শৈশবের বৃষ্টি : কাদা মাখা পানিতে ফুটবল খেলা

বৃষ্টি আসলেই ফুটবল নিয়ে মাঠে নেমে পড়তাম;কাদা আর বৃষ্টির মাঝে খেলার মজাটাই ছিল আলাদা। বৈশাখ-জ্যৈষ্ঠ মাস এলেই কৃষকের মুখে হাসি ফুটে। এ সময় গ্রামে-গঞ্জে শুরু হয় ধান কাটা উৎসব। কৃষকেরা মহা-আনন্দে ধান কেটে রোদে শুকিয়ে সেগুলো গোলায় ভরে। ধান কাটার পর্ব শেষ হলে ধানের ক্ষেতগুলো একদম ফাঁকা হয়ে যায়। তখন ধানের ক্ষেতগুলোতে ফুটবল খেলার হিড়িক পড়ত। আমরা ধান ক্ষেতগুলোকে ফুটবল খেলার মাঠ হিসেবে ব্যবহার করতাম। ধান ক্ষেতেই চলতো আমাদের সকাল-বিকাল ফুটবল খেলা। বর্ষার জোয়ারের পানি না আসা-পর্যন্ত ধান ক্ষেতই তখন হয়ে উঠত ফুটবল খেলার মাঠ। আমাদের কাছে তখন কৃষকের ধান ক্ষেতই ছিল ফুটবল খেলার স্টেডিয়াম। অনেক সময় গায়ে কাদা লেগে এমন অবস্থা হত- নিজেই নিজেকে চিনতে পারতাম না; মনে হত যেন এক কাদার ম‚র্তি। কাদায় খেলতে গিয়ে যে,কতবার হাত-পায়ে ব্যথা পেয়েছি,তার কি কোন হিসাব আছে?

একবার ডিলার বাড়ির লাল দলের সাথে খেলা হচ্ছিল। আমি ছিলাম মধ্য মাঠের খেলোয়ার।।জাম্বুরা দিয়ে খেলা হবে।তাই আগে থেকেই প্রমাণ সাইজের একটি জাম্বুরা, গাছ থেকে পেড়ে রান্নার পর চুলায় নেভানো আগুনে খানিক্ষণ রেখে নরম করে রেখেছি। বিকেল বেলা স্কুল থেকে এসেই খেলা শুরু হয়ে গেল। সাথে সাথেই শুরু হয়ে গেল ঝুম বৃষ্টি। প্রথমে ঝিরঝিরে বৃষ্টি ছিল।। কয়েকজন দর্শক ও ছিলেন। তারাও বৃষ্টি ভিজে খেলা দেখার প্রস্তুতি নিয়ে এসেছেন। এর মধ্যে আব্দুল মতিন অন্যতম। তিনি বলে­ন,” কাচিসাইর দিয়ে তুইরা-মাইরা বৃষ্টি হচ্ছে। ”দাঁতের সমস্যার কারণে কথাটি ভালভাবে বুঝা যাচ্ছিল না। তাই পরবর্তীতে ছেলেরা সবাই আব্দুল মতিন টুডে বলে ভেংচি কাটতো। তিনিও ক্ষেপে গিয়ে আমাদেরকে তেড়ে আসতেন। মাঝে মাঝে মা-বাবার কাছে বিচার দিতেন। ঐদিন প্রচুর বৃষ্টি হচ্ছিল। তাই আমরা সবাই ভিজে গিয়েছিলাম। তবে কোন দিন ভেজা বা কর্দমাক্ত মাঠে খেলার সময় আমরা সহজে ভিজতে চাইতাম না। শুকনো যায়গায় খেলার চেষ্টা করতাম। তখন একটি অলিখিত নিয়ম ছিল কেউ যদি গায়ে কাদা না মাখিয়ে খেলতে চায় তাকে কাদা-পানি ছিটিয়ে দেয়া যাবে। এক্ষত্রে আবুল খায়ের এগিয়ে ছিল। সে সবাইকে ভিজিয়ে দিত। সবাই কাদা-পানিতে ভিজে যাওয়ার পর অবশ্য খেলা জমে উঠতো।।খেলার শেষ পর্যায়ে আমাদের সবুজ দলের খেলোয়াররা খেলার ব্যাপরে আরো সচেতন হলাম। কেননা ইতিমধ্যে আমাদের কাঁধে দু -দুটি গোলের বোঝা। গোল পরিশোধের জন্য আমরা মরিয়া হয়ে উঠলাম। আমি ছিলাম মিঢ ফিল্ডার। বিপক্ষ দলের সেলিম কাকা আরো একটি গোল দেয়ার জন্য এগিয়ে আসছিলেন। আমি তড়ি-গড়ি করে তাকে বাধা দিতে গিয়ে বল দখলের চেষটা করি। তিনি ছিলেন আমার সিনিয়র। তার সামনে সাধারণত কোন খেলোয়ার যেতে চাইতেন না। উনি দ‚র থেকে গোল করার জন্য সজোড়ে কিক করতেই কাদায় পিছলে সে কিক জাম্বুরা বলে না লেগে আমার ডান পায়ে লাগে। আমি উঃ বলে মাটিতে পড়ে গেলাম।
খেলা শেষে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে বাড়িতে গেলাম।

বাড়ির দক্ষিণ দিক দিয়ে প্রবেশ করার সময় আম গাছের নীচে বাবার সাথে দেখা। এ যেন ”যেখানে বাঘের ভয় সেখানে রাত হয়।” বাবা যাতে বুঝতে না পারে খুব কষ্ট করে ভাল করে হাঁটার চেষ্টা করলাম। কিন্তু শেষ পর্যন্তধরা খেয়ে গেলাম। বাবা প্রথমে সেই রকম একটা বকা দিলেন।
একটু পরে আবার কাছে ডেকে নিয়ে বলে­ন, দেখি কোথায় ব্যথা পেয়েছিস, কতবার না করেছি বৃষ্টির মাঝে খেলতে যাইস না,কথাই শুনস না;যা সরিষার তেল আর রসুন নিয়ে আয়, চামচে নিয়ে গরম করে লাগিয়ে দেই।’রসুনের তেলে ব্যাথা তেমন একটা কমেনি। রাতে জামবাক মালিশ করে কোন রকমে ঘুমাবার চেষ্টা করলাম। ামবাক নামের ব্যাথার মালিশ অঅগে থেকেই কিনে রেখেছিলাম। কারণ, প্রতিনিই টুকটাক ব্যাথা পেতামকিন্তু কেউ বুঝতে পাতোনা। সেদিন পা মচকে যাওয়ায় একমাস পা ঘুড়িয়ে ঘুড়িয়ে হেটেছিলাম।
তবে খুব মজার বিষয় হল- এই দুষ্ট‚মি গুলোর জন্য খুব কমই বাবা-
মার হাতে মার খেয়েছি, ঐ ছোট-খাট দু’একটা বকাই
যা খেয়েছি; কারণ ওনারা বুঝতেন- ছেলেরা এই বয়সে একটু
দুষ্টুমি না করলে আর কখন করবে! সকাল বেলা বৃষ্টি আসলেই
আমরা অমি,মনির ভাই,হামিদ ভাই ,ছোট ভাই আমিন, ও ভাগিনা জসিমসহ বন্ধুরা সবাই আমাদের একটি পরিত্যক্ত ঘরে মিলিত হতাম। মাঝে মাঝে অঅমাদের সাথে যোগ দিত অঅবুল খায়ের, ফুফাত ভাই রহিম,অঅবু তাহের,ফকির জসিম। সবাই মিলে যদু মধু রাম শাম, চোর-পুলিশ, দশ
বিশ খেলতাম; আর কাঁঠালের বিচি,সীমের
বিচি দিয়ে জোড় নাকি বিজোড় খেলা খেলতাম।খেলার পর সেগুলো ভেজে খাওয়া হতো।সবচেয়ে বেশি খুশি হতাম যদি স্কুলে যাওয়ার সময় বৃষ্টি আসত। অনেক সময় এমনও হয়েছে- স্কুলে যাওয়ার সময় হচ্ছে এবং আকাশও মেঘলা কিন্তু বৃষ্টি আসি আসি করে আসছে না; তখন কত যে দোয়া করতাম-“আল­াহবৃষ্টি আসুক, আল­াহ বৃষ্টি আসুক”।

একটা স্মৃতি এখনো যখন মনে পড়ে খুব হাসি পায়- আমি আর আমার ইমিডিয়েট বড় মনির ভাইয়া আমরা এক সাথেই স্কুলে যেতাম, তখন মনে হয় ক্লাস সেভেনে পড়ি। সেদিন ছিল বুধবার কাশেম স্যারের ইংরেজী গ্রামার ক্লাশের পড়া শিখিনি।সকাল থেকেই বৃষ্টি হচ্ছিল, তাই আমরা ধরেই নিয়েছিলাম আজ আর স্কুলে যেতে হবে না;স্যারের কাছে মার খেতে হবে না।স্যার অবশ্য বৃষ্টির দিনে কাউকে নিজে হাতে মারতেন না। আমাদের স্কুল ঘরের ফ্লোর কাচা ছিল। উত্তর –প‚র্ব কোণায় ছিল লাল পিঁপড়ের বাসা। কেউ পড়া না পাড়লে তাকে সেখানে তিন মিনিট দাঁড়িয়ে থাকতে হতো।তাই এ স্যারের ক্লাশে অনেকেই অনুপস্থিত থাকতো।। যাক বলছিলাম বৃষ্টির দিনের কথা। স্কুলে যাওয়ার সময় হলে হঠাৎ করেই বৃষ্টি বন্ধ হয়ে গেল। মনতো পুরোই খারাপ, শালার বৃষ্টি বন্ধ হওয়ার আর সময় পেল না; আরেকটু পরে বন্ধ হলে কি এমন ক্ষতি হত? বাবা প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করতেন। তিনি আগেই স্কুলে চলে গিয়েছিলেন। মায়ের কড়া আদেশ- ‘স্কুলে যাও’ কি আর করা দু’ভাই এক সাথে স্কুলে যাওয়ার জন্য বের হলাম; কিন্তু মনে মনে নিয়ত করে রেখেছি স্কুলে আজ যাবোই না। স্কুলের কাছাকাছি গিয়ে ইচ্ছে করেই কাদায় ধপাস করে পড়ে গেলাম; বাড়িতে গিয়ে বললাম, বাবা স্কুলে যেতে গিয়ে আছাড় গেয়ে পড়ে গেছি। আর এই নাটক করতে করতে স্কুলের যাওয়ার সময়ও শেষ। আজও যখন বৃষ্টি হয় খুব মিস করি সেই শৈশবের দিন গুলোকে; নির্ভেজাল আনন্দ আর বাঁধন হারা উল­াস আর কোন দিন ফিরে আসবে না। কতই না মধুর স্মৃতি আজ শুধুই স্মৃতি রয়ে গেল।

লেখকঃ
মমিনুল ইসলাম মোল্লা,
কিটো ক্যাম্পেইনার, মানবাধিকার কর্মীও অনুসন্ধানী সাংবাদিক