করোনা ও লকডাউন, গতি কমেছে মেট্রোরেল প্রকল্পের
দেশে করোনা মহামারির কারণে কাজের গতি কমে গেছে মেট্রোরেল প্রকল্পের। এরই মধ্যে প্রকল্পে সম্পৃক্ত অনেকেই আক্রান্ত হয়েছেন করোনায়। তবে এখন পর্যন্ত কোনো মৃত্যুর ঘটনা ঘটেনি। এদিকে কাজের গতি কিছুটা কমলেও প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ কাজ সম্পন্ন হয়েছে মেট্রোরেল প্রকল্পের।
প্রকল্প সূত্রে জানা যায়, করোনা পরিস্থিতিতে স্বাস্থ্যবিধি মেনে ও শারীরিক দূরত্ব বজায় রেখে চলছে মেট্রোরেলের নির্মাণকাজ। কোভিড-১৯ মহামারির দ্বিতীয় ঢেউ মোকাবিলা করে প্রকল্পের কাজ এগিয়ে নিতে অনেকগুলো পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে। গাবতলী ও উত্তরায় কনস্ট্রাকশন ইয়ার্ডে ফিল্ড হাসপাতাল চালুর পাশাপাশি কর্মীদের টিকা দেয়া হচ্ছে। জনবলের নিরাপদ অবস্থানের জন্য নির্মাণস্থলের কাছেই আবাসিক স্থাপনা নির্মাণ করা হয়েছে। দেশি জনবলের বেশির ভাগকে দুই ডোজ টিকা দেয়া হয়েছে। তবে বিদেশি জনবলকে টিকা দেয়ার সর্বোচ্চ চেষ্টা করা হচ্ছে।
গত জুন পর্যন্ত মেট্রোরেলে কাজে নিয়োজিত দেশি-বিদেশি জনবলের মধ্যে ৭৩৪ জন কর্মী, শ্রমিক ও কর্মকর্তা কোভিড-১৯-এ আক্রান্ত হয়েছেন বলে জানা গেছে। প্রকল্পের সঙ্গে জড়িত লোকজনের মধ্যে করোনা সংক্রমণের হারও বেড়েছে, যা কাজের গতিকে কিছুটা কমিয়ে দিচ্ছে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা। এদিকে করোনার কারণে মেট্রোরেলের কাজ ঠিক যতটা এগোনোর কথা ছিল, তা না হওয়ায় ঢাকার উত্তরা থেকে আগারগাঁও পর্যন্ত মেট্রোরেল আগামী ডিসেম্বরের মধ্যে চালু করা সম্ভব হচ্ছে না বলে জানিয়েছেন প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা। মোট প্রকল্পের মধ্যে শুরুতে উত্তরা থেকে আগারগাঁও পর্যন্ত প্রায় ১২ কিলোমিটার অংশে ডিসেম্বরের মধ্যে রেল চালুর পরিকল্পনা ছিল। তবে করোনার কারণে কাজের গতি কমে যাওয়ায় তা আর হচ্ছে না।
সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগ সূত্র জানিয়েছে, এমআরটি-৬ শেষ করার কথা ছিল ২০২৪ সালের জুনের মধ্যে। পরে চলতি বছরের ডিসেম্বরের মধ্যে আগারগাঁও পর্যন্ত শেষ করার লক্ষ্যমাত্রা নেয়া হয়। কিন্তু চলমান বৈশ্বিক মহামারির কারণে এখন সেই সময়সীমায় তা সম্ভব হচ্ছে না। তবে প্রথমে যে সময়সীমা নেয়া হয়েছিল, তার আগেই এমআরটি-৬-এর নির্মাণকাজ শেষ হবে।
কর্মকর্তারা বলছেন, প্রায় বছর খানেক ট্রায়াল রানের পর শুরু হবে যাত্রী চলাচল। সে হিসেবে আগামী বছরের আগস্টের আগে এ পথে মেট্রোরেল চলাচলের সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে না
বর্তমানে জাপান থেকে আনা প্রথম সেট ট্রেনের ডিপোতে ফাংশনাল টেস্ট চলছে। এরপর আগামী আগস্টে মাসে ভায়াডাক্টের ওপর পারফরম্যান্স টেস্ট বা টেস্ট রান করা হবে। এর মাধ্যমে উড়ালপথে মূল লাইনের ওপর ট্রেনের প্রথম চলাচল দেখতে পাওয়া যাবে। এর মাধ্যমে ট্রেনের সঙ্গে রেললাইন, বিদ্যুৎ ও সংকেতব্যবস্থা যুক্ত করে দেখা হবে। পারফরম্যান্স টেস্টের পর ছয় মাসের ইন্টিগ্রেটেড টেস্ট করা হবে। এর পরেই হবে ট্রায়াল রান। তবে তাতে এখনও অনেকটাই দেরি হবে। আর মানুষবিহীন প্রায় বছর খানেক ট্রায়াল রানের পরই শুরু হবে যাত্রী চলাচল।
ঢাকা মাস ট্রানজিট কোম্পানি লিমিটেডের (ডিএমটিসিএল) ব্যবস্থাপনা পরিচালক এম এ এন ছিদ্দিক বলেন, লাকডাউনে কাজের কিছু সমস্যা হবেই। এখানে হাজার হাজার লোক কাজ করেন। স্বাস্থ্যবিধি মানতে হবে, দূরত্ব বজায় রাখতে হবে। এসব আমরা মেনে চলছি। তাই তার একটা ইমপ্যাক্ট তো অবশ্যই পড়বে। তবে কাজ বন্ধ নেই।
মূলত তিনটি ভাগে হচ্ছে মেট্রোরেলের কাজ। প্রথম অংশ উত্তরা থেকে আগারগাঁওয়ের সার্বিক অগ্রগতি ৮৭ দশমিক ৮০ শতাংশ। আগারগাঁও থেকে মতিঝিলের অগ্রগতি ৬৫ দশমিক ৪৮ শতাংশ। ইলেকট্রিক্যাল ও মেকানিক্যাল সিস্টেম এবং রোলিং স্টক (রেল কোচ) ও ডিপো ইকুইপমেন্ট সংগ্রহ করা কাজের অগ্রগতি ৫৯ দশমিক ৪৮ শতাংশ। এ ছাড়া মতিঝিল থেকে কমলাপুর পর্যন্ত ১ দশমিক ১৬ কিলোমিটার বর্ধিত করার জন্য ডিটেইল ডিজাইন ও ভূমি অধিগ্রহণের কাজ চলমান আছে।
২০ দশমিক ১০ কিলোমিটার ভায়াডাক্টের মধ্যে ইতিমধ্যে ১৫ দশমিক ৯৫ কিলোমিটার ভায়াডাক্ট দৃশ্যমান হয়েছে। উত্তরা ডিপোতে রিসিভিং সাবস্টেশনের পূর্তকাজ শেষ করে বিদ্যুতায়নের কাজ সম্পন্ন করা হয়েছে। মতিঝিল রিসিভিং সাবস্টেশনের ভবন নির্মাণকাজ চলছে।
ডিপো এলাকার ওয়ার্কশপ শেডের ভেতরে ১২টি রেললাইনের নির্মাণকাজও শেষ। আগারগাঁও পর্যন্ত ২৩ দশমিক ৯৬ কিলোমিটার রেল ট্র্যাক লাইনের মধ্যে সাড়ে ১৭ কিলোমিটার রেল ট্র্যাক অ্যালাইনমেন্টের কাজ শেষ হয়েছে। তার মধ্যে ১৪ দশমিক ৫০ কিলোমিটার রেললাইন স্থাপন করা হয়েছে। প্রায় অর্ধেক স্টেশনের মূল অবকাঠামো নির্মাণ শেষ হয়েছে।
ডিএমটিসিএল সূত্রে জানা যায়, জুন ২০২০ সাল পর্যন্ত এ প্রকল্পের কাজ হয়েছিল ৪৬ দশমিক ১৩ শতাংশ, যা চলতি বছরের জুনে দাঁড়িয়েছে ৬৭ দশমিক ৬৩ শতাংশ। এতে গত এক বছরে এ প্রকল্পে অগ্রগতি দাঁড়িয়েছে ২১ দশমিক ৫ শতাংশ। আর ২০২০ সালের মার্চ পর্যন্ত অগ্রগতিছিল ৪৪ দশমিক ১২ শতাংশ। সে হিসাবে করোনাকালীন মোট অগ্রগতি হয়েছে ২৩ দশমিক ৫১ শতাংশ।
মেট্রোরেলের চার সেট ট্রেন ইতিমধ্যেই দেশে এসেছে। মেট্রোরেলের স্টেইনলেস স্টিলের কোচগুলোর ভেতরে দুই পাশে লম্বালম্বি বসার আসন রয়েছে। একটি ট্রেনের দুই প্রান্তের দুটি কোচকে বলা হচ্ছে ট্রেইলার কার যা ট্রেনকে চালিয়ে নিয়ে যাবে। এতেই চালক থাকবেন। একটি ট্রেনে বসে যেতে পারবেন ৩০৬ যাত্রী। মাঝের চারটি কোচ মোটরকার। শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত (এসি) সাড়ে ৯ ফুট চওড়া কোচের মাঝখানে যাত্রীরা দাঁড়িয়ে ভ্রমণ করবেন। এ জন্য হাতল এবং স্থানে স্থানে খুঁটি আছে। সব মিলিয়ে একটি ট্রেনে বসে এবং দাঁড়িয়ে সব মিলিয়ে ২ হাজার ৩০৮ যাত্রী চড়তে পারবেন। এসব ট্রেনের সর্বোচ্চ গতিবেগ ১১০ কিলোমিটার।
একেকটি ট্রেনের সেট জাপান থেকে দেশে আসতে সময় লাগে প্রায় এক মাস। এরই মধ্যে চার সেট ট্রেন দেশে এসে পৌঁছেছে। এর মধ্যে দুই সেট ঢাকায় ডিপোতেও পৌঁছেছে। আর দুটি সেট বন্দর থেকে ঢাকার পথে রয়েছে। তৃতীয় ও চতুর্থ সেট গত ২২ জুন জাপানের কোবে সমুদ্রবন্দর থেকে জাহাজে করে দেশের উদ্দেশে রওনা দিয়েছে। গত ২০ জুলাই সেটি দেশের বন্দরে পৌঁছেছে। এগুলো এখন উত্তরায় ডিপোতে আনার প্রক্রিয়া চলছে।
মেট্রোরেল প্রকল্প-৬-এর বাস্তবায়নকারী সংস্থা ঢাকা মাস ট্রানজিট কোম্পানি লিমিটেড (ডিএমটিসিএল) সূত্র জানিয়েছে, ২১ হাজার ৯৮৫ কোটি টাকার এ প্রকল্পে গত জুন পর্যন্ত অগ্রগতি হয়েছে ৬৭ দশমিক ৬৩ শতাংশ। ২০ দশমিক ১ কিলোমিটার দীর্ঘ এরআরটি-৬-এ ইতোমধ্যে ১৬ কিলোমিটার ভায়াডাক্ট বসানো হয়েছে।
ঢাকার যানজট নিরসন এবং দ্রুত ও আরামদায়ক যাতায়াত নিশ্চিত করতে ছয়টি মেট্রোরেল লাইন নির্মাণের উদ্যোগ নেয়া হয়। সব মিলিয়ে ১২৮ কিলোমিটারের নেটওয়ার্ক হবে মেট্রোরেলের। প্রথম শুরু হয় এমআরটি-৬-এর কাজ। ২০১২ সালে নেয়া মেট্রোরেলের এ প্রকল্পে ১৬ হাজার ৫৯৪ কোটি টাকা ঋণ দিচ্ছে জাপান ইন্টারন্যাশনাল কো-অপারেশন এজেন্সি (জাইকা)।
এই রকম সংবাদ আরো পেতে হলে এই লেখার উপরে ক্লিক করে আমাদের ফেসবুক ফ্যান পেইজে লাইক দিয়ে সংযুক্ত থাকুন। সংবাদটি সম্পর্কে মন্তব্য করতে হলে এই পেইজের নীচে মন্তব্য করার জন্য ঘর পাবেন