সাত দাবি পূরণের কোনো আভাস নেই, কী করবে ঐক্যফ্রন্ট
নতুন জোট জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট নিয়ে আলোচনা থাকলেও রাজনীতিতে দৃশ্যত কোনো চাপ নেই এর। বেগম খালেদা জিয়ার মুক্তি, নির্বাচনকালীন নির্দলীয় সরকার, নির্বাচন কমিশন পুনর্গঠনসহ তারা যে সাতটি দাবি করেছে, সেগুলোর কোনো একটিও মেনে নেয়া হবে- এ বিষয়ে সরকারের পক্ষ থেকে দূরতম কোনো ইঙ্গিতও নেই।
আবার দাবি আদায়ে জোরাল কর্মসূচির আভাসও নেই ঐক্যফ্রন্টের পক্ষ থেকে। এমনকি কী ধরনের কর্মসূচি দেয়া হবে, সে বিষয়েও কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি এখনও। নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার দুই সপ্তাহ বাকি থাকলেও নেতারা পরিস্থিতি অনুযায়ী ব্যবস্থার কথাই বলছেন।
এই দাবিগুলো নতুন নয়, বিএনপি আগে থেকেই দাবিগুলো জানিয়ে আসছে আর সরকার এবং ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে বহুবার জানানো হয়েছে সংবিধানের বাইরে গিয়ে নির্বাচন নিয়ে চিন্তার সুযোগ নেই।
আর নির্বাচন নিয়ে বিরোধের সূত্রপাত তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল নিয়ে। উচ্চ আদালত তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থাকে অসাংবিধানিক ঘোষণার পর আওয়ামী লীগের গত মেয়াদে সংবিধান সংশোধন করে নির্বাচিত সরকারের অধীনে নির্বাচনের ব্যবস্থা ফিরিয়ে আনা হয়। আর এর প্রতিবাদে বিএনপি-জামায়াত জোট এবং সমমনারা ২০১৪ সালের দশম সংসদ নির্বাচন বর্জন করে।
সেই নির্বাচন ঠেকানো এবং ২০১৫ সালে সরকার পতনের ‘চূড়ান্ত আন্দোলনে’ নেমে ব্যর্থতার পর দৃশ্যত সরকারকে চাপ দেয়ার ক্ষমতা হারায় বিএনপি।
আর এরপর থেকে ঘুরে দাঁড়াতে নানা চেষ্টার মধ্যে গত ১৩ অক্টোবর ড. কামাল হোসেনের জাতীয় ঐক্য প্রক্রিয়া, নাগরিক ঐক্য এবং জেএসডি মিলে গঠন করা হয় জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট।
এই ঐক্যের আলোচনা যখন শুরু হয়, তখন বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছিলেন তারা ঐক্য গড়ে তিন দিনে সরকারের পতন ঘটাবেন।
এর মধ্যেই আগামী জাতীয় নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার সময় জানিয়েছে নির্বাচন কমিশন। নভেম্বরের শুরুতেই কমিশন জানিয়ে দেবে ভোট কবে হবে আর এ জন্য মনোনয়নপত্র জমা দেয়ার শেষ সময় কবে।
অর্থাৎ হাতে সময় দুই সপ্তাহের মধ্যে। আর এই সময়ে সংলাপের কোনো সম্ভাবনা উড়িয়ে দিয়েছেন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের।
এর মধ্যে ঐক্যফ্রন্টের সমাবেশের তারিখ ঘোষণা হয়েছে, তাও ঢাকার বাইরে। যদিও ২৩ অক্টোবর সিলেটে জমায়েতের অনুমতি না পেয়ে কর্মসূচি একদিন পিছিয়েছে ঐক্যফ্রন্ট।
সাত দফা দাবি মেনে নেয়ার বিষয়ে তো কোনো আভাস নেই, এই অবস্থায় কী করবেন- এমন প্রশ্নে ঐক্যফ্রন্টের নেতা জাফরুল্লাহ চৌধুরী বলেন, ‘আমাদের দাবি না মালে আমাদেরেই লাভ হবে।’
-‘সেটা কেমন?’
-‘তারা সব কিছুই করল, কিন্তু সুষ্ঠু নির্বাচন হলো না। ওটাও তো আমাদেরই বিজয়। তবে আমাদের নিয়ে সরকার আলোচনা করছে, আলোচনা হচ্ছে কিন্তু সেটা ফরমালি নয়।’
‘ঐক্যফ্রন্টকে সরকার ভয় পাচ্ছে এ জন্য তারা বিভিন্ন কথা বলছে। তোফায়েল আহমেদ বলছেন ড. কামালের সামর্থ্য জানা আছে। এখন কথা হলো, তোফায়েল স্বতন্ত্র থেকে দাঁড়ালে তিনি কি পাস করতে পারবেন? আর তিনি যা বলছেন তা হলো কথার কথা। এই কথার কথা না বলাই ভালো। আমরা জনগণকে নিয়ে কাজ করছি, জনগণকে না জানিয়ে কিছু করব না।’
জাফরুল্লা অবশ্য তাদের কিছু দাবি মেনে নেয়ার আভাস পাচ্ছেন। তিনি বলেন, ‘আমাদের সাত দফা সরকার মেনে নেবে না আমি এভাবে ভাবতে চাই না। আমি যদি উল্টো করে ভাবি তবে আমাদের দুই দফা তো সরকার মেনেই নিয়েছে। নির্বাচনে সেনাবাহিনী নিয়োগ করতে হবে, সেটা সরকার আমলে নিয়ে বলছে এটা নির্বাচন কমিশন দেখবে।’
‘আমরা নির্বাচনের আগে সংসদ ভেঙে দিতে বলছিলাম, তারা সেটা মানা করছে না। এ ছাড়া খালেদার মুক্তির বিষয়টি নিয়ে তারা নাকচ করে দিচ্ছে না, তারা আইনানুগ প্রক্রিয়ায় মুক্তির কথা বলছে। সে কারণে এ বিষয় নিয়ে চিন্তা করছি না। আমার চিন্তা অন্য জায়গায়, সরকার তার কথা রাখছে না।’
কোন কথা রাখছে না- এমন প্রশ্নে ঐক্যফ্রন্ট নেতা বলেন, ‘সরকার কথা দিয়েছিল নির্বাচনের আগে কেবিনেট ছোট করা হবে। কিন্তু সে বিষয়ে কিছু আসছে না। সেই কেবিনেটে নিরপেক্ষ প্রতিনিধি নেয়ার কথা বলেছিল, কিন্তু সে বিষয়ে কিছু লক্ষ্য করা যাচ্ছে না। তবে সরকার যদি কিছুই না মানে, তবে লাভ হবে না।’
একই প্রশ্নে জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের ঘোষণাপত্র পাঠকারী নাগরিক ঐক্যের নেতা মাহমুদুর রহমান মান্না বলেন, ‘আমরা দেশে একটি সুষ্ঠু গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের জন্য সাত দফা দবি উত্থাপন করেছি। আমাদের দাবি বাস্তবায়নের জন্য সরকারকে চাপ দিতে থাকব। আমাদের দাবি না মানা হলে তখন অবস্থা বুঝে ব্যবস্থা নেব।’
সরকারকে কীভাবে চাপ দেবেন- জানতে চাইলে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য খন্দকার মোশররফ হোসেন বলেন, ‘আমরা আমাদের দাবি নিয়ে জনগণের কাছে যাচ্ছি, আরও যাব। আমাদের দাবি যখন মানবে না, তখন পরিস্থিতি বুঝে আমরা কর্মসূচি দেব।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য মুহাম্মদ ফারুক খান এমপি বলেন, ‘জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের ৭ দফা নিয়ে আমাদের বক্তব্য স্পষ্ট। আগামী নির্বাচনে আইনবিরুদ্ধ কোনো কিছু হবে না। এ নিয়ে আলোচনারও কিছু নেই। দেশের আইন ও সংবিধান মোতাবেক আগামী নির্বাচন হবে।’
নির্বাচনে সেনাবাহিনী মোতায়েন নিয়ে বিএনপি-জামায়াত রাজনীতি করার চেষ্টা করছে জানিয়ে তিনি বলেন, ‘সেনা মোতায়েন নিয়ে বিএনপি-জামায়াত রাজনীতি করার চেষ্টা করছে। তারা এটা নিয়ে অযথা রাজনীতি করার চেষ্টা করছে। আওয়ামী লীগ কখনোই সেনাবাহিনী মোতায়েনের বিপক্ষে কথা বলে না। নির্বাচনে সেনাবাহিনী মোতায়েন হবে কি হবে না সেটা দেখবে নির্বাচন কমিশন।’
‘সংবিধান মোতাবেক সেনাবাহিনী কাজ করবে। সেটা সংবিধানে স্পষ্ট উল্লেখ আছে। যদি নির্বাচন কমিশন চায় এবারও তাই হবে।’
যা আছে সাত দাবিতে
১. অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের লক্ষ্যে সরকারের পদত্যাগ, জাতীয় সংসদ বাতিল, সকল রাজনৈতিক দলের সাথে আলোচনা সাপেক্ষে নির্বাচনকালীন নির্দলীয় সরকার গঠন একং সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়াসহ সকল রাজবন্দীর মুক্তি ও মিথ্যা মামলা প্রত্যাহার করতে হবে।
২. গ্রহণযোগ্য ব্যক্তিদের সমন্বয়ে নির্বাচন কমিশন পুনর্গঠন, নির্বাচনে ইভিএম ব্যবহার না করার নিশ্চয়তা প্রদান করতে হবে।
৩. বাক, ব্যক্তি, সংবাদপত্র, টেলিভিশন, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ও সকল রাজনৈতিক দলের সভা-সমাবেশের স্বাধীনতা এবং নির্বাচনে লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড নিশ্চিত করতে হবে।
৪. কোটা সংস্কার আন্দোলন, নিরাপদ সড়কের দাবিতে শিক্ষার্থীদের আন্দোলন সাংবাদিকদের আন্দোলন এবং সামাজিক গণমাধ্যমে স্বাধীন মত প্রকাশের অভিযোগে ছাত্র-ছাত্রী, সাংবাদিকসহ সবার বিরুদ্ধে দায়েরকৃত হয়রানিমূলক মামলা প্রত্যাহার ও গ্রেপ্তারকৃতদের মুক্তির নিশ্চয়তা দিতে হবে। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনসহ সকল ‘কালো আইন’ বাতিল করতে হবে।
৫. নির্বাচনের ১০ দিন পূর্ব থেকে নির্বাচনের পর সরকার গঠন পর্যন্ত ম্যাজিস্ট্রেসি ক্ষমতাসহ সেনাবাহিনী মোতায়েন করতে হবে এবং আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী নিয়োজিত ও নিয়ন্ত্রণের পূর্ণ ক্ষমতা নির্বাচন কমিশনের ওপর ন্যস্ত করতে হবে।
৬. নির্বাচনের স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতে দেশি ও আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষক নিয়োগের ব্যবস্থা নিশ্চিত করা এবং সম্পূর্ণ নির্বাচন প্রক্রিয়া পর্যবেক্ষণে ভোট কেন্দ্র, পুলিং বুথ, ভোট গণনাস্থল ও কন্ট্রোল রুমে তাদের প্রবেশের ওপর কোনো প্রকার বিধি-নিষেধ আরোপ না করা। নির্বাচনকালীন গণমাধ্যম কর্মীদের ওপর যেকোনো ধরনের নিয়ন্ত্রণ বন্ধ করতে হবে।
৭. নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার তারিখ থেকে নির্বাচনের ফলাফল চূড়ান্তভাবে প্রকাশিত না হওয়া পর্যন্ত চলমান সব রাজনৈতিক মামলা স্থগিত রাখা ও কোনো ধরনের নতুন মামলা না দেয়ার নিশ্চয়তা প্রদান করতে হবে। সৌজন্যে : ঢাকাটাইমস।
এই রকম সংবাদ আরো পেতে হলে এই লেখার উপরে ক্লিক করে আমাদের ফেসবুক ফ্যান পেইজে লাইক দিয়ে সংযুক্ত থাকুন। সংবাদটি সম্পর্কে মন্তব্য করতে হলে এই পেইজের নীচে মন্তব্য করার জন্য ঘর পাবেন