প্রসঙ্গ : ভাষা সৈনিক ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত ও মুরাদনগর থানার চাপিতলা
ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত একটি নাম, একটি ইতিহাস। তিনি ১৮৮৬ সালে জন্মেছিলেন ব্রাহ্মণবাড়িয়া শহরের পাশের গ্রাম রামরাইলে। তার পিতা জগবন্ধু দত্ত আর কুমিল্লার মুরাদনগর থানার চাপিতলা গ্রামের রক্ষিৎবাড়ির ভুবনমোহন রক্ষিতের মেয়ে ছিলেন তার মা। মুরাদনগর থানার ভুবনঘরের সন্তান নবীনগর আদালতের উকিল আবদুস সোবহান কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত নবীনগর হাই স্কুল(১৮৯৬)থেকে ১৯০৪ সালে ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত এন্ট্র্যান্স পাস করেন। তিনি ১৯০৬ সালে কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজ থেকে এফএ পাস করেন। কলকাতা রিপন কলেজে বিএ ক্লাসে পড়ার সময় লেখাপড়ার খরচ যোগানোর জন্য মুরাদনগরের চাপিতলার পাশের গ্রাম পূর্বধইরের মুন্সি ক্ষ্ণৃকমল দাসের মেয়ে সুরবালা দাসকে ১৯০৬সালে তিনি বিয়ে করেন। তিনি ১৯০৮ সালে বিএ পাসের পর ১৯১০ সালে রিপন কলেজ থেকেই বিএল ডিগ্রি লাভ করেন।
আইন পেশায় ডিগ্রি লাভ করেও তিনি প্রথমে উকালতি পেশায় যোগদান করেননি। তিনি শিক্ষকতার পেশার যোগদান করতে চলে আসেন বাঙ্গরা উমালোচন উচ্চ বিদ্যালয়ে।মুরাদনগরের বাঙ্গরার রামপ্রসাদ মজুমদারের ছেলে দেওয়ান পদ্মলোচন মজুমদারের সন্তান জমিদার উমালোচন মজুমদার(১৮৪১-৯৩) নিজ নামে ১৮৮৫ সালে স্কুলটি প্রতিষ্ঠা করেন।বাঙ্গরা উমালোচন উচ্চ বিদ্যালয়টি ১৯০১ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের মঞ্জরিপ্রাপ্ত হয়। সেই স্কুলে ১৯১০ সালের ১লা মার্চ ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত এসে স্কুলের সহকারী প্রধান শিক্ষক পদে যোগদান করেন। তিনি ১৯১১সালের ফেব্রুয়ারি মাসের ০২ তারিখ শিক্ষকতার চাকরি ছেড়ে আদালতে আইন পেশায় যোগদান করতে কুমিল্লায় চলে যান। তাঁর সময়ে স্কুলের প্রধান শিক্ষক ছিলেন ইংরেজি সাহিত্যের এমএ সিরাজগঞ্জের বাবু জগদীশচন্দ্র চক্রবর্তী(১৯১০-১২)।তার ছাত্রদের মধ্যে একজন ছিলেন বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ, সাহিত্যিক ও প্রকাশক কুড়েরপাড় গ্রামের(মুরাদনগর, কুমিল্লা) ফরিদ উদ্দিন খাঁ(বর্তমান সরকারের আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রী অ্যাডভোকেট আনিসুল হকের পিতা কসবার পানিয়ারূপের অ্যাডভোকেট সিরাজুল হকের আপন মামা ছিলেন তিনি)। এই স্কুলের কৃতী প্রধান শিক্ষক ছিলেন বাঙ্গরা গ্রামের জমিদার পরিবারের ভুবনমোহন মজুমদারের ছেলে, নিখিল বঙ্গ শিক্ষক সমিতির সভাপতি, শ্রী অবণীমোহন মজুমদার এমএ। তিনি দীর্ঘ ২৬ বছর(১৯১৭-৪৩)কৃতীত্বের সাথে প্রধান শিক্ষক পদে দায়িত্ব পালন কালেই মৃত্যুবরণ করেন। পরবর্তীতে কুড়েরপাড় গ্রামের(মুরাদনগর, কুমিল্লা) মৌলভী শরাফত আলী খান(১৯২৫-২০০৫), এমএ, বিটি; দীর্ঘ ৩৩ বছর(১৯৫৯-৯২)এই স্কুলের প্রধান শিক্ষক পদে সাফল্যের সাথে দায়িত্ব পালন করে অমর হয়ে আছেন।
বাঙ্গরা উমালোচন হাই স্কুল প্রতিষ্ঠার পর থেকে দীর্ঘ ১৩৩ বছর(১৮৮৫-২০১৮)সময় কালে বিপুল সংখ্যক ছাত্রছাত্রী কৃতীত্বের সাথে পাস করে উচ্চ শিক্ষা লাভের মাধ্যমে জীবনে প্রতিষ্ঠিত হয়ে সমাজ ও দেশের সেবায় নিয়োজিত হয়েছেন। তাদের মধ্যে কয়েক জন হলেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সলিমুল্লাহ মুসলিম হলের প্রথম ভিপি(১৯২১)পীরসাহেব আব্দুল আজিজ ডিপটি(কুড়েরপাড়, মুরাদনগর, কুমিল্লা),ব্যারিস্টার রফিকুল ইসলাম মিয়া, বাংলাদেশ সরকারের সাবেক মন্ত্রী(শ্রীরামপুর,মুরাদনগর, কুমিল্লা),আমির হোসেন, জাতীয় সংসদের সাবেক এমপি(শিদলাই, ব্রাহ্মণপাড়া, কুমিল্লা),আবুল খায়ের মোহাম্মদ সিদ্দিক, অস্ট্রেলিয়ার ক্যানবেরা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ও আইএমএফ-এর সাবেক চিফ ইকোনোমিস্ট, ওয়াশিংটন(কুড়েরপাড়, মুরাদনগর, কুমিল্লা), অধ্যাপক আবু আইয়ুব মোহাম্মদ বাকের, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ও দি মিলেনিয়াম ইউনিভার্সিটির ভিসি(কুড়েরপাড়, মুরাদনগর, কুমিল্লা), অধ্যাপক মনিরুল হক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক, বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের সদস্য ও দারুল ইহসান বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি(দৌলতপুর, মুরাদনগর, কুমিল্লা)প্রমুখ।
ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত পরে আইন পেশার পাশাপাশি কংগ্রেসের রাজনীতিতে সক্রিয় ছিলেন। কুমিল্লার অভয় আশ্রম প্রতিষ্ঠার(১৯২৩)সাথেও তিনি সম্পৃক্ত ছিলেন। তিনি কংগ্রেস দলীয় সদস্য হিসাবে যোগদান করে পাকিস্তানের জাতীয় সংসদের করাচি অধিবেশনে ১৯৪৮ সালের ২৫শে আগস্ট ইংরেজি ও উর্দুর পাশাপাশি সংসদের কাজের বিবরণী বাংলায়ও লেখার প্রস্তাব করে পাকিস্তানের রাজনীতিতে আলোড়ন সৃষ্টি করেছিলেন। তিনি আতাউর রহমান খানের কেবিনেটে পূর্ব পাকিস্তানের স্বাস্থ্য ও সমাজ কল্যাণ মন্ত্রী(১৯৫৬-৫৮)ছিলেন। ১৯৬৫ সালে পাক-ভারত যুদ্ধের সময় তিনি গ্রেফতার হন। ১৯৭১ সালে ২৯শে মার্চ রাতে পাক হানাদার বাহিনী কুমিল্লার বাদুড়তলার তাঁর বাসা থেকে গ্রেফতার করে ময়নামতি সেনানিবাসে নিয়ে গিয়ে ছেলেসহ তাকে হত্যা করে।
লেখক ও প্রকাশক ক্যাপ্টেন(অব.)আলী আকবর খানের আমন্ত্রণে কলকাতা থেকে বেড়াতে এসে কাজী নজরুল ইসলাম বেশ কয়েক মাস দৌলতপুরে অবস্থান করেন। আলী আকবর খানের ভাগ্নি সৈয়দা খাতুন নার্গিসের(ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ও দারুল ইহসান বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি অধ্যাপক মনিরুল হকের আপন ফুফু)সাথে বিয়ের(১৭ই জুন, ১৯২১) আগে বাঙ্গরার জমিদার রূপেন্দ্রলোচন মজুমদার(১৮৯২-১৯৭০) ও প্রধান শিক্ষক অবণীমোহন মজুমদারের(১৮৯১-১৯৪৩) উদ্যোগে কাজী নজরুল ইসলামকে বাঙ্গরা উমালোচন উচ্চ বিদ্যালয়ে সংবর্ধনা দেওয়া হয়েছিল।সে সংবর্ধনা অনুষ্ঠানের পরিচালনায় ছিলেন কাজী নজরুল ইসলামের সুহৃদ, স্কুলের সহকারী শিক্ষক, বিশিষ্ট কথা সাহিত্যিক ও পুস্তক প্রকাশক ফরিদ উদ্দিন খাঁ(১৮৯৩-১৯৫৭)।
মুক্তিযুদ্ধে শহীদ ও ভাষা সৈনিক ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত(সাবেক মন্ত্রী) ও বাংলাদেশের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের স্মৃতি বিজড়িত ও গর্বিত প্রতিষ্ঠান এই বাঙ্গরা উমালোচন উচ্চ বিদ্যালয়। বাঙ্গরা উমালোচন উচ্চ বিদ্যালয়ের মহান শিক্ষকদের দ্বারা অনুপ্রাণিত ও আলোকিত হয়ে তাঁদের ছাত্রছাত্রীরা নানা ক্ষেত্রে সমাজ ও দেশের কল্যাণে অবদান রেখে চলেছেন।
এই রকম সংবাদ আরো পেতে হলে এই লেখার উপরে ক্লিক করে আমাদের ফেসবুক ফ্যান পেইজে লাইক দিয়ে সংযুক্ত থাকুন। সংবাদটি সম্পর্কে মন্তব্য করতে হলে এই পেইজের নীচে মন্তব্য করার জন্য ঘর পাবেন