মহামারি ছড়িয়ে পড়লে যা করতে বলেছেন বিশ্বনবি
বর্তমান সময়ে প্রাণঘাতী মহামারির নাম করোনাভাইরাস। সম্প্রতি করোনা মহামারির সংক্রমণ ব্যাপকহারে বেড়ে চলেছে। হাদিসের ছোট্ট একটি নির্দেশনা মেনে চলায় রয়েছে মরণব্যাধি করোনা থেকে মুক্ত থাকার সবচেয়ে নিরাপদ ও উত্তম উপায়। মহামারি ছড়িয়ে পড়লে করণীয় কী?- তা সুস্পষ্টভাবে তুলে ধরেছেন বিশ্বনবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম। চিকিৎসা বিজ্ঞানের নির্দেশনাও এ হাদিসের করণীয়ের সঙ্গে মিলে যায়। মহামারিতে করণীয় সম্পর্কে কী বলেছেন বিশ্বনবি?
মহামারি করোনার দ্বিতীয় ধাপের প্রাদুর্ভাবের এই সময়ে হাদিসের পুরোপুরি অনুসরণ ও অনুকরণেই সম্ভব এ ভয়াবহ সংক্রমণ থেকে নিরাপদ থাকা। বিশ্বের সব দেশই রাষ্ট্রীয়ভাবে এ পরামর্শ গ্রহণ করার নির্দেশ দিয়ে যাচ্ছে। তাহলো-
রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ‘যখন কোনো এলাকায় মহামারি (সংক্রামক ব্যাধি) ছড়িয়ে পড়ে তখন যদি তোমরা সেখানে থাকো, তাহলে সেখান থেকে বের হবে না। আর যদি তোমরা (ওই আক্রান্ত অঞ্চলের) বাইরে থাকো; তাহলে তোমরা সেই আক্রান্ত এলাকায় যাবে না।’ (বুখারি ও মুসলিম)
হাদিসের এ করণীয় নির্ধারণ করে দেওয়ার ফলে উভয় স্থানের মানুষই থাকবে নিরাপদ। আর এ রোগের বিস্তার বা সংক্রমণও কম হবে। সে কারণে হাদিসের নির্দেশনা অনুসারে মানুষের অবাধ চলাচলে নিয়ন্ত্রণ থাকা খুবই জরুরি। বিশ্বের সব দেশই এ নিয়ম মেনে চলার উপর গুরুত্ব দিয়ে আভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক যোগাযোগের ক্ষেত্রে কড়াকড়ি আরোপ করেছে।
হাদিসে এ নির্দেশনা দেওয়ার কারণ
বিশিষ্ট ইসলামিক স্কলার ও হাদিস শাস্ত্রের পণ্ডিতরা বিশ্বনবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর এ নির্দেশের ৪টি কারণ ব্যাখ্যা করেছেন এভাবে-
১. ‘যদি মহামারি আক্রান্ত এলাকার লোকজন পলায়ন করে অন্যত্র চলে যায় তবে যেসব লোক মহামারিতে আক্রান্ত হয়েছে তাদের সেবা-শুশ্রূষা কে করবেন?
২. সম্পদশালী ব্যক্তিরা পালিয়ে যেতে সক্ষম হলেও গরিব অসহায় ব্যক্তিরা তো পালাতে সক্ষম হবে না।
৩. যদি কেউ মনে করে যে, তাকে এ ভাইরাস বা রোগে এখনও আক্রমণ করেনি, তাই সে পালিয়ে যাবে। যদি ওই ব্যক্তি আক্রান্ত হয়ে যায়, তবে সে যে এলাকায় যাবে সে এলাকার মানুষও তার মাধ্যমে সংক্রমিত হবে।
৪. আবার অন্য এলাকা থেকে যদি কোনো সুস্থ মানুষ আক্রান্ত এলাকায় আসে তবে সেও এ ভাইরাস বা মহামারিতে আক্রান্ত হয়ে যেতে পারে।
বর্তমান সময়ে বিজ্ঞানের গবেষণায় এ বিষয়টি প্রমাণিত যে, মহামারি করোনা সংক্রমনের হার কমাতে বাইরে বের না হওয়া কিংবা নিজ নিজ এলাকা ত্যাগ করে অন্য না যাওয়াই উত্তম। সতর্কতার সঙ্গে সঙ্গে নিজ নিজ ঘরে অবস্থান করে নিরাপদ সামাজিক দূরত্ব মেনে চলার বিকল্প নেই।
প্রায় দেড় হাজার বছর আগে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যে কোনো মহামারি ছড়িয়ে করণীয় কী হবে? তা সুস্পষ্টভাবে বর্ণনা করেগেছেন।
এছাড়াও মহামারিতে নিরাপদ থাকতে আরও কিছু দিকনির্দেশনা দিয়েছেন। তাহলো-
১. দূরত্ব বজায় রাখা
রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন- ‘যারা সংক্রমণ রোগে আক্রান্ত তাদের উচিত যারা সুস্থ তাদের থেকে দূরত্বে অবস্থান করা।’ (বুখারি ও মুসলিম)
২. বাইরে যতায়াত বা ভ্র্রমণে না যাওয়া
রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ‘তোমরা যখন কোনো শহর/নগর/অঞ্চলে মহামারি প্লেগের বিস্তারের কথা শুনো, তখন সেখানে প্রবেশ করবে না। আর যদি কোনো এলাকায় এর প্রাদুর্ভাব নেমে আসে, আর তোমরা সেখানে অবস্থান কর; তবে তোমরা সেখান থেকে বেরিয়েও যেও না।’ (বুখারি)
৩. ঘরে অবস্থান করা
হজরত আবু হুরায়রাহ রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেন রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ‘কুষ্ঠ (মহামারি) রোগী থেকে দূরে থাক, যেভাবে তুমি বাঘ থেকে দূরে থাক।’ (বুখারি)
৪. ঘরে ইবাদত করা
হজরত নাফি রাহমাতুল্লাহি আলাইহি বর্ণনা করেন, প্রচণ্ড এক শীতের রাতে হজরত ইবনে ওমর রাদিয়াল্লাহু আনহু যাজনান নামক স্থানে আজান দিলেন। অতঃপর তিনি ঘোষণা করলেন-
صَلُّوا فِي رِحَالِكُمْ
‘সাল্লু ফি রিহালিকুম’ অর্থাৎ তোমরা আবাস স্থলেই নামাজ আদায় করে নাও।’
পরে তিনি আমাদের জানালেন যে, রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘লাইহি ওয়া সাল্লাম সফরের অবস্থায় বৃষ্টি অথবা তীব্র শীতের রাতে মুয়াজ্জিনকে আজান দিতে বললেন এবং সাথে সাথে এ কথাও ঘোষণা করতে বললেন যে, তোমরা নিজ বাসস্থলে (ঘরে) নামাজ আদায় কর।’ (বুখারি, মুসলিম, মুসনাদে আহমদ)
অর্থাৎ তীব্র শীত কিংবা বৃষ্টির কারণে নামাজের ওয়াক্তে আজান শুনে তোমাদের মসজিদে উপস্থিত হওয়ার দরকার নেই। ঘরেই নামাজ আদায় কর। ঠিক এই করোনাকলীন সময়ে ঘরে ইবাদত-বন্দেগি করাও কুরআন-সুন্নাহর আমলেরই বাস্তবায়ন।
৫. চিকিৎসা গ্রহণ ও সতর্কতা অবলম্বন
হজরত আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ‘আল্লাহ তাআলা এমন কোনো রোগ পাঠাননি, যার আরোগ্যের ব্যবস্থা তিনি দেননি।’ (বুখারি)
৬. ঘন ঘন সাবান-পানিতে হাত ধোয়া
> রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম নিজে রোগ-জীবাণু থেকে মুক্ত ও সুস্থ থাকতে খাওয়ার আগে উভয় হাত ভালোভাবে ধুয়ে নিতেন এবং সাহাবায়ে কেরামকে বলতেন। হাদিসে এসেছে-
হজরত আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যখন কোনো কিছু খাবার বা পান করার ইচ্ছা করতেন, তখন তিনি উভয় হাত ভালোভাবে ধুয়ে পরিচ্ছন্ন হয়ে খাবার ও পানীয় গ্রহণ করতেন।’ (নাসাঈ)
> পরিচ্ছন্নতার একটি উদাহরণ
হজরত আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেন, আমি রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে বলতে শুনেছি যে, (তিনি বর্ণনা করেন) তোমরা বলো : যদি তোমাদের কারো দরজার (বাড়ির) সামনে দিয়ে নদী প্রবাহিত হয় এবং ওই ব্যক্তি তাতে দৈনিক ৫ বার গোসল করে; তাহলে তার শরীরে কি কোনো ময়লা অবশিষ্ট থাকবে?
সাহাবাগণ নিবেদন করলেন, ‘কোনো ময়লাই আর অবশিষ্ট থাকবে না।’
রাসুলে আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, ‘সুতরাং (দৈনিক) ৫ বার নামাজের দৃষ্টান্ত হলো এই যে, আল্লাহর এর মাধ্যমে গোনাহসমূহকে নিশ্চিহ্ন করে দেবেন। (বুখারি ও মুসলিম)
অর্থাৎ নামাজের আগে ওজুর মাধ্যমে প্রতিটি অঙ্গ যেমন পরিচ্ছন্ন ও পবিত্র হয় তেমনি প্রতিটি অঙ্গের গোনাহও ওজুর পানির সঙ্গে চলে যায়। আর এ ওজুর মাধ্যমেই সুস্থ ও নিরাপদ থাকা সম্ভব।
বর্তমান সময়ে চিকিৎসা বিজ্ঞানও মহামারি করোনার প্রাদুর্ভাবে সময়ে বিশ্বনবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের দিকনির্দেশনা মেনে চলতে জোর দিয়ে পরামর্শ দিয়ে যাচ্ছেন। যারা হাদিসের এ দিকনির্দেশনা যথাযথ মেনে চলবে তাদের তাকদিরে মৃত্যু না থাকলে এ কথা সুনিশ্চিত যে, কোনো ব্যক্তি করোনায় আক্রান্ত হবে না। আর করোনায় আক্রান্ত হলেও মৃত্যুর মুখোমুখি হবে না।
একান্তই এ নির্দেশনা মেনে চলার পরও যদি কেউ মহামারিতে আক্রান্ত হয়। তা হবে তার জন্য শাহাদাতের মৃত্যু। এ বর্ণনাও এসেছে হাদিসে-
‘কোনো বান্দা যদি মহামারি আক্রান্ত এলাকায় অবস্থান করে। আর নিজ বাড়িতে ধৈর্য সহকারে সাওয়াবের নিয়তে এ বিশ্বাস নিয়ে (ঘরে) অবস্থান করে যে, আল্লাহ তাআলা তাকদিরে যা চূড়ান্ত করে রেখেছেন, তার বাইরে কোনো কিছু তাকে আক্রান্ত করবে না, তাহলে তার জন্য রয়েছে একজন শহীদের সমান সাওয়াব।’ (মুসনাদে আহমদ)
হাদিসের এ নির্দেশনাগুলো যথাযথ মেনে চলার কারণেই পবিত্র নগরী মক্কা ও মদিনাসহ বিশ্বের অনেক দেশই আজ করোনা থেকে নিরাপদ। সুতরাং মহামারি করোনা থেকে নিরাপদ ও সুস্থ থাকতে হাদিসের এ নির্দেশনাগুলো মেনে চলার সর্বাত্মক চেষ্টা করা জরুরি।
করোনার এ সময়ে রাষ্ট্র ঘোষিত লকডাউনে ঘর অবস্থানই করোনা থেকে নিরাপদ থাকার অন্যতম উপায়। তাই রাষ্ট্রীয় সিদ্ধান্ত মেনে হাদিসের ওপর আমল করতে ঘরে অবস্থান করা, অযথা বাইরে বের না হওয়া, সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখা সবার জন্য খুবই জরুরি।
আল্লাহ তাআলা বিশ্বব্যাপী সবাইকে উল্লেখিত হাদিসের ওপর যথাযথ আমল করার তাওফিক দান করুন। করোনাসহ যাবতীয় মহামারি ও রোগ-ব্যধি থেকে নিরাপদ ও হেফাজত থাকার তাওফিক দান করুন। আমিন।
এই রকম সংবাদ আরো পেতে হলে এই লেখার উপরে ক্লিক করে আমাদের ফেসবুক ফ্যান পেইজে লাইক দিয়ে সংযুক্ত থাকুন। সংবাদটি সম্পর্কে মন্তব্য করতে হলে এই পেইজের নীচে মন্তব্য করার জন্য ঘর পাবেন