বিবিসি’র প্রতিবেদন
আমেরিকা নির্বাচন ২০২০: টুইটারে ভোট প্রতারণার গুজব যেভাবে ছড়ালো
ইন্টারনেটে দেয়া একটি বিভ্রান্তিকর পোস্ট কীভাবে প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের টুইটার অ্যাকাউন্টে গিয়ে পৌঁছল?
বুধবার আমেরিকান সময় সকালের দিকে ভোট জালিয়াতির অভিযোগ করে ভুল একটি বার্তা পোস্ট করা হয়েছিল মিশিগান শহরে।
কয়েক ঘন্টার মধ্যে সেই মেসেজ ভাইরাল হয়ে যায় এবং পৌঁছে যায় প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের টুইটার অ্যাকাউন্টের ফিডে।
ঘটনা ঘটেছিল এভাবে
মিশিগানে ভোটের ম্যাপ
মিশিগান একটি ব্যাটলগ্রাউন্ড রাজ্য। সেখানে ভোটদান সম্পর্কিত একটি তথ্য বিবরণী ম্যাপে ভুল করে দেখানো হয় যে জো বাইডেনের পক্ষে এক লাখ ৩৮ হাজার ভোট যোগ হয়েছে। কিন্তু তাতে দেখা যায়, ওই একই সময়ের মধ্যে ডোনাল্ড ট্রাম্পের ঝুলিতে একটিও বাড়তি ভোট যোগ হয়নি।
যে স্ক্রিনশটটি পোস্ট করা হয়েছিল, সেটি নির্বাচনী তথ্য সংক্রান্ত একটি সংস্থা থেকেই এসেছিল, কিন্তু তাদের তথ্য ছিল ভুল। সোজা কথায়, তথ্য তোলার সময় তাতে ভুল হয়েছিল।
নির্বাচনী তথ্য বিশ্লেষণের কাজ করে ডিসিশন ডেস্ক নামে যে সংস্থাটি ওই ম্যাপ পোস্ট করেছিল, তারা বলছে: “এটা সরাসরি একটা ভুল ছিল। ওই রাজ্য থেকে যে নথিতে ভোটের তথ্য পাঠানো হয়েছিল সেটিই আমরা আমাদের সিস্টেমে উঠিয়েছিলাম। পরে মিশিগান কর্তৃপক্ষের ভুলটি চোখে পড়ে এবং তারা নতুন করে গণনার আপডেট পাঠায়।”
ওই ভুল তারা দ্রুত সংশোধন করলেও সামাজিক মাধ্যমে ভুল তথ্য সম্বলিত ম্যাপটি ছড়িয়ে পড়তে সময় নেয়নি।
এমনিতেই ভিত্তিহীন ভোট জালিয়াতির খবর নিয়ে সামাজিক মাধ্যমে তখন সোরগোল উঠতে শুরু করেছে। তাতে বিরাট ইন্ধন জোগায় ভোটের এই ভুল ম্যাপটি।
সেটা ভাইরাল হল কীভাবে
বিবিসি তার অনুসন্ধানে দেখেছে, কোনরকম ভোট জালিয়াতি হয়েছে এমন তথ্য তুলে ধরতে এই তথ্য বিবরণী সম্বলিত ম্যাপটি ব্যবহার করা হয়েছে বুধবার চৌঠা নভেম্বর জিএমটি সময় সকাল ১০:৩৭এ। তার আগে এই ম্যাপ তোলা হয়েছে এমন কোন পোস্ট বিবিসি পায়নি।
এইট কুন নামে যে ওয়েবসাইট এই ম্যাপটি ওই সময় পোস্ট করেছিল সেটি কট্টর ডানপন্থী ভাষা এবং মতামতে ভর্তি একটি ওয়েবসাইট। কট্টর দক্ষিণপন্থী এবং ষড়যন্ত্র তত্ত্বে উদ্বুদ্ধ গোষ্ঠী কিউঅ্যানোনের সদস্যদের কাছে এই ওয়েবসাইট খুবই জনপ্রিয়।
কিউঅ্যানোন বিশ্বাস করে শয়তান চক্রের সদস্য উপর মহলের কিছু মানুষ যারা শিশু যৌন নিপীড়নকারী তাদের বিরুদ্ধে গোপন যুদ্ধ চালাচ্ছেন ডোনাল্ড ট্রাম্প।
এর প্রায় আধ ঘন্টা পর জিএমটি ১০:৫৬ য়ের মধ্যে এই ম্যাপটি টুইটারে প্রথম শেয়ার করা হয়। যে অ্যাকাউন্ট থেকে এটি পোস্ট করা হয় তাতে পেপে নামে একটি ব্যাঙের মুখের ছবি দেয়া ছিল। এটি কট্টর ডানপন্থীদের মধ্যে সামাজিক মাধ্যমে ব্যবহারের জন্য জনপ্রিয় একটি প্রতীক। এই পোস্টে বেশ জোরের সাথে ইঙ্গিত করা হয় যে ভোট নিয়ে একধরনের জালিয়াতি বা চালাকি করা হচ্ছে, সেখানে তথ্য ভুল হওয়া নিয়ে কোন কথাই বলা হয়নি।
এর অল্পক্ষণ পর থেকেই নাম-পরিচয়বিহীন বিভিন্ন অ্যাকাউন্ট থেকে এই ম্যাপের ছবি ছড়ানো শুরু হয়ে যায়। এর শেয়ারের সংখ্যা উল্লেখযোগ্যভাবে বেড়ে যায়। একই সময় দক্ষিণপন্থীদের কাছে জনপ্রিয় বেশ কিছু অনলাইন প্ল্যাটফর্মে এই ছবি শেয়ার করা শুরু হয়।
জিএমটি দুপুর দুটোর অল্প পরেই রক্ষণশীল রিপাবলিকান ম্যাট ম্যাকুইয়াক এটি রি-টুইট করেন, যেটি তার ৩৬ হাজার অনুসারী পরে শেয়ার করেন। মি. ম্যাকুইয়াক পরে তার টুইটার অ্যাকাউন্ট থেকে এটি মুছে দেন এবং দু:খপ্রকাশ করেন। এই ভুল ম্যাপের স্ক্রিনশট নিয়ে ডানপন্থীদের প্রভাবিত করার মত অনেক ওয়েবসাইটে এটি শেয়ার করা হয়।
মি. ম্যাকুইয়াক বিবিসিকে পরে বলেন, “আমি জানি না এই এইট কুন কারা”। তিনি বলেন তিনি রক্ষণশীলদের একটি সংবাদ ওয়েবসাইটের অ্যাকাউন্ট, দ্য ফেডারেলিস্ট-এ এই ম্যাপটি দেখেছিলেন।
“আমার এটাকে একটা অসঙ্গতি মনে হয়েছিল। আমি কখনও এমন তথ্য দেখিনি যে গণনায় সব ফল ১০০% একজন প্রার্থীর পক্ষে গেছে,” টুইটারে লেখেন মি. ম্যাকুইয়াক। “তবে যখনই জানলাম একটি কাউন্টি তাদের ফলাফলের তথ্য সংশোধন করে দিয়েছে, তখন সাথে সাথে আমিও তা সংশোধন করে দিই।”
কিন্তু তাতে এই ম্যাপটি ভাইরাল হওয়া ঠেকানো যায়নি। ততক্ষণে এই ম্যাপ ভাইরাসের মত দ্রুত ছড়িয়ে পড়েছে সামাজিক মাধ্যমে। রক্ষণশীল একজন লেখক ম্যাট ওয়ালশ মি. ম্যাকুইয়াকের প্রথম টুইটটি তার ৫ লাখের বেশি অনুসারীর সাথে শেয়ার করেন।
বুধবার গ্রেনিচ মান সময় বিকেল ৩টা ৩৫ মিনিটে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প মি. ওয়ালশের টুইটটি শেয়ার করতে শুরু করেন। তিনি লেখেন: “এসব কী ঘটছে?”
এই ম্যাপ কতদূর ছড়িয়েছে?
সামাজিক মাধ্যমে বিভ্রান্তিকর তথ্য ছড়ানো এবং সংবাদমাধ্যমকে নিজের স্বার্থে ব্যবহার করার বিষয়টি তদন্ত করে অ্যালিথিয়া গ্রুপ নামে একটি সংগঠন। এর বিশ্লেষণ বিভাগের ভাইস প্রেসিডেন্ট সিন্ডি অটিস এই পোস্টটি কোন্ পথে ছড়িয়েছে তা নিশ্চিত করেছেন। তিনি বলছেন সামাজিক মাধ্যমে একটা অতি সাধারণ অ্যাকাউন্ট থেকে পোস্ট করা কোন তথ্য শীর্ষ পর্যায়ের ব্যক্তিদের অ্যাকাউন্টে পৌঁছনর ঘটনা এটা প্রথম নয়।
“একটা প্রান্তিক, স্বল্প পরিচিত ওয়েবসাইট এইটকুনে ভুল কন্টেন্ট ও ষড়যন্ত্রের যে বীজ বপন করা হয়েছিল, সেটা সামাজিক মাধ্যমের মূল ধারায় চলে আসার এটি আরেকটি ঘটনা এবং আমরা দেখলাম কীভাবে আমেরিকার নির্বাচিত নেতাদের, এমনকী খোদ প্রেসিডেন্টের জন্যও কীভাবে এই ভুল তথ্য একটা আলোচনার বিষয়বস্তু হয়ে উঠল,” বলছেন মিজ অটিস।
তিনি বলছেন, “এই নির্বাচন নিয়ে যে বিপুল পরিমাণ ভুয়া তথ্য আমরা ছড়াতে দেখছি, যেখানে প্রতারণা ও জালিয়াতি নিয়ে ভুয়া দাবি করা হয়েছে, সেগুলো হয়েছে নির্বাচনী প্রক্রিয়া এবং ভোট গণনার প্রক্রিয়া নিয়ে তথ্য ও জ্ঞানের অভাবের কারণে।”
প্রথম সারির অনেকগুলো সংবাদমাধ্যম এবং যারা তথ্য যাচাইয়ের কাজ করেন তারা এই ভুলের ব্যাপারটা উল্লেখ করার বা ভুয়া খবর নিয়ে খবর করার পরেও কিন্তু ভুয়া ছবি, এবং এই ম্যাপটির স্ক্রিনশট অনলাইনে ছড়িয়ে পড়া থেমে যায়নি।
এই ভুয়া ছবি এবং অভিযোগ নিয়ে যেসব টুইট ভাইরাল হয়েছে, সেগুলো সঠিক নয় বলে টুইটার লেবেল করে দিয়েছে এবং সেগুলো শেয়ার করাও তারা সীমিত করেছে।
তার পরেও এই ম্যাপটি কয়েক হাজার বার শেয়ার হয়েছে শুধু টুইটার এবং ফেসবুকেই।
এই ম্যাপের ছবি ছড়িয়েছে ইনস্টাগ্রাম এবং রেডিটে এবং এমনকি জার্মান, পর্তুগিজ, রুশ ও স্প্যানিশ ভাষাসহ বিভিন্ন ভাষার প্ল্যাটফর্মেও এটি প্রচুর শেয়ার হয়েছে।
খবর : বিবিসি
এই রকম সংবাদ আরো পেতে হলে এই লেখার উপরে ক্লিক করে আমাদের ফেসবুক ফ্যান পেইজে লাইক দিয়ে সংযুক্ত থাকুন। সংবাদটি সম্পর্কে মন্তব্য করতে হলে এই পেইজের নীচে মন্তব্য করার জন্য ঘর পাবেন