রার। স্বামী শামসুল হক মারা যান আজ থেকে ২১ বছর আগে। স্বামী মারা যাওয়ার পর প্রায় নিঃস্ব হয়ে পড়েছিলেন তিনি। ওই সময় চলার মতো ছিল না তার কাছে কোন টাকা । তিনি এক মেয়ে ও তিন ছেলেকে মানুষ করতে জীবনযুদ্ধে নামেন। সেলাই মেশিন দিয়ে তিনি সামনে এগিয়ে যেতে থাকেন, হস্ত ও কুটির শিল্পের কাজ শুরু করেন। ঘুরে দাঁড়াতে থাকে তার জীবনযুদ্ধের চাকা।
এখন নিজ বাড়িতে গড়ে তুলেছেন দুঃস্থ-বিধবা, স্বামী পরিত্যক্তা ও প্রতিবন্ধী নারীদের জন্য হস্ত ও কুটির শিল্পের প্রশিক্ষনশালা। পাশাপাশি ছেলেমেয়েদের স্বাবলম্বী করে প্রতিষ্ঠিত করেছেন সমাজে। বাড়ির উঠানের গন্ডি পেরিয়ে তিনি এখন সরকারি বেসরকারি বিভিন্ন পর্যায়ের প্রশিক্ষক হিসাবে দায়িত্ব পালন করেছেন। জীবন যুদ্ধের সংগ্রামে স্বামীকে পাশে না পেলেও তার কর্মঠ জীবনযাত্রা তাকে এগিয়ে নিয়ে গেছে বহুদূর।
এক মেয়েকে সৌদি প্রবাসী ছেলের সঙ্গে বিয়ে দেন। বড় ও মেজ ছেলে স্বাবলম্বী হয়ে সংসার আর কর্ম নিয়ে ব্যস্ত। ছোট ছেলে আশিক চৌধুরী বাংলাদেশ চলচ্চিত্রের একজন নায়ক। সেলাইয়ের কাজ করেই তিনি তার সন্তানদের মানুষ করেছেন। ছেলেকে নায়ক বানানোর পাশাপাশি অন্য সন্তানদের প্রতিষ্ঠিত করেছেন।
২০০৯ সালে তিনি শহরের খালইস্ট নিজ বাড়িতে দু:স্থ মহিলা কল্যাণ সমিতির মাধ্যমে প্রশিক্ষন দেওয়া শুরু করেন। দু:স্থ মহিলা কল্যাণ সমিতিতে ১৩০ জন নারী প্রশিক্ষন নিয়েছে। এখানে সাপ্তাহিক, পনেরো দিন ও মাসিক কোর্সে হস্ত ও কুটির শিল্পের কাজ শেখানো হয় দু:স্থ নারীদের। তার প্রশিক্ষনশালায় বেত দিয়ে ব্যাগ, পুতি দিয়ে ব্যাগ, শোপিচ দিয়ে আম, মাল্টা, আপেলসহ বিভিন্ন রকমের ফল, বাঁশ দিয়ে মোড়া তৈরি, পাটের টেবিল, ম্যাথ, পা-পোচ, ব্লক বাটিকের বেড কভার, থ্রিপিছ ও শাড়ি তৈরি করা হচ্ছে। তাঁর এসব পণ্য চীন মৈত্রী সম্মেলন কেন্দ্রের এসএমই ও সমবায় মেলায় স্টল নিয়ে বিক্রি করা হচ্ছে। এছাড়া মুন্সীগঞ্জ শিল্পকলা একাডেমি প্রাঙ্গণে নারী দিবস ও পহেলা বৈশাখের বৈশাখী মেলায় স্টল নিয়ে বিক্রি করা হয়। আবার অনেকে বাড়ি এসে কিনে নিয়ে যান।
সাফিয়া খাতুন মুন্সীগঞ্জ যুব উন্নয়ন অধিদপ্তরের একজন কনটেইনার হিসেবে কাজ করছেন। গ্রামে গ্রামে গিয়েও নারীদের হাতে কলমে কাজ শিখাচ্ছেন। নারীদের প্রশিক্ষন শেষ হওয়ার পর যুব উন্নয়নের মাধ্যমে সাটিফিকেট প্রদান করছেন। এরপর সার্টিফিকেটধারী নারীরা যুব উন্নয়ন থেকে ৫০ হাজার টাকা করে ঋণ নিতে পাচ্ছেন বলে সাফিয়া খাতুন জানালেন। তার দু:স্থ কল্যাণ সমিতি থেকে এ পর্যন্ত ৩০০ নারী প্রশিক্ষন নিয়ে স্বাবলম্বি হয়েছেন। জীবন যুদ্ধে সংগ্রামী নারী সাফিয়া খাতুন ২০১৩ সালে বেগম রোকেয়া দিবস উপলক্ষে জয়িতা হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছেন। তিনি ২০১৪ সালে সফল আত্মকর্মী হিসেবে যুব উন্নয়ন অধিদপ্তর থেকে প্রথম স্থান হয়েছেন।
সাফিয়া খাতুন জানালেন, এখন নারীরা আর ঘরে বসে নেই। সরকারি পৃষ্টপোষকতা, সহজ শর্তে ঋণ সুবিধা দেওয়া হলে কোন নারী আর দু:স্থ থাকবে না। ধৈর্য্য ও সংগ্রাম করে আমি সফল হয়েছি। আজ আমার ঘরে লাখ লাখ টাকার হস্ত ও কুটির শিল্পের বিভিন্ন রকমের মালামাল রয়েছে। ভবিষ্যতে আমার ইচ্ছা বৃহৎ আকারে হস্তশিল্পের শো-রুম করা এবং সরকারের সহায়তায় দেশের বাইরে নেপাল ও ভুটানের বিভিন্ন মেলায় অংশগ্রহণ করা।
এসব বিষয়ে প্রশিক্ষণার্থী জ্যোতি, সাবিনা, তুলি, কামরুন্নাহার, শাকিলা বেগম ও রোকসানা বেগম জানান, সাফিয়া খাতুনের প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে কাজ শিখে অনেকেই স্বাবলম্বী হয়েছেন এবং হচ্ছেন। যারা আগে কুটির ও হস্তশিল্পের কাজ জানতো না তারা আজ উপার্জনের পথ খুঁজে পেয়েছে। আমরাও এ কাজ শিখে স্বাবলম্বী হতে চাই। তাই এখানে প্রশিক্ষণ নিতে এসেছি। এছাড়াও প্রশিক্ষণ নিয়ে অনেকেই নিজ বাড়িতে ছোট আকারে একটি প্রশিক্ষনশালায় ভূমিকা রাখছে।
উপজেলা যুব উন্নয়ন কর্মকর্তা অঞ্জলী রাণী হাওলাদার জানান, সাফিয়া আমাদের অস্থায়ী নিয়োগপ্রাপ্ত একজন প্রশিক্ষক হিসাবে কর্মরত আছেন। তার দ্বারা শুধু একজন প্রশক্ষণারথীই স্বাবলম্বী হচ্ছেনা, পুরো যুব উন্নয়নের অগ্রযাত্রা সফল হচ্ছে। এছাড়া সমাজে নারীদের জায়াগাটি প্রতিষ্ঠিত হচ্ছে। পুরো জেলার বিভিন্ন সরকারি বেসরকারি প্রশিক্ষণ কর্মশালাগুলোতে তিনি প্রশিক্ষক হিসাবে দায়িত্ব পালন করেছেন। তাকে অনুসরণ করে অনেকেই যুব উন্নয়ন থেকে প্রশিক্ষণ ও ঋণ নিয়ে স্বাবলম্বী হচ্ছেন এবং সমাজে নিজেদেরকে প্রতিষ্ঠিত করছেন।
নারী নেত্রী হামিদা খাতুন জানান, তার সাহসী উদ্যোগ নারী সমাজে ব্যপক ভূমিকা অর্জন করেছে। অসহায় এবং সমাজের বোঝা হিসাবে যেসব নারীরা ঘড়ে বসে থাকতো তারা এখন আশার আল দেখছেন। নিজ এলাকার সীমানা পেরিয়ে তিনি এখন পুরো মুন্সীগঞ্জে সাফাল্য বয়ে নিয়ে এসেছেন। তাকে অনুসরণ করে নারীরা তাদের ভাগ্য পরিবর্তনের সাথে নিজদের করেছে প্রতিষ্ঠিত।
এই রকম সংবাদ আরো পেতে হলে এই লেখার উপরে ক্লিক করে আমাদের ফেসবুক ফ্যান পেইজে লাইক দিয়ে সংযুক্ত থাকুন। সংবাদটি সম্পর্কে মন্তব্য করতে হলে এই পেইজের নীচে মন্তব্য করার জন্য ঘর পাবেন