জাতীয় বিপ্লব ও সংহতি দিবস বনাম আজকের গণতন্ত্রের ভিন্নমত
ঐতিহাসিক জাতীয় বিপ্লব ও সংহতি দিবস। ১৯৭৫ সালের শেষদিকে দ্রুত রাজনৈতিক রক্তাক্ত উত্থান-পতনের ঘটনাবলীর মধ্যে এই দিনে তৎকালীন মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান ক্ষমতা সংহত করে অপেক্ষাকৃত স্থিতিশীলতার সূচনা করেন। সিপাহী-জনতা কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে ঢাকা সেনানিবাসের বন্দিদশা থেকে মুক্ত করে আনেন তৎকালীন সেনা প্রধান মহান স্বাধীনতার ঘোষক শহীদ রাষ্ট্রপ্রতি জিয়াউর রহমানকে। বিএনপি এ দিনটিকে ‘জাতীয় বিপ্লব ও সংহতি দিবস’, আওয়ামী লীগ ‘মুক্তিযোদ্ধা সৈনিক হত্যা দিবস’ এবং জাসদ ‘সিপাহী জনতার অভ্যুত্থান দিবস’ হিসেবে পালন করে থাকে।
ফিরে দেখা এই দিন:
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের হত্যাকাণ্ডের ঘটনা এবং ৩ নভেম্বর ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে জাতীয় চারনেতা হত্যাকাণ্ডের ঘটনার ধারাবাহিকতায় ওই দিনই বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর উপ-প্রধান ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফ তার অনুসারী সেনা সদস্যদের নিয়ে এক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে সেনাপ্রধান মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমানকে ঢাকা ক্যান্টনমেন্টে বন্দি করেন। আত্মস্বীকৃত পদোন্নতি নিয়ে ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফ, মেজর জেনারেলের ব্যাজ ধারণ এবং সেনাপ্রধানের পদ দখল করেন। ৬ নভেম্বর খালেদ মোশাররফ বঙ্গভবনের নিয়ন্ত্রণ গ্রহণ ও তৎকালীন প্রেসিডেন্ট খন্দকার মোশতাক আহমদকে গ্রেফতার করেন। মেজর জেনারেল খালেদ মোশাররফ মন্ত্রিসভা বাতিল ও জাতীয় সংসদ ভেঙে দেয়ার ঘোষণা দেন। একই দিনে তিনি প্রধান বিচারপতি আবু সা’দাত মোহাম্মদ সায়েমকে দেশের প্রেসিডেন্টের পদে এনে বসান। এভাবে চরম উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা, অনিশ্চয়তা ও ভীতিকর পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে কেটে যায় চারদিন। এক পর্যায়ে ৬ নভেম্বর গভীর রাতে সেনাবাহিনীর সাধারণ সিপাহীগণ ঐক্যবদ্ধ হয়ে পাল্টা প্রতিরোধ গড়ে তোলেন। সেই অভ্যুত্থানে স্বতঃস্ফূর্ত সমর্থন আপামর জনতা রাজপথে নেমে আসেন। সিপাহী-জনতার মিলিত সেই বিপ্লবে বন্দি অবস্থা থেকে মুক্ত হন সেনাপ্রধান জিয়াউর রহমান। পাল্টা অভ্যুত্থান ঠেকাতে গিয়ে প্রাণ হারান খালেদ মোশাররফ ও তার কতিপয় অনুসারী। পরদিন ৭ নভেম্বর সর্বস্তরের সৈনিক ও জনতা সম্মিলিতভাবে নেমে আসে ঢাকার রাস্তায়, ছড়িয়ে পড়ে সারাদেশে। অভূতপূর্ব এক সংহতির নজির সৃষ্টি হয় দেশের রাজনীতিতে। তারপর থেকেই ৭ নভেম্বর পালিত হচ্ছে ‘জাতীয় বিপ্লব ও সংহতি দিবস’ হিসেবে। বিএনপি সরকারের সময়ে এ দিনটিতে সরকারি ছুটি ঘোষণা করা হয়।
পরাজয় হলে নিশ্চিত মৃত্যু জেনেও ২৭ মার্চ ১৯৭১ সালে মেজর জিয়াউর রহমান চট্টগ্রামের কালুর ঘাট বেতার কেন্দ্রে যান এবং স্বাধীনতার ঐতিহাসিক ঘোষনা দিয়েছিলেন, যা তাকে অসীম সাহসী দেশ প্রেমিক হিসেবে অসামান্য উচ্চতা দান করেছে। স্বাধীনতার ঘোষণার দিনক্ষণ সংক্রান্ত একটি বিষয় স্পষ্ট হওয়া দরকার। জিয়াউর রহমানের সহকর্মীদের ভাষ্য অনুযায়ী ২৫ ও ২৬ মার্চের মধ্যবর্তী রাতে তিনি সর্বপ্রথম তার সৈনিকদের কাছে স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়েছিলেন; পরবর্তীতে ২৬ তারিখে আরেকবার এবং ২৭ মার্চ পুনরায় রেডিওতে স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়েছিলেন। শ্বাসরুদ্ধকর মুক্তিযুদ্ধের অবসান হয় ১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১ সালে লাখো মা বোনের ইজ্জত ও শহীদের রক্তের বিনিময়ে । রণাঙ্গনে অবদানের স্বীকৃতি স্বরুপ জিয়াউর রহমানকে ১৯৭২ সালে যুদ্ধ ফেরত মুক্তিযোদ্ধাদের সর্বোচ্চ ”বীর উত্তম” খেতাবে ভূষিত করা হয়।
সন্দেহাতীত ভাবেই তৎকালীন সরকারের পক্ষ থেকে গৃহীত এটি একটি প্রশংসনীয় উদ্যোগ। পেশাদারিত্ব তাঁর চারিএিক বৈশিষ্ঠের অন্যতম প্রধান একটি দিক। দেশ প্রেমের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ জিয়াউর রহমান নিজ পেশায় ফিরে যান। তারপর প্রায় চার বছর গত হয়।
১৯৭৫ এর ১৫ ই আগষ্টে পট পরিবর্তনের পর রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হন খন্দকার মোস্তাক এবং সামরিক আইন জারি করেন। সংবিধান বলবৎ রাখলেও সংশোধনী এনে নাগরিক অধিকারের পরিধি আশঙ্কাজনক ভাবে সংকুচিত করেন। রাষ্ট্রপতি মোশতাক আহমেদ ২৬ সেপ্টেম্বর ১৯৭৫-এ ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ জারি করার মাধ্যমে ১৫ই আগষ্টে অভ্যুত্থান ও হত্যাকান্ডে জড়িত সেনা কর্মকর্তাদের আইনি সুরক্ষা দেয়ার ব্যবস্থা করেন।
এ আদেশে বলা হয়েছিলো,১৫ই আগষ্ট অভ্যুত্থানের সাথে জড়িত কারো বিচার করা যাবেনা (মহিউদ্দিনআহমদ,২০১৭, পৃ-৬৪) যা প্রমান করে, বাকশাল সরকারের তৎকালীন বানিজ্য মন্ত্রী খন্দকার মোশতাক আহমেদ ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ জারি করে ১৫ই আগষ্টের অভ্যুত্থানকারী ও হত্যাকান্ডের সাথে জড়িতদের আইনি সুরক্ষা দিয়েছেন; জিয়াউর রহমানের বিরুদ্ধে আনিত অভিযোগ সবৈব মিথ্যা।
রাজনীতির এই চরম অস্থিতিশীল পরিস্থিতে জিয়াউর রহমান ক্ষমতার দৃশ্যপটে চলে আসেন। সঙ্কট, সন্দেহ, পারস্পরিক দোষারোপ, কু ও পাল্টাকু এর অগ্নিঝরা নভেম্বরের প্রথম সপ্তাহে সিপাহি-জনতা অবরুদ্ধ জিয়াকে মুক্ত করে কিভাবে দেশ পরিচালনা গুরু দায়িত্ব প্রদান করেছেন সে সম্পর্কে ইতিহাস সচেতন দেশবাসী অবগত আছেন। এই ইতিবাচক ঘটনাটিকে যথাযথ মর্যাদা দানের লক্ষ্যে ৭ নভেম্বরকে ”জাতীয় বিপ্লব ও সংহতি দিবস’ হিসেবে পালন করা হয়। জিয়াউর রহমান যখন সেনাপ্রধান হন তখন সামরিক বাহিনী ছিল নানা দল উপদলে বিভাজিত। রাজনৈতিক দলগুলো ছিল পরস্পর বৈরী। সামরিক বাহিনীতে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনা এবং রাষ্টক্ষমতা প্রয়োগের আইনি ভিত্তি তৈরী করার জন্য রাজনৈতিক দল তৈরী করে রাজনীতিকে সেনা ছাউনি থেকে জনগণের হাতে ফিরিয়ে দেয়ার আন্তরিক চেষ্টায় নিমগ্ন ছিলেন। ফলাফল হিসেবে ১৯৭৮ সালে ১লা সেপ্টেম্বর বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) গঠিত হয়।
জিয়াউর রহমান দায়িত্ব গ্রহণের মাধ্যমে কেবল শাসক পরিবর্তন হয়েছে তা নয় বরং বাংলাদেশ রাষ্ট্র কেমন হবে; এর দার্শনিক ভিত্তি কি হবে, তার একটি সুনির্দিষ্ট ও প্রায়োগিক রূপরেখা পাওয়া গিয়েছে। জিয়াউর রহমান প্রতিশোধ পরায়ান ছিলেন না। বহুবার বৈষম্য ও অবজ্ঞার শিকার হয়েও তিনি শত্রু চিহ্নিত করে নির্মুল করার পথে না হেটে বাংলাদেশকে একটি কার্যকর রাষ্ট্র হিসেবে গঠন করার নিমিত্তে সর্বস্থরের জ্ঞাণী-গুনী মানুষের সম্মেলন ঘটিয়েছেন।
বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদের দার্শনিক ভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠিত রাজনৈতিক দল- বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) গঠন করেছেন, যা পর্যায় ক্রমে ধর্ম, বর্ণ, গোত্র নির্বিশেষে দেশপ্রেমে উদ্ভুদ্ধ মানুষের মিলন মেলায় পরিনত হয়েছে। সমালোচকদের ভুল প্রমান করে এই দলটি জনগণের সমর্থন আদায় করে প্রভাবশালী দল হিসেবে শুধুমাত্র স্থায়ীত্বই অর্জন করেনি বরং জিয়া পরবর্তী সময়ে তিনবার গ্রহনযোগ্য অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচনে বিজয় লাভ করে সরকার পরিচালনা করেছে।
আজ থেকে একশ বছর আগে ১৯১৭ সালে রাশিয়ায় বলশেভিক পার্টির নেতা ভি আই লেনিনের নেতৃত্বে অক্টোবর বিপ্লব এবং ৪২ বছর আগে ১৯৭৫ সালের ৭ নভেম্বর বাংলাদেশে জাতীয় সিপাহী- বিপ্লব একই সুত্রে গাঁতা। বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ সমাজ বিপ্লব নিয়ে যারা স্বপ্ন দেখেন তারা রুশ বিপ্লবের মডেলে ৭ নভেম্বর অভ্যুত্থান থেকে শিক্ষা নিতে পারেন।
রাশিয়ায় জুলিয়ান ক্যালেন্ডারে ১৯১৭ সালের ২৫ অক্টোবরে সূচিত হয়েছিল বলে পৃথিবীর প্রথম সফল সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবটি ‘অক্টোবর বিপ্লব’ হিসেবে পরিচিতি পেয়েছে। নতুন গ্রেগোরিয়ান বর্ষপঞ্জী অনুযায়ী তারিখটি পড়ে ১৯১৭ সালের ৭ নভেম্বর। তাই নভেম্বর বিপ্লব হিসেবেও তা পরিচিত। কাকতালীয়ভাবে রাশিয়ার সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব এবং বাংলাদেশে সৈনিক-জনতার অভ্যুত্থান ৭ নভেম্বর তারিখে অনুষ্ঠিত হয়েছিল।
বিভিন্ন যুগে মানবজাতির উপর চেপে বসা শোষণ-বঞ্চনা-বৈষম্যের অবসানের লক্ষ্যে সমাজের নিপীড়িত শ্রেণী বিপ্লবী অভ্যুত্থানে অংশ নিয়েছে। রোমে অভিজাত শ্রেণীর দাস নিপীড়নের বিরুদ্ধে স্পারটাকাসের বিদ্রোহ, ফ্রান্সে সর্বহারা শ্রেণীর প্যারী কমিউন ছাড়াও বাংলাদেশ সহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে লাঞ্ছিত-বঞ্চিত শ্রেণী লড়াই-সংগ্রাম করেছে। কিন্তু লেনিনের নেতৃত্বে নভেম্বর বিপ্লবের মধ্য দিয়ে পৃথিবীতে প্রথমবারের মতো সর্বহারা শ্রেণীর সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল।
পেট্রোগ্রাড (সেইন্ট পিটার্সবার্গ) শহরে ভ্লাদিমির ইলিচ লেনিনের নেতৃত্বে বলশেভিক পার্টির এই সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবটির সূচনা করেছিল বিপ্লবী শ্রমিক-জনতা এবং সৈনিকেরা। সৈনিকদের অধিকাংশ ছিল রাশিয়ার গরীব কৃষক শ্রেণী থেকে আগত। এক অর্থে তারা ছিল সেনা উর্দি পরা কৃষক। এ ছাড়াও পেট্রোগ্রাডের শ্রমিক-সৈনিক অভ্যুত্থান নাড়া দিয়েছিল সারা রাশিয়াকে। অভ্যুত্থানে রাশিয়ার গরীব কৃষকেরা যোগ দিয়েছিল ব্যাপকভাবে।
অক্টোবর বিপ্লবের সাত মাস আগে মার্চের ৮ তারিখে পেট্রোগ্রাড শহরের রাজপথ প্রকম্পিত করেছিল রুটির দাবীতে ভুখা মানুষেরা। তাদের সমর্থনে এগিয়ে আসে বিপুল সংখ্যক বিপ্লবী কারখানা শ্রমিক। জারের পুলিশের গুলির মুখেও তারা রাজপথ আঁকড়ে থাকে। ১০ মার্চের মধ্যে বিক্ষোভ অভ্যুত্থানে রুপ লাভ করে। পেট্রোগ্রাডের বহু কারখানায় গড়ে ওঠে শ্রমিক সোভিয়েত। এমন সংগঠনের সাথে শ্রমিকেরা পরিচিত। ১২ বছর আগে ১৯০৫ সালের জার-বিরোধী বিপ্লবে এমন সোভিয়েত গড়ে উঠেছিল বহু কারখানায়।
১৯১৭ সালের ১১ মার্চ তারিখে এই বিক্ষোভ দমনে নামানো হয় পেট্রোগ্রাড গ্যারিসনের সেনাদলকে। প্রথম দিকে গুলিও চালায় তারা। কিন্তু বিক্ষোভকারিদের দমাতে পারে না। বরং সৈনিকদের মনোবলে চিড় ধরে। জার দ্বিতীয় নিকোলাস তার রাষ্ট্রীয় ডুমা (পরামর্শ সভা) ভেঙ্গে দেন যা তিনি গঠন করেছিলেন ১৯০৫ সালের বিপ্লবের পর। তাতে কাজ হয় না। সৈনিকেরা যোগ দিতে থাকে অভ্যুত্থানী শ্রমিক-জনতার সাথে।
পরদিন ১২ মার্চ। রোমানভ রাজতন্ত্রের শেষ রক্ষাব্যূহ রাশিয়ার রাজধানী পেট্রোগ্রাড সেনা গ্যারিসনের বিভিন্ন রেজিমেন্টের সৈনিকেরা দলে দলে যোগ দেয় অভ্যুত্থানে। রাতারাতি গড়ে উঠতে থাকে সৈনিক সোভিয়েত। এক দিকে গঠিত হয় অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের। অন্যদিকে উত্থান ঘটে শ্রমিক ও সৈনিক প্রতিনিধিদের নিয়ে পেট্রোগ্রাড সোভিয়েত। সরকারের সাথে চুক্তি হয় পেট্রোগ্রাডের শ্রমিক ও সৈনিক সোভিয়েতের। তাই বলা যায় রুশ রাজতন্ত্রের পতনের পর দুইটি কর্তৃত্বের উদ্ভব ঘটে। পুঁজিপতি বুর্জোয়া শ্রেণী ও সর্বহারা শ্রেণীর কর্তৃত্ব। এই বিশেষ পরিস্থিতি শ্রমিক ও সৈনিক সোভিয়েত নভেম্বর বিপ্লবের বিজয়ী হওয়ার পেছনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। এই সোভিয়েত বিপ্লব যেভাবে সংঘটিত হয়ে বিজয় অর্জন করেছে ঠিক সেই ভাবে বাংলাদেশের ৭ নভেম্বর বিপ্লব ও সংহতি দিবসের বিজয়ী পতাকা উড্ডীন করেছেন মহান স্বাধীনতার ঘোষক শহীদ রাষ্ট্রপ্রতি জিয়াউর রহমান । সেই সাথে গণতন্ত্রের মহানায়ক চির অমরত্ব শহীদ জিয়া।
গণতন্ত্রে ভিন্নমত থাকবে, থাকা বাঞ্ছনীয়-কথাটা আমরা প্রায়ই উচ্চারণ করে থাকি। জোরেশোরে উচ্চারিত হয় যখন কোনো সামাজিক বা রাষ্ট্রীয় সমস্যার মুখোমুখি হই আমরা। চলে কথার পিঠে কথা। আর এটাই ভিন্নমত।
গণতন্ত্র হলো সেই বস্তু যেখানে চিন্তার স্ব্বাধীনতা, কথা বলার স্বাধীনতা, কাজের স্বাধীনতা আর উপাসনার স্বাধীনতা থাকবে। এটাই গণতন্ত্রের মতাদর্শ। সাম্য গণতন্ত্রের মুখ্য উদ্দেশ্য। তাই ব্যক্তির মূল্য আর মর্যাদাদানই গণতন্ত্রের প্রথম কথা। গণতন্ত্র শব্দটির অর্থ জনগণের ক্ষমতা। অর্থাৎ সরকার বা শাসনব্যবস্থা যখন জনগণের অভিমতের ভিত্তিতে পরিচালিত হয় তখন তাকে গণতন্ত্র বা গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা বলে। আমেরিকার প্রেসিডেন্ট আব্র্রাহাম লিংকন তার গেটিসবার্গ অ্যাড্রেসে বলেছিলেন, ‘গণতন্ত্র জনগণের সরকার, জনগণের দ্বারা গঠিত সরকার, জনগণের জন্য সরকার।’
তাই যদি হয় তাহলে কেন এত মতদ্বৈধ। এই তো দিন কয়েক আগে রবীন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকজন ছাত্রের চুল কেটে দেওয়ার অভিযোগ উঠেছে একজন শিক্ষকের বিরুদ্ধে। ছাত্রদের অধিকার আছে লম্বা চুল রাখার, মাথা ন্যাড়া করার, ঝুঁটি বাঁধার বা যেমন ইচ্ছা তেমনভাবে চুলের ফ্যাশন করার। এটা তাদের মত। শিক্ষকের মত ভিন্ন। সেটা তার পছন্দ নয়। তাতে কোনো সমস্যা নেই। কিন্তু তিনি কারো স্বাধীনমতে হস্তক্ষেপ করতে পারেন না। বিষয়টি যদি শিক্ষায়তনের শৃঙ্খলার পরিপন্থি হয় তিনি নোটিশ করতে পারেন; কিন্তু নিজ হাতে ব্যবস্থা তুলে নিতে পারেন না। সেজন্য প্রশাসন আছে। এই যে ছেলেরা ভাবছেন তারা চুল রাখতে পারেন আর শিক্ষক ভাবছেন পারেন না এটাই ভিন্নমত। এই ভিন্নমত থাকার স্বাধীনতা গণতন্ত্রে আছে । এটা গণতান্ত্রিক অধিকার।
বছর দুয়েক আগে বুয়েটের মেধাবী ছাত্র আবরার ফাহাদকে পিটিয়ে মেরে ফেলেছিল তারই সহপাঠীরা। আবরারের অপরাধ সে তার মত প্রকাশ করেছিল। সে মত তার সহপাঠীদের কারো কারো পছন্দ হয়নি। আর তার পরিণতিতে জীবন দিতে হলো আবরারকে। প্রশ্ন হচ্ছে কেন? নিজের মত বলার অধিকার তো তার আছে। গণতন্ত্র তাকে সে অধিকার দিয়েছে। তাহলে কেন তাকে মরতে হলো?
আমাদের শিক্ষার্থীরা একটি সড়ক দুর্ঘটনার প্রতিবাদে ‘সড়ক আন্দোলন’-এ নেমেছিল। তারা প্রচলিত সড়ক নিয়ন্ত্রণকে ক্রটিপূর্ণ মনে করেছিল। সড়কের দায়িত্ব তারা নিজ হাতে নিয়ে নিয়েছিল। তাতে যথেষ্ট সুফলও হয়েছিল। দেশবাসী অবাক হয়ে সপ্রশংস দৃষ্টিতে তাকিয়ে দেখেছিল ছোট ছোট ছেলে-মেয়ে কী সুশৃঙ্খলভাবে ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণ করছে। তারপর শুরু হলো তাদের মতের প্রতি অনাস্থা। পরিণতি আপনাদের জানা।
সমস্যা হচ্ছে আমরা ভিন্নমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল নই। অশ্রদ্ধা দেখাতে গিয়ে আমরা আমাদের অধিকারের আওতায় সীমাবদ্ধ থাকছি না। যা বলা যায় তাও বলছি, যা বলা যায় না তাও বলছি। যা করা যায় তাও করছি, যা করা যায় না তাও করছি। তাই একজন মাননীয় সংসদ সদস্য মহান সংসদে দাঁড়িয়ে প্রস্তাব করতে পারছেন, ‘চাকরীজীবী ছেলে-মেয়েরা পরস্পরকে বিয়ে করতে পারবে না এই আইন প্রণয়ন করা হোক।’ আর আইনমন্ত্রী মহোদয়ও বলতে পারছেন, ‘এটা সংবিধান পরিপন্থি। এই প্রস্তাব নিয়ে আমি দু’কদমও এগোতে পারব না।’
ফরাসি দার্শনিক রুশো প্রতিনিধিত্বমূলক গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থাকে গণতন্ত্র বলতে নারাজ ছিলেন। তিনি মনে করতেন, জনপ্রতিনিধিরা জনস্বার্থে কাজ না। তারা কাজ করে নিজের স্বার্থে। তার এই মত যে কতটা অভ্রান্ত ছিল দেশের দিকে তাকালেই সেটা বোঝা যায়। তিনি প্রত্যক্ষ গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার পক্ষে ছিলেন যাতে জনগণের স্বার্থ সুরক্ষিত থাকে। আর প্লেটো গণতান্ত্রিক শসন ব্যবস্থাকে সবচেয়ে অযোগ্য শাসনব্যবস্থা মনে করতেন। তার মতে, যেহেতু গণতন্ত্র বেশিরভাগ জনগোষ্ঠীর দ্বারা পরিচালিত শাসন ব্যবস্থা, সেহেতু গণতন্ত্র কখনোই উন্নতমানের শাসনব্যবস্থা হিসেবে পরিগণিত হতে পারে না। কারণ প্রত্যেক রাষ্ট্রেই বিজ্ঞানী, সুপণ্ডিত এবং যোগ্য লোকের তুলনায় অযোগ্য অশিক্ষিত এবং অজ্ঞ লোকের সংখ্যাই বেশি। সুতরাং বেশিরভাগ লোকের শাসন মানেই অযোগ্যের শাসন। তার মতে গণতন্ত্র সংখ্যায় বিশ্বাসী, গুণে নয়।
প্লেটোর এ কথাকেও উড়িয়ে দেওয়া যায় না। আজকাল শাসন ক্ষমতা অযোগ্যেরই হাতে। জনগণ ভোট দিয়ে বা ভোট না দিয়ে যাদের নির্বাচন করেন তারা বেশিরভাগই ব্যাক বেঞ্চার। ছাত্র জীবনে তৃতীয় ক্যাটাগরির ছাত্র ছিলেন। প্রথম ক্যটাগরির ছাত্ররা তাদের অধস্তন হিসেবে চাকরি করেন আর তারা রাজনীতি করে জনপ্রতিনিধি বনে যান। তাদের মতমতের ভিত্তিইে সরকার পরিচালিত হয়। আর তাদের স্বল্পশিক্ষা আর কূপমণ্ডূকতার কারণে ভিন্নমত প্রকাশ অমার্জনীয় অপরাধের পর্যায়ে পড়ে। বিরোধী রাজনীতি করা অপরাধ বলে গণ্য হয়। আর এসব কাজ যখন তারা করেন তখন ভুলে যান, একসময় ভিন্নমত পোষণ করলে আর বিরোধী দল হলে তাদেরও এই অবস্থা হবে।
এ এক অভিন্ন চিত্র, অতীতে যা হয়েছে এখনো তাই হচ্ছে। তারপও বলি, এতসব সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও, সারা বিশ্বে গণতন্ত্র এখনো সবচেয়ে জনপ্রিয় জননন্দিত শাসনব্যবস্থা। কারণ এখানে ভোটের মাধ্যমে সরকার গঠনের সুযোগ রয়েছে। আর এ সুযোগ আছে বলেই জনগণের কাছে জবাবদিহিতা আছে। আর জবাবদিহিতা আছে বলেই রাষ্ট্রের উন্নয়নের ধারা অব্যাহত আছে। এখানেই এ শাসন ব্যবস্থার মৌলিকত্ব, বিশেষত্ব ও গুরুত্ব। ভোটের মাধ্যমে জনগণ মত প্রকাশে বা সঠিক রায় প্রদানে ভুল করলেও সেটা গণতন্ত্র এবং জনগণের শাসন। এই গণতান্ত্রিক যুগে, আমরা অতীতের রাজতন্ত্র, স্বৈরতন্ত্র বা সামরিকতন্ত্রের কথা স্বপ্নেও ভাবতে পারি না।
তবে সব শেষ কথা একটাই, গণতন্ত্রে ভিন্নমত, ভিন্ন বিশ্বাসের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হওয়া জরুরি। সংখ্যাগরিষ্ঠের মতামতের প্রতি প্রাধান্য দেওয়া জরুরি। তবে সে মতামত যদি হয় সত্য ন্যায় স্বাধীনতার বিপক্ষে, আর প্রতিক্রিয়াশীলতার পক্ষে সেটা কিন্তু মেনে নেওয়া মোটেই জরুরি নয়। কারণ পৃথিবীতে সবচেয়ে বড় কথা, সত্য সুন্দর আর ন্যায়ের প্রতিষ্ঠা। স্বাধীনভাবে মাথা উঁচু করে বেঁচে থাকা। আর সেই গণতান্ত্রিক রাস্তা ও স্বাধীন মতপ্রকাশের অধিকার প্রতিষ্ঠা করে গিয়েছেন মহান স্বাধীনতার ঘোষক শহীদ রাষ্ট্রপ্রতি জিয়াউর রহমান ।
[লেখকঃ ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক ও প্রকাশক: বাংলা পোস্ট বিডি, প্রাবন্ধিক ও প্রতিষ্ঠাতা আহবায়ক জাতীয় জনতা ফোরাম]
এই রকম সংবাদ আরো পেতে হলে এই লেখার উপরে ক্লিক করে আমাদের ফেসবুক ফ্যান পেইজে লাইক দিয়ে সংযুক্ত থাকুন। সংবাদটি সম্পর্কে মন্তব্য করতে হলে এই পেইজের নীচে মন্তব্য করার জন্য ঘর পাবেন