চমক থাকছে মন্ত্রিসভায়, আসছে নতুন মুখ

একাদশ সংসদ নির্বাচনে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পাওয়ার পর টানা তৃতীয়বারের মতো মন্ত্রিসভা গঠন করতে যাচ্ছে আওয়ামী লীগ। এর মধ্য দিয়ে চতুর্থবার প্রধানমন্ত্রীর পদে আসীন হচ্ছেন দলটির সভাপতি বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা।

আধুনিক ও উন্নত রাষ্ট্র গড়ার অঙ্গীকারে এবার মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী ও উপমন্ত্রী নিয়োগে ‘গতানুগতিক’ রীতি অনুসরণ করবেন না তিনি।

এক্ষেত্রে বিভিন্ন সময়ে দল ও বিভিন্ন সংস্থা পরিচালিত জরিপে উঠে আসা নেতাদের দক্ষতা, ত্যাগ, বিচক্ষণতা ও নেতৃত্বসহ সার্বিক কর্মকাণ্ড বিবেচনা করা হচ্ছে।

এসব যোগ্যতার মাপকাঠিতে নবীন ও প্রবীণদের সমন্বয়ে গঠিত হচ্ছে নতুন মন্ত্রিসভা।

এতে বাদ পড়ছেন বিতর্কিত, অদক্ষ ও বয়সের ভারে ন্যুব্জ বেশ কয়েকজন বর্তমান মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী ও উপমন্ত্রী। আর মন্ত্রিসভায় স্থান পেতে যাচ্ছেন কয়েকজন নতুন মুখ ও সাবেক মন্ত্রী। থাকছে টেকনোক্র্যাট কোটাতেও কয়েকজন।

সব মিলিয়ে এবারের মন্ত্রিসভায় প্রকৃত অর্থেই বড় ধরনের চমক থাকছে বলে মন্তব্য করেছেন ক্ষমতাসীন দলের একাধিক নীতিনির্ধারক।

প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় ও মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, আগামী সপ্তাহের শুরুর দিকে মন্ত্রিসভার শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠান হবে। এক্ষেত্রে রোববার হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি।

নিয়ম অনুযায়ী নির্বাচন কমিশন থেকে নবনির্বাচিত সংসদ সদস্যদের নামে গেজেট প্রকাশের পর তাদের শপথ পড়ানো হবে। এরপর সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের সংসদ সদস্যরা বৈঠক করে সংসদীয় দলের নেতা নির্বাচন করবেন।

রাষ্ট্রপতি সংসদীয় দলের ওই নেতাকে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ পড়াবেন। পাশাপাশি মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী, উপমন্ত্রীরাও রাষ্ট্রপতির কাছে শপথ নেবেন।

এরপর মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী ও উপমন্ত্রীদের দফতর বণ্টন করবেন প্রধানমন্ত্রী।

গত রোববার একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। ২৯৯টি আসনের মধ্যে ২৯৮টি আসনের ফলাফল ঘোষণা করেছে নির্বাচন কমিশন।

প্রাপ্ত ফলাফলে দেখা গেছে, ২৮৮টি আসনের মধ্যে আওয়ামী লীগ ২৫৯, জাতীয় পার্টি ২০, ওয়ার্কার্স পার্টি ৩, জাসদ ২, বিকল্পধারা ২, তরিকত ফেডারেশন ১, জেপি ১টিতে বেসরকারিভাবে জয়ী হয়েছে। বিএনপি জোট অর্থাৎ জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট পেয়েছে মাত্র সাতটি (বিএনপি ৫, গণফোরাম ২) আসন। স্বতন্ত্রসহ অন্যরা জয় পেয়েছে ৩টি আসনে।

এর আগে ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি বিএনপির বর্জনের মধ্যেই দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন হয়। ১২ জানুয়ারি গঠিত হয় নতুন মন্ত্রিসভা। তখন শেখ হাসিনাকে প্রধানমন্ত্রী করে ৪৮ সদস্যবিশিষ্ট নতুন মন্ত্রিসভা গঠন করা হয়। ওই সরকারে প্রধানমন্ত্রী ছাড়া ২৯ মন্ত্রী, ১৭ প্রতিমন্ত্রী এবং দু’জন উপমন্ত্রী ছিলেন। পরে কয়েক দফা মন্ত্রিসভায় রদবদল আনা হলেও শেষ পর্যন্ত মন্ত্রিসভার আকার দাঁড়ায় ৫২ সদস্যের।

আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারণী সূত্রে জানা গেছে, এবারের মন্ত্রিসভার কলেবর বাড়ছে। তরুণদের স্থান দিতে গিয়ে এই কলেবর বাড়ানোর চিন্তা করছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ইতিমধ্যে বিভিন্ন খাতে অভিজ্ঞ নেতাদের একটি সংক্ষিপ্ত তালিকাও প্রস্তুত করা হয়েছে।

এই তালিকায় চমকে দেয়ার মতো কিছু নাম আছে। আছে প্রবাসীও। এমপি নন এমন বেশ কয়েক নেতাও আছেন। আছেন ব্যবসায়ী, সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্বও। তৃণমূলের দু’জন নেতার নাম আছে এই তালিকায়। একঝাঁক তরুণকে স্থান দিতে অনেক পুরনোকে বাদের তালিকায় রাখা হয়েছে।

জানা যায়, বৃহস্পতিবার (৩ জানুয়ারি) সকাল ১১টায় একাদশ জাতীয় সংসদে নির্বাচিত নতুন এমপিদের শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠিত হয়। মঙ্গলবার রাতে নবনির্বাচিত এমপিদের গেজেট প্রকাশ করা হয়েছে। এরপর মন্ত্রিসভা গঠনে রাষ্ট্রপতির অনুমতির জন্য আজই প্রধানমন্ত্রী বঙ্গভবনে যেতে পারেন।

আওয়ামী লীগ সূত্র জানায়, প্রবীণদের প্রতি গতানুগতিক যে অগ্রাধিকার পাওয়ার রীতি এতদিন মন্ত্রিসভায় চলে আসছিল তা এবারের মন্ত্রিসভায় থাকছে না।

বড় বড় মেগা প্রকল্প বাস্তবায়ন, আইসিটিতে বিশ্বের সঙ্গে তাল মেলানো ও ডিজিটাল খাতে বাংলাদেশকে বিশ্বের রোল মডেল হিসেবে পরিচিত করতে নতুনদেরই এগিয়ে রাখছে আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেন, মন্ত্রিসভায় চমক আসছে। তবে সেটা এখনই বলা যাবে না। আগামী ১০ জানুয়ারির মধ্যেই এই নতুন মন্ত্রিসভা গঠিত হবে।

আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারণী সূত্রে জানা যায়, জাতীয় সংসদের স্পিকার হিসেবে বর্তমান স্পিকার শিরীন শারমিন চৌধুরী পুনরায় এই পদে নিয়োগ পেতে পারেন।

সূত্র আরও জানায়, মন্ত্রিসভায় আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক খালিদ মাহমুদ চৌধুরী স্থান পেতে পারেন।

এছাড়া নতুনদের মধ্যে পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিসেবে অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতের ছোট ভাই একে আবদুল মোমেন, প্রতিমন্ত্রী হিসেবে শ ম রেজাউল করিম, স্বাস্থ্য প্রতিমন্ত্রী ডা. আবদুল আজিজ, স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী পুলিশের সাবেক আইজিপি নূর মোহাম্মদ, সাংস্কৃতিক প্রতিমন্ত্রী আকবর হোসেন পাঠান ওরফে নায়ক ফারুকের নাম শোনা যাচ্ছে। এছাড়া নুরুল মজিদ মাহমুদ হুমায়ুন, উপাধ্যক্ষ আবদুস শহীদ, গোলাম দস্তগীর গাজী, নূর ই আলম চৌধুরী লিটন, দীপংকর তালুকদার, জাহিদ আহসান রাসেল স্থান পেতে পারেন নতুন মন্ত্রিসভায়। আ ম উবায়দুল মোক্তাদীর চৌধুরী; প্রয়াত রাষ্ট্রপতি জিল্লুর রহমানের ছেলে নাজমুল হাসান পাপন, ডা. হাবিবে মিল্লাত, ঢাকা মহানগর উত্তর আওয়ামী লীগের সভাপতি একেএম রহমতুল্লাহ; জাতীয় নেতা তাজউদ্দীন আহমদের কন্যা সিমিন হোসেন রিমি; জাতীয় সংসদের চিফ হুইপ আ স ম ফিরোজ মন্ত্রিসভায় স্থান পেতে পারেন। টেকনোক্রেট কোটায় অর্থনীতিবিদ ড. ফরাসউদ্দিনকেও মন্ত্রিসভায় স্থান দেয়া হতে পারে বলে শোনা যাচ্ছে।

আরও জানা গেছে, দলের প্রেসিডিয়াম সদস্য, সাবেক খাদ্যমন্ত্রী আবদুর রাজ্জাক, সাবেক বাণিজ্যমন্ত্রী লে. কর্নেল (অব.) ফারুক খান ও সাবেক স্বাস্থ্যমন্ত্রী শেখ ফজলুল করিম সেলিমের নাম আলোচনায় আছে।

দলের মনোনয়নবঞ্চিত হয়েছেন যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক- জাহাঙ্গীর কবীর নানক ও আবদুর রহমান এবং সাংগঠনিক সম্পাদক- আফম বাহাউদ্দিন নাছিম ও বিএম মোজাম্মেল হক।

এদের মধ্যে যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক থেকে টেকনোক্রেট কোটায় একজন মন্ত্রী বা প্রতিমন্ত্রী ও সাংগঠনিক সম্পাদক থেকে একজনকে প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ সহকারী করা হতে পারে।

এর বাইরে থাকা দুই যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুবউল আলম হানিফ ও ডা. দীপু মনির মধ্যে একজনের ঠাঁই হতে পারে নতুন মন্ত্রিসভায়।

মহাজোটের সরকার হলে জাতীয় পার্টির কো-চেয়ারম্যান, লালমনিরহাট-৩ আসন থেকে নির্বাচিত সংসদ সদস্য জিএম কাদের নতুন মন্ত্রিসভায় যুক্ত হওয়ার সম্ভাবনা আছে।

এর আগে ২০০৯ সালে গঠিত আওয়ামী লীগ সরকারে তিনি বেসরকারি বিমান ও পর্যটনমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেন।

তবে জাতীয় পার্টির একটি নির্ভরযোগ্য সূত্রে জানা যায়, জিএম কাদেরের বিরোধীদলীয় নেতা হওয়ার সম্ভাবনা আছে। সেক্ষেত্রে জাতীয় পার্টি থেকে কাজী ফিরোজ রশীদ মন্ত্রিসভায় স্থান পেতে পারেন।

এ বিষয়ে জিএম কাদের বলেন, মন্ত্রিসভায় কারা স্থান পাবে সে সিদ্ধান্ত নেবেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিনি (শেখ হাসিনা) যদি জাতীয় পার্টিকে মন্ত্রিসভায় আমন্ত্রণ জানান সেক্ষেত্রে আমরা আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নেব।

আওয়ামী লীগের একটি নির্ভরযোগ্য সূত্র জানায়, নিখাদ বিরোধী দল হিসেবে জাতীয় পার্টিকে এবার সংসদে চায় তারা। এজন্য মন্ত্রণালয় বণ্টন নিয়ে এখনও আলোচনায় আসেনি জাতীয় পার্টি।

বর্তমান মন্ত্রিসভায় ১৪ দলীয় জোটের শরিক বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেনন ও জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলের সভাপতি হাসানুল হক ইনু রয়েছেন। এবারও তাদের থাকার সম্ভাবনা আছে।

তবে ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক ও রাজশাহী-২ আসনের পরপর তিনবারের নির্বাচিত সংসদ সদস্য ফজলে হোসেন বাদশার নামও শোনা যাচ্ছে।

বর্তমান মন্ত্রিসভায় ৪৪ জন মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী ও উপমন্ত্রী আছেন। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় সূত্রে জানা যায়, এর মধ্যে বাদ পড়ার তালিকায় আছেন অনেকেই।

অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত, বস্ত্র ও পাটমন্ত্রী মুহা. ইমাজউদ্দিন প্রামাণিক, পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী, প্রাথমিক ও গণশিক্ষামন্ত্রী মোস্তাফিজুর রহমান, ভূমিমন্ত্রী শামসুর রহমান শরীফ, মৎস্য ও প্রাণিসম্পদমন্ত্রী নারায়ণ চন্দ্র চন্দ, বেসামরিক বিমান ও পরিবহন এবং পর্যটনমন্ত্রী একেএম শাহজাহান কামালও বাদ পড়তে পারেন।