‘নিজের পতন ঠেকাতেই সুপরিকল্পিতভাবে ফিলিস্তিনে হামলা নেতানিয়াহুর’

দুই বছরে চতুর্থবার নির্বাচনের পরও প্রয়োজনীয় সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জনে ব্যর্থ হয় ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনয়ামিন নেতানিয়াহুর দল লিকুদ পার্টি। গত ২৩ মার্চ সবশেষ নির্বাচনেও নেতানিয়াহুর লিকুদ পার্টি সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জনে ব্যর্থ হয়। এরপর গত ৬ এপ্রিল নেতানিয়াহুকে সরকার গঠনের অনুমতি দেন প্রেসিডেন্ট রিউভেন রিভলিন। ৪ মে পর্যন্ত তাকে সরকার গঠনে সময় বেধে দেওয়া হয়।

সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জনে ব্যর্থ হওয়া ছাড়াও নেতানিয়াহুর বিরুদ্ধে ঘুষ, জালিয়াতিসহ বিশ্বাস ভঙ্গের নানা অভিযোগ রয়েছে।

এসব কারণে অনেক দলের প্রধান তার সঙ্গে জোট গঠন তো দূরের কথা, আলোচনায় বসতেও রাজি হচ্ছিলেন না। ফলে আবার ক্ষমতায় আসার পথ অনেকটা কঠিন হয়ে উঠছিল প্রায় এক যুগ ধরে ক্ষমতায় থাকা নেতানিয়াহুর জন্য।

অবশেষে ৫ মে তিনি প্রেসিডেন্টের অফিসকে জানিয়ে দেন, তিনি সরকার গঠন করতে পারবেন না।

দেশটির প্রেসিডেন্ট রিউভেন রিভলিন যখন অন্য দলকে সরকার গঠনের জন্য ডাকবেন তখনই জেরুজালেমে মুসলমানদের পবিত্র মসজিদ আল আকসায় হামলার ঘটনা ঘটে।

গত ১০ মে থেকে জেরুজালেমের আল-আকসা মসজিদ প্রাঙ্গণে বিক্ষোভরত ফিলিস্তিনি নাগরিকদের ওপর ইসরায়েলি বাহিনী হামলা চালায়। প্রতিবাদে ইসরায়েলে রকেট হামলা চালায় হামাস। জবাবে গাজায় বিমান হামলা করে ইসরায়েলের সামরিক বাহিনী। পাল্টাপাল্টি হামলায় দুই পক্ষেরই ক্ষতির মাত্রা বাড়ছে। গত কয়েক বছরে এমন তীব্র হামলা আর দেখেনি বিশ্ব। দেশ দুটি পূর্ণমাত্রার যুদ্ধের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে বলেও আশঙ্কা করা হচ্ছে। বিশ্বনেতারা দুই পক্ষকেই শান্ত থাকার অনুরোধ করছেন।

রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলে মনে করছেন, নেতানিয়াহু নিজের পতন ঠেকানোর জন্য সুপরিকল্পিতভাবে এই পরিস্থিতি সৃষ্টি করিয়েছেন। তিনি এটাই চেয়েছিলেন। এমন একটি পরিস্থিতি সৃষ্টি করতে চেয়েছিলেন, যেখানে সমস্যা সমাধানে তাকে প্রয়োজন হবে।

খোদ ইসরায়েলিরাও মনে করছেন, নেতানিয়াহু ইচ্ছাকৃতভাবে ক্ষমতায় থাকার জন্য জাতীয় নিরাপত্তা ইস্যুতে নতুন এ সংকট তৈরি করেছেন।

জেরুজালেমভিত্তিক রাজনৈতিক বিশ্লেষক মিশেল বারাক বলেন, ‘এখন যা ঘটছে, নেতানিয়াহু ঠিক এটাই চেয়েছিলেন। এটা এমন একটি সংকটময় মুহূর্ত, যখন আপনি প্রধানমন্ত্রী বা প্রতিরক্ষামন্ত্রীকে বদলাতে চাইবেন না। কারণ সংকটের ঠিক মাঝখানে এমন বদল ভালো কিছু বয়ে আনে না। ফলে যুদ্ধের ডামাডোলে নতুন সরকার গঠন, নেতানিয়াহুকে ক্ষমতা থেকে সরানোর মতো কাজগুলো অধরাই থেকে যেতে পারে।’

সমালোচক লুইস ফিশম্যান বলছেন, ‘এ বিপর্যয় অনুমানযোগ্য ছিল। বহু বছর ধরে এ আচরণ করে আসছেন ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী। বছরের পর বছর ধরে ইসরায়েলে বসবাসরত ফিলিস্তিনিদের ওপর নৃশংস ও বৈষম্যমূলক আচরণ করে আসছেন তিনি। দীর্ঘ সময়ের দমন এ সংঘাতের ক্ষেত্র তৈরি করেছে।’

প্রায় একই কথা উঠে এসেছে রয়টার্সের এক বিশ্লেষণে। সেখানে বলা হয়, ইসরায়েলে এ পরিস্থিতর কারণে বিরোধীরা নেতানিয়াহুকে ক্ষমতাচ্যুত করার যে পরিকল্পনা করছিল তা ভেস্তে যেতে পারে।

বিশ্লেষকরা বলছেন, ইসরায়েল-ফিলিস্তিন এ সংঘাতের কারণে নেতানিয়াহু ক্ষমতায় থাকার জন্য রাজনৈতিক পদক্ষেপ নিতে কিছু বাড়তি সময় হাতে পেলেন। যে মুহূর্তে প্রথম আঘাতটি হানা হলো, সেটিই নতুন জোট সরকার গঠনের কফিনে শেষ পেরেক মেরে দিল আর নেতানিয়াহু পেয়ে গেলেন নতুন প্রাণ।

ইসাবেল কার্সনার নিউইয়র্ক টাইমসে লিখেছেন, যখন অস্ত্র কথা বলে, অজ্ঞাত কারণে তখন ইসরায়েলের অভ্যন্তরীণ রাজনীতি নীরব থাকে। যখন দেশ যুদ্ধের দ্বারপ্রান্তে চলে যায়, তখন সরকারের তীব্র সমালোচনা করা বিরোধীরাও সরকারের চারপাশেই ঘোরাফেরা করে। এ দাঙ্গা সৃষ্টির কারণেই নেতানিয়াহুকে যত দ্রুত সম্ভব ক্ষমতা থেকে সরিয়ে দেওয়া উচিত।

জেরুজালেম বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজনীতি বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক রেভেন হাজান বলেন, ‘যখন আকাশ থেকে ক্রমান্বয়ে রকেট হামলা চালানো হচ্ছে, সময় ধীরে ধীরে ফুরিয়ে যাচ্ছে। ঠিক সেসময় বসে জোট গঠনের আলোচনা করা খুবই কঠিন কাজ। এমনিতেই নতুন সরকার গঠনের আলোচনা যথেষ্ট জটিল। বর্তমান সহিংস পরিস্থিতি তাকে আরো জটিল করে তুলেছে। তবে এটি নেতানিয়াহুর পক্ষে লাভজনক হয়েছে।’

অবশ্য এই সংঘাতের পেছনে আরও অনেকগুলো কারণ দাঁড় করাচ্ছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা।
দ্য গার্ডিয়ানের এক বিশ্লেষণে বলা হচ্ছে, এটি ইরানের ষড়যন্ত্র হতে পারে। হামাস ও ইসলামি জঙ্গিদেরও দুষছেন কেউ কেউ। তবে যত যা-ই হোক, নেতানিয়াহুর দিকেই দোষের ভার বেশি দেখা যাচ্ছে।