কিংবদন্তির এমন বিদায়?

মাশরাফী বিন মোর্ত্তজা। বাংলাদেশের ক্রিকেটে এক উজ্জ্বল নক্ষত্র। কিন্তু নিষ্ঠুর বাস্তবতায় এখন তিনি মেঘে ঢাকা জ্যোৎস্না। অথচ তার নেতৃত্বে বাংলাদেশ ক্রিকেট সর্বোচ্চ সাফল্যের গল্প রচনা করেছে। কিন্তু সব অর্জন এখন অতীত। বয়স আর ফিটনেসের দোহাই দিয়ে বলা হচ্ছে, ভবিষ্যত প্রজন্মের ক্রিকেটার তৈরি করতে ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে ওয়ানডে সিরিজে বিবেচনায় রাখা হয়নি মাশরাফীকে।

আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বাংলাদেশের ক্রিকেটে এ পর্যন্ত যত বিজয়ের গল্প রচনা হয়েছে, তার বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই মাশরাফীর অবদান অস্বীকার্য। ২০১৪ সালে বাংলাদেশ ক্রিকেট দলের ওয়ানডে ও টি-টোয়েন্টি এই দুই ফরমেটের দায়িত্ব পেয়ে ক্রিকেট বিশ্বে বাংলাদেশকে বড় দলে পরিণত করেছিলেন নড়াইলের এই মানুষটি।

২০১৬ সালে টি-টোয়েন্টি ফরম্যাটের এশিয়া কাপে পাকিস্তান ও শ্রীলঙ্কাকে হারিয়ে ফাইনালে তুলেছিলেন মাশরাফী। অথচ ২০১৭ সালের শ্রীলঙ্কা সফরে কোচ চান্ডিকা হাথুরাসিংহে বলেছিলেন, আগামীর টি-টোয়েন্টি দলে মাশরাফীকে নিয়ে দোটানায় আছেন। হাথুরুর এমন কথা আত্মসম্মানে আঘাত হানে ম্যাশের। কলম্বোতে চলতি সিরিজে সিদ্ধান্ত নেন আন্তর্জাতিক সার্কিটে টি-টোয়েন্টি থেকে অবসর নেবেন। যেমন কথা তেমন কাজ। আচমকাই কলম্বোর প্রেমাদাসা স্টেডিয়ামে বিদায় বলে দিলেন। প্রেমহীন সেই প্রেমাদাসায় শেষ টি-টোয়েন্টিতে জিতেছিল মাশরাফীর বাংলাদেশ।

এরপর ঘরোয়া টি-টোয়েন্টিতে বিপিএল আসরে রংপুর রাইডার্সের দায়িত্ব নিয়ে সে আসরে দলকে চ্যাম্পিয়ন করে জানান দিয়েছিলেন শুধু হাথুরু নয়, টি-টোয়েন্টি থেকে মাশরাফীকে বিদায়ের জন্য যারা ইন্ধন দিয়েছিলেন তারা কতোটা ভুলে ভরা। সর্বশেষ বঙ্গবন্ধু টি-টোয়েন্টি আসরেও ৩৭ বছর বয়সী ম্যাশের ফিটনেস নিয়ে প্রশ্ন তুলেছিলেন কেউ কেউ। কিন্তু এ আসরেই ক্যারিয়ার সেরা পাঁচ উইকেট নেওয়ার সাথে দলকে চ্যাম্পিয়ন করার ক্ষেত্রে ম্যাশের অবদান সবার জানা।

ফিরছি ওয়ানডে ফরম্যাটে বদলে ফেলা বাংলাদেশের গল্পে। ২০১৪ সালে অধিনায়কের দায়িত্ব পাবার পরপরই মাশরাফীর সামনে অস্ট্রেলিয়ার বিরুদ্ধে বিশ্বকাপ চ্যালেঞ্জ। ইংল্যান্ডের মতো ফেবারিট দলকে হারিয়ে বিশ্বকাপে এখন পর্যন্ত বাংলাদেশের সর্বোচ্চ সাফল্য কোয়ার্টার ফাইনালে খেলা। সেমিফাইনালের স্বপ্ন ভারত বিশ্ব আসরে চুরি করলেও, ঘরের মাটিতে প্রতিশোধ নেয় মাশরাফীর বাংলাদেশ।

শক্তিশালী ধোনির ভারতের বিপক্ষে ওয়ানডে সিরিজ জয়ের পর পাকিস্তান আর দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষেও সেই সাফল্য এখনো মধুর। র‌্যাংকিংয়ে উপরের দিকে উঠে যায় বাংলাদেশ ক্রিকেট দল। সেই থেকে ওয়ানডে ফরম্যাটে ক্রিকেট বিশ্বে বাংলাদেশ হয় পরাশক্তির দল।

২০১৮ সালের এশিয়া কাপ; আরেকটা ফাইনাল। সেবারও হয়নি ট্রফি জয়। হৃদয় ভাঙে সবার। অবশেষে ২০১৯ বিশ্বকাপের আগে বহুজাতিক ট্রফি ধরা দেয় আয়ারল্যান্ডের মাটিতে ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে ত্রিদেশীয় ট্রফি জয়ের মধ্যে দিয়ে। তৃষ্ণা মেটে বাংলাদেশের ক্রিকেট সমর্থকদের ট্রফি জয়ের।

২০১৯ ইংল্যান্ড বিশ্বকাপ। মাশরাফীর নেতৃত্বে এ দেশের ক্রিকেট পাগল মানুষগুলো স্বপ্ন বুনে, টাইগাররা খেলবে বিশ্ব আসরে সেমিফাইনালের মঞ্চে। লন্ডনের কেনসিংটন ওভালে দক্ষিণ আফ্রিকাকে হারিয়ে সে স্বপ্নের শক্ত ভিত্তি পায়। কিন্তু বোলার মাশরাফী ছিলেন প্রাণহীন। পুরো আসরে ৭ ম্যাচের একটিতেও ১০ ওভার পূর্ণ বোলিং করতে পারেননি। শিকার করেছিলেন মাত্র এক উইকেট।

গোল্ড ফিশ যেমন ১৫ সেকেন্ড পরপর সব ভুলে যায়, তেমন অনেক ক্রিকেট পণ্ডিতরাও ভুলে গেলেন বাংলাদেশের ক্রিকেটে মাশরাফীর সব অবদান। গুঞ্জন ওঠে মাশরাফীর বিদায়ের। ফর্মটাও বেইমানি করেছিল বিশ্বকাপ জুড়ে। তাই রাগে ক্ষোভে পাকিস্তানের বিপক্ষে বিশ্বকাপের শেষ ম্যাচে বিদায় বলেই দিয়েছিলেন। কিন্তু অনেক নাটকীয়তার পর মাঠে নেমেছিলেন ম্যাশ।

দেশে ফেরার পর বোর্ড কর্তারা জানতে চেয়েছিলেন কি করবেন ম্যাশ। তিনি জানিয়েছিলেন খেলা চালিয়ে যাবেন। তাই ব্যক্তিত্ব সম্পন্ন মাশরাফী গেল বছরে জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে ওয়ানডে সিরিজে অধিনায়কত্ব আনুষ্ঠানিকভাবে ছেড়ে দেন। সেটাই হয়তো মাশরাফী নামের ক্রিকেট হিমালয়ের শেষ আন্তর্জাতিক ম্যাচ হয়ে গেছে!

৮৮ ওয়ানডেতে বাংলাদেশ ক্রিকেট দলকে নেতৃত্ব দিয়ে ঠিক ৫০ ম্যাচে এ দেশকে জিতিয়েছেন। করোনার কারণে ১০ মাস পর আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে বাংলাদেশ। কিন্তু কঠিন বাস্তবতায় ম্যাশকে দল থেকে বাদ দেওয়া হয়েছে। এই প্রথম ২০ বছরের ক্যারিয়ারে অফ ফর্মের জন্য দল থেকে বাদ পড়লেন মাশরাফী।

এমন এক ক্রিকেট ব্যক্তিত্বের এভাবে বিদায় যেন নিষ্ঠুর কোনো গল্পের পাণ্ডুলিপির জন্ম। একজন মাশরাফী দেশের জন্য গর্বের কতোই না উপলক্ষ এনে দিয়েছিলেন। কিন্তু এমন একজন কিংবদন্তির বিদায়টা কি একটু অন্য রকম হতে পারতো না, যা কিনা ওই আগামী প্রজন্মের জন্যই? সৃষ্টি হতে পারতো ক্রিকেট থেকে বিদায় নেওয়ার নতুন সংস্কৃতির। মাশরাফীর বেলায় যখন হয়নি! আর কবে হবে?