বাংলাদেশে বাণিজ্যিক স্বার্থের কারণেই কি চুপ জার্মানি?


বিশ্বের বিভিন্ন দেশে গণতন্ত্র আর বাকস্বাধীনতা নিয়ে জার্মানিকে মাঝেমাঝেই সোচ্চার হতে দেখা যায়৷ তবে, বাংলাদেশের সর্বশেষ জাতীয় নির্বাচন নিয়ে তেমন একটা উচ্চবাচ্য করেনি দেশটি৷ এর পেছনে কি কোনো বাণিজ্যিক স্বার্থ রয়েছে?


জার্মানির রাজধানী বার্লিনভিত্তিক আন্তর্জাতিক বেসরকারি সংগঠন ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল৷ বাংলাদেশের সর্বশেষ জাতীয় নির্বাচনকে দুর্নীতিবিরোধী এই সংগঠনটি আখ্যা দিয়েছিল ‘প্রশ্নবিদ্ধ, অভূতপূর্ব এবং অবিশ্বাস্য’ হিসেবে৷ ২৯৯ আসনে অনুষ্ঠিত নির্বাচনটির ৫০টি আসনের নির্বাচনি প্রক্রিয়ার ওপর এক পরিবীক্ষণের ফলাফলে ৪৭টিতেই ব্যাপক অনিয়মের প্রমাণ পেয়েছে সংগঠনটি৷

ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনালের এই পর্যবেক্ষণের সঙ্গে বাংলাদেশের বেশ কয়েকটি রাজনৈতিক দল এবং নির্বাচন পর্যবেক্ষকের দাবির মিল রয়েছে৷ তাদের দাবি ছিল, ত্রিশ ডিসেম্বরের নির্বাচনের আগের রাতেই ক্ষমতাসীন দলের পক্ষে অনেক ভোটকেন্দ্রে ব্যালট বাক্স পূর্ণ করা হয়েছে৷ আর এ কাজে সহায়তা করেছে প্রশাসন এবং নিরাপত্তা বাহিনী৷ ফলে পরেরদিন অনেক প্রকৃত ভোটার ভোট দেয়ারই সুযোগ পাননি৷ এসব দাবির সপক্ষে অনেক তথ্যপ্রমাণ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেও নানাভাবে এসেছে৷

জাতীয় নির্বাচনের ফলাফলও ছিল বেশ চমকপ্রদ৷ দেখা গেছে, ক্ষমতাসীন দল এমন সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়েছে, যা সাধারণত উত্তর কোরিয়ার মতো একনায়কতান্ত্রিক দেশে প্রত্যাশিত৷ কিন্তু এমনটা ঘটেছে বাংলাদেশে, যা অনেকের বিবেচনাতেই বাস্তবসম্মত ছিল না৷

আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম তাই বাংলাদেশের নির্বাচন নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে৷ প্রকৃত ভোটাররা যে নির্বাচনে ভোট দিতে না পারার অভিযোগ তুলেছেন, সেটাও প্রকাশ হয়েছে৷ কিন্তু লক্ষ্যণীয় হচ্ছে, নির্বাচন নিয়ে এত অনিয়ম, ভোট জালিয়াতির অভিযোগ উঠলেও আন্তর্জাতিক সমাজ, বিশেষ করে যেসব দেশ গণতন্ত্র এবং বাকস্বাধীনতাকে গুরুত্বপূর্ণ মনে করে, সেভাবে কড়া প্রতিক্রিয়া দেখায়নি৷ বরং ধীরে ধীরে সেই নির্বাচনে নির্বাচিত সরকারকেই তারা মেনে নিয়েছে এবং সর্বাত্মক সহায়তার হাত বাড়িয়ে দিয়েছে৷

বাংলাদেশের জাতীয় নির্বাচনের পর পরিস্থিতিটা যে এমন হতে পারে সেই আভাসটা আগেই দিয়েছিলেন প্রখ্যাত আলোকচিত্রী এবং মানবাধিকার কর্মী শহীদুল আলম৷ ডয়চে ভেলেকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি তখন বলেছিলেন, ‘‘পশ্চিমা দেশগুলো বিশৃঙ্খল গণতন্ত্রের চেয়ে অনুগত একনায়ককে পছন্দ করে৷”

এই আনুগত্যের বিষয়টি যখন আসে, তার সঙ্গে অর্থনৈতিক বিষয়াদি সংযুক্ত হয়৷ বাংলাদেশের সঙ্গে ভারত এবং চীনের সম্পর্ককে অনেকেই অর্থনৈতিক দিক থেকে বিবেচনা করেন৷ কারো হিসেবে ভারত বাংলাদেশের কাছ থেকে বর্তমানে ব্যাপক ব্যবসায়িক সুবিধা পাচ্ছে৷ কেননা, বাংলাদেশের কিছু উন্নয়ন প্রকল্পে ভারতের বিনিয়োগ যেমন রয়েছে, তেমনি বাংলাদেশে করা প্রকল্পের সুবিধাভোগী হিসেবেও ভারতের নাম রয়েছে৷ পাশাপাশি চীনও বাংলাদেশে নানা প্রকল্পের সঙ্গে সম্পৃক্ত আছে৷ এমনকি দেশটি যে ঋণ দিচ্ছে সেই ঋণ শোধ করতে না পারলে ভবিষ্যতে বাংলাদেশের একটি বন্দরের পুরো দখল সেদেশ নিয়ে নিতে পারে– এমন শঙ্কাও রয়েছে৷

প্রশ্ন উঠতে পারে, বাংলাদেশের সঙ্গে লাভজনক অর্থনৈতিক সম্পর্ক গড়া দেশগুলোর তালিকায় কি জার্মানিও যোগ হচ্ছে? ইউরোপীয় ইউনিয়নের অন্যতম শক্তিশালী এই দেশটি অতীতে বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে কড়া মন্তব্য করেছে৷ ২০১৪ সালের জাতীয় নির্বাচনের পর সেদেশের ‘কিছু এলাকা রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেছে’ বলেও মন্তব্য করেছিলেন ঢাকায় নিযুক্ত তৎকালীন জার্মান রাষ্ট্রদূত ড.আলব্রেশট কনৎসে৷ তবে, গত দুই-তিন বছরে বাংলাদেশের রাজনৈতিক অবস্থা, বিশেষ করে গণতন্ত্রের ক্রমাবনতি নিয়ে জার্মানিকে প্রতক্ষ্য বা পরোক্ষ্যভাবে সোচ্চার হতে দেখা যায়নি৷

আর সর্বশেষ নির্বাচনের গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে যখন নানা মহল থেকে প্রশ্ন উঠছিল, তখনও জার্মানি ইউরোপীয় ইউনিয়নের একটি বিবৃতির মাঝেই নিজেকে সীমাবদ্ধ রেখেছে৷ এমনকি দেশটির পররাষ্ট্র নীতি বিষয়ক সংসদীয় কমিটির প্রধান ড. নরবার্ট ব়্যোটগ্যান বাংলাদেশের নির্বাচনে ভোট জালিয়াতির ব্যাপকতা দেখে বিস্ময় প্রকাশ করেছেন৷ তিনি বাংলাদেশ ক্রমশ একদলীয় ব্যবস্থায় পরিণত হচ্ছে বলে মন্তব্য করে এই বিষয়ে সোচ্চার হতে ইউরোপীয় সরকারগুলোর প্রতি আহ্বানও জানিয়েছেন৷ তবে, তাঁর এই আহ্বানও জার্মানি আমলে নিয়েছে বলে দৃশ্যত মনে হয়নি৷

বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক পরিস্থিতি নিয়ে জার্মানির এই নীরবতা এমন এক সময়ে ঘটছে, যখন দেশটিতে জার্মানির ব্যবসা, বাণিজ্য ও বিনিয়োগ ক্রমশ বাড়ছে৷ ইতোমধ্যে দক্ষিণ এশিয়ার দেশটিতে বিদুৎকেন্দ্র নির্মাণ, ই-পাসপোর্টসহ একাধিক বড় প্রকল্পের কাজ পেয়েছে ইউরোপের দেশটি৷ গত কয়েক মাসে সহস্রাধিক জার্মান ব্যবসায়ী বাংলাদেশ সফর করেছেন৷ আরো অনেকে সফর করছেন৷ ফলে এক্ষেত্রে একটি বিষয় পরিষ্কার যে, বাংলাদেশের প্রতি জার্মান ব্যবসায়ীদের আগ্রহ অতীতের যে-কোনো সময়ের তুলনায় এখন বেশি৷ এটা অনেক দিক দিয়ে যেমন ইতিবাচক, তেমনি ‘ক্রমশ স্বৈরতান্ত্রিক দেশে’ রূপ নেয়া একটি দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি সম্পর্কে গণতন্ত্রের শক্ত সমর্থক একটি দেশের নীরবতা কি হতাশাজনক নয়? -ডয়চে ভেলে