লকডাউন: সড়কে কড়াকড়ি গলিতে লুকোচুরি
দেশজুড়ে চলছে লকডাউন নামে ‘কঠোর বিধিনিষেধ’। তবে গণমাধ্যমে ও সাধারণ মানুষের মুখে এই লকডাউন নিয়ে যে ‘কঠোরতা’র কথা প্রচার হয়েছিল বাস্তবে তার দেখা মেলেনি।
বৃহস্পতিবার (১ জুলাই) রাজধানীর বিভিন্ন রাজপথে পুলিশ, র্যাব, বিজিবি ও সেনাবাহিনী যতটা তৎপর ছিল পাড়া-মহল্লায় তেমন টহল দেয়নি তারা। ফলে অলিগলিতে অন্যদিনের মতোই ছিল সাধারণ মানুষের চলাচল। মাঝেমধ্যে ‘পুলিশ আসছে’ শোরগোল উঠলেই ঝটপট পড়তে থাকে দোকানের শাটার। দৌড়ঝাঁপ শুরু হয় মানুষের। কিছুক্ষণ পর সবকিছু হয়ে যায় স্বাভাবিক। এই লকডাউনে রাজধানীর রাজপথ দিনভর ছিল অনেকটাই ফাঁকা।
বৃহস্পতিবার (১ জুলাই) সকাল থেকেই করোনা সংক্রমণ প্রতিরোধে লকডাউনের আদলে সারা দেশে ২১ দফা বিধিনিষেধ বাস্তবায়নে কাজ শুরু করে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। এই বিধিনিষেধ থাকবে আগামী ৭ জুলাই মধ্যরাত পর্যন্ত। বিধিনিষেধ বাস্তবায়নে সকাল থেকেই রাজধানীতে নামে ভ্রাম্যমাণ আদালত। বেসামরিক প্রশাসনকে সহায়তা করতে মোতায়েন করা হয় সেনা সদস্যদের।
ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনায় ১০৬ জন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটকে রাখা হয় মাঠে। রাস্তার মোড়ে মোড়ে চেক পোস্ট ছাড়াও কাঁটাতারের ব্যারিকেড বসায় পুলিশ। জরুরি প্রয়োজন ছাড়া কাউকে রাস্তায় থাকতে দেওয়া হয়নি। অকারণে বাইরে বের হওয়ায় রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে গ্রেপ্তার, জরিমানা ও মামলা করা হয়।
ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) মিডিয়া অ্যান্ড পাবলিক রিলেশন্স বিভাগের অতিরিক্ত উপকমিশনার (এডিসি) ইফতেখায়রুল ইসলাম জানান, লকডাউনের প্রথমদিন ডিএমপি’র ৮টি বিভাগে অভিযান চালিয়ে সরকারি নির্দেশনা অমান্য করায় ৪৯৭ জন আটক ও ২৫৮ জনকে নিয়মিত মামলায় গ্রেপ্তার করা হয়।
সাজা দেওয়া হয়েছে আটজনকে। ৫৬ জনকে ৬ হাজার ২০৭ টাকা এবং ১০টি দোকানকে ৩৪ হাজার ১০০ টাকা জরিমানা করা হয়। এছাড়া ২২২টি গাড়ির বিরুদ্ধে মামলা দেওয়া হয়েছে, জরিমানা করা হয়েছে ২ লাখ ৯৭ হাজার ১০০ টাকা। রেকারিং করা হয়েছে ৪৬টি গাড়ি আর জব্দ করা হয়েছে ছয়টি গাড়ি।
তবে আটক, জরিমানা কিংবা মামলা দেয়ার ক্ষেত্রে পুলিশ ছিল ‘সহনশীল’। দায়িত্বরত পুলিশ সদস্যরা জানান, তারা প্রাইভেটকার, মাইক্রোবাস, মোটরসাইকেল দেখলেই থামিয়েছেন। বাইরে বের হওয়ার কারণ একেবারে অযৌক্তিক হলে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিয়েছেন তারা। কোনো কোনো ক্ষেত্রে মানবিক বিবেচনায় দেয়া হয়েছে ছাড়। নিয়মভঙ্গকারীদের জরিমানা করার চেয়ে বুঝিয়ে ঘরে পাঠিয়ে দেয়ার প্রবণতাই বেশি লক্ষ করা গেছে।
পুরান ঢাকার সেকশন (নবাবগঞ্জ) পুলিশ ফাঁড়ির সামনে ও ঢালে ব্যারিকেড দিয়ে কয়েকজন পুলিশ সদস্য কিছু পথচারীকে থামিয়ে তার বের হওয়ার প্রয়োজনের কথা জিজ্ঞেস করতে দেখা যায়। জবাব সন্তোষজনক না হলে তাকে কিছুক্ষণ বসিয়ে রেখে পরে ফিরিয়ে দেন।
দুপুর দেড়টার দিকে মিরপুরের দারুস সালাম রোডে ন্যাশনাল হার্ট ফাউন্ডেশন হাসপাতাল অ্যান্ড রিসার্চ ইনস্টিটিউটের ৩০ সিটের একটি মিনিবাস ৪০ জন নার্স নিয়ে যাচ্ছিল। পথে দায়িত্বরত র্যাবের ভ্রাম্যমাণ আদালত বাসটিকে আটক করে চালকসহ যাত্রীদের সতর্ক করেন। আসনের অতিরিক্ত যাত্রীদের নামিয়ে ছেড়ে দেওয়া হয়। কিছুক্ষণ পর হাসপাতালের আরেকটি মিনিবাসে যাত্রীদের গন্তব্যে নিয়ে যায়।
এদিকে লকডাউনের প্রথম দিন সকালে রাজধানীর মগবাজার মৌচাক, শান্তিনগর, কাকরাইল, নয়া পল্টন, ফকিরাপুল, বিজয়নগর, মীরপুর, আজিমপুর, বাড্ডা, রামপুরা, শাহবাগ, ধানমন্ডি, হাতিরপুলের মাড়ে মোড়ে পুলিশ চেকপোস্ট দেখা গেছে। মানুষকে বিধিনিষেধ মানাতে সকাল থেকেই রাজধানীর বিভিন্ন সড়কে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর গাড়ি টহল দিতে দেখা যায়। এসময় মাইকে সবাইকে ঘরে থাকার অনুরোধ করা হয়। সকালে গুলশান, রামপুরা ও হাতিঝিল এলাকায় সেনাবাহিনীর টহলও দেখা গেছে।
তবে রাজধানীর সর্বত্র এই চিত্র ছিল না। বেশ কিছু এলাকায় পুলিশের কোন উপস্থিতিই খুঁজে পাওয়া যায়নি। ওইসব এলাকায় মানুষও ভঙ্গ করেছে বিধিনিষেধ। আবার অনেক এলাকায় পুলিশের সাথে স্থানীয়দের চলে ‘লুকোচুরি’ খেলা। আবার অনেক এলাকায় ঢিলেঢালাভাবে পুলিশকে দায়িতত্ব পালন করতে দেখা যায়।
গতকাল রাজধানীর পুরান ঢাকার বিভিন্ন স্থানে ঘুরে দেখা যায়, সরকারঘোষিত সাত দিনের শাটডাউন বিভিন্ন গণমাধ্যমে ও সাধারণ মানুষের মুখে মুখে যেভাবে প্রচার পেয়েছিল, তার কোনো ছাপই ছিল না ওইসব এলাকাতে।
রাজধানীর মিরপুর-১ নম্বর, ধলপুর, মিরহাজারিবাগ, আগারগাঁও, শেরেবাংলানগর ও তালতলা এলাকায় পুলিশের কোনো উপস্থিতি দেখা যায়নি।
পুরান ঢাকার ছাপড়া মসজিদ কাঁচাবাজার, পলাশী বাজার, হাজারীবাগ থেকে নবাবগঞ্জ, তাঁতীবাজার, বংশাল, ধোলাইখালসহ সদরঘাটের আশপাশের এলাকা ঘুরে দেখা যায়, খাবার হোটেলগুলো অনেকটা আগের মতোই চলছে। হোটেলে বসেই খাবার খাচ্ছে মানুষ। এসব এলাকার অলিগলি ও স্থানীয় বাজারে অন্যান্য দিনের মতোই মানুষের ভিড় লক্ষ্য করা গেছে।
এদিকে আগারগাঁওয়ের তালতলা বাজার, বউবাজার, শেওড়াপাড়াসহ আশপাশের কাঁচাবাজারগুলো ক্রেতাদের ভিড় লক্ষ করা গেছে। অলিতে গলিতে ভ্যানে সবজি বিক্রি চলে অন্যদিনের মতোই স্বাভাবিক। পাড়ার মুদি দোকানগুলোও খোলা ছিল। অধিকাংশ ক্রেতা বিক্রেতার মুখে মাস্ক দেখা যায়নি। তালতলা মোল্লাপাড়ায় অবস্থিত বউ বাজারে ব্যাপক লোকসমাগম চোখে পড়ে। এ সময় করোনা প্রতিরোধে সচেতনতার বিষয়টিও চোখে পড়েনি। অন্যদিনের মতোই স্বাভাবিক কেনাকাটা করেন ক্রেতারা।
তবে পাড়া-মহল্লার যেসব এলাকায় পুলিশ টহল দিয়েছে সেখানে বিধিনিষেধ কিছুটা পালিত হতে দেখা গেছে। পুলিশ সদস্যদের আসতে দেখলে সাটার ফেলতে শুরু করেন দোকানে। পথচারীরা দ্রুত মাস্ক খুঁজতে ব্যস্ত হয়ে পড়েন। কিন্তু পুলিশ চলে গেলে আবার আগের অবস্থা চলতে থাকে সেখানে।
রাজধানীর অনেক স্থানে পুলিশের ব্যাপক উপস্থিতি থাকলেও অনেক এলাকায় পুলিশের উপস্থিতি কম দেখা গেছে। বিশেষ করে লালবাগ থানার সামনে, সোয়ারীঘাট পুলিশ চেকপোস্ট, বাবুবাজার ব্রিজের নিচে, ইসলামপুর কাপড়ের মার্কেট, বাংলাবাজারের মোড়, বাহাদুরশাহ পার্ক এলাকা রায় সাহেব বাজার মোড়সহ আশপাশের এলাকায় প্রয়োজনের তুলনায় স্বল্পসংখ্যক পুলিশ সদস্যকে শাটডাউন কার্যকর কারার জন্য অনেকটা ঢিলেঢালাভাবে দায়িত্ব পালন করতে দেখা যায়।
এদিকে বিধিনিষেধের কারণে সব ধরনের গনপরিবহন বন্ধ থাকায় ব্যাপক ভোগান্তিতে পড়তে হয়েছে অফিসগামীদের। গুনতে হয়েছে মাত্রাতিরিক্ত রিকশা ভাড়া। অনেকে বাধ্য হয়ে হেঁটেই পাড়ি দেন দীর্ঘ পথ।
একটি বেসরকারি অফিসে কর্মরত নিরাপত্তাকর্মী রাশেদুল জানান, তার অফিস বন্ধ থাকলেও নিরাপত্তাজনিত কারণে তাকে ডিউটিতে যেতে হচ্ছে। তবে রিকশা ভাড়া গুনতে হচ্ছে দ্বিগুণ।
তিনি বলেন, ‘শেওড়াপাড়া থেকে শ্যামলী যেতে রিকশা ভাড়া স্বাভাবিক সময় ১২০ টাকা নিলেও আজ গুনতে হচ্ছে ২৫০ টাকা। সামান্য যা বেতন পাই সেটি যদি রিকশাওয়ালাদের দিতেই চলে যায়, তাহলে আমাদের মাস চলবে কীভাবে?’
গাজীপুরে কঠোর বিধিনিষেধের মধ্যেই চালু ছিল অনেক কারখানা। ভোর হতেই হেঁটে কারখানার উদ্দেশে রওনা দেন পোশাকশ্রমিকরা। তবে পরিবহন ব্যবস্থা না থাকায় চরম বিপাকে পড়েন পোশাকশিল্পের কর্মীরা। দায়িত্বরত পুলিশ সদস্যরা বলছেন প্রজ্ঞাপন অনুযায়ী শ্রমিকদের কাজ করতে হবে কারখানা এলাকায় থেকে।
রাজধানীর পাশের আরেক শিল্পাঞ্চল নারায়ণগঞ্জেও সর্বাত্মক লকডাউনে কোনো কোনো পোশাক কারখানা তাদের শ্রমিকদের যাতায়াতে নিজস্ব পরিবহনের ব্যবস্থা না করায় পায়ে হেঁটে বা রিকশা অটোরিকশায় চেপে কারখানায় যান শ্রমিকরা।
রাজধানীর বাইরেও বিধিনিষেধ ভঙ্গ করায় জরিমানার মুখে পগতে হয়েছে অনেককে। সরকারঘোষিত কঠোর লকডাউন (বিধিনিষেধ) দেখতে বের হয়ে চট্টগ্রাম নগরের ডবলমুরিং থানা এলাকায় আটক হয় ২১ জন। এ সময় আটক করা হয় পাঁচটি গাড়ি এবং জরিমানার করা হয় ১০টি গাড়িকে।
রংপুর নগরীতে সকাল থেকেই সেনাবাহিনী, বিজিবি, র্যাব ও পুলিশের ব্যাপক তৎপরতা দেখা গেছে। নগরের বিভিন্ন এলাকায় জনসমাগম ঠেকাতে মাইকিং করে ঘরে থাকতে উদ্বুদ্ধ কওে পুলিশ। লকডাউনে নগরের দোকানপাট, ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান, অফিস-আদালতসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান বন্ধ ছিল। গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্টগুলোতে বসানো হয়েছে পুলিশি চেকপোস্ট। প্রয়োজন ছাড়া ঘর থেকে বের হওয়া মানুষদের ফেরত পাঠানো হয়।
সরকার ঘোষিত কঠোর লকডাউনে নারায়নগঞ্জ ও গাজীপুরের চিত্রও ছিল একই। মহাসড়কের গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্টে যান চলাচল নিয়ন্ত্রণে দেখা যায় পুলিশি তৎপরতা। ছিল পুলিশের চেকপোস্টও।
এদিকে সরকার ঘোষিত কঠোর লকডাউনেও ঢাকা-টাঙ্গাইল মহাসড়কে যাত্রীবাহী বাস ও ব্যক্তিগত গাড়ি চলাচল করতে দেখা গেছে। এছাড়া ট্রাকে বৃষ্টিতে ভিজে নিম্নআয়ের মানুষজন যাতায়াত করতে দেখা গেছে। বৃহস্পতিবার সকালে মহাসড়কের টাঙ্গাইলের রাবনা বাইপাস, এলেঙ্গা বাসস্ট্যান্ড ও এলেঙ্গা থেকে বঙ্গবন্ধু সেতু পর্যন্ত সড়কে বাস ও ব্যক্তিগত যানবাহনও চলাচল করতে দেখা গেছে।
অন্যদিকে লকডাউন বা বিধিনিষেধের কারণে বিপাকে পড়েছেন আম চাষিরা। যদিও পণ্যবাহী যান চরাচল বিধিনিষেধের বাইরে রয়েছে। কিন্তু ক্রেতা কমে যাওয়ায় এবং উৎপাদন বেশি হওয়ায় পড়ে গেছে আমের দাম।
আম বিক্রেতারা জানিয়েছেন, নওগাঁর আমের হাটে ল্যাংড়া, আম্রপালি, খিরসাপাত ও নাক ফজলি আমের সরবরাহ শুরু হয়েছে। তবে লকডাউনের ঘোষণায় ব্যাপকহারে পড়ে গেছে আমের দর। ব্যবসায়ীরা বলছেন, এমন দরপতনে আম বিক্রি করে মূলধনও উঠছে না। এবার জেলায় হাজার কোটি টাকার ওপর আম বেচাকেনার টার্গেট ধরা হলেও তা অর্ধেকে নেমে আসবে বলে আশঙ্কা করছেন ব্যবসায়ীরা।
এই রকম সংবাদ আরো পেতে হলে এই লেখার উপরে ক্লিক করে আমাদের ফেসবুক ফ্যান পেইজে লাইক দিয়ে সংযুক্ত থাকুন। সংবাদটি সম্পর্কে মন্তব্য করতে হলে এই পেইজের নীচে মন্তব্য করার জন্য ঘর পাবেন