‘টাকা চাহিছিল দশ হাজার, মুই কহিছু দিতে পারবনা, শেষ পর্যন্ত পাঁচ হাজার’
সর্বোত্তরের জেলা পঞ্চগড়ের তেঁতুলিয়া উপজেলার সেটেলমেন্ট অফিসে টাকা দাবি দশ হাজার কাকুতি মিনতি করে পাঁচ হাজার টাকা দিয়েছেন তমিদুল নামের গরীব অসহায় ব্যক্তি। সে উপজেলার দেবনগড় ইউনিয়নের ভুটুজোত গ্রামের মজিবর রহমানের ছেলে। এ ধরণের অমানবিক ও অনিয়ম-দুর্নীতির বৈশিষ্ট্য দেখিয়েছেন ওই অফিসের উপ-সহকারী সেটেলমেন্ট অফিসার আইয়ুব আলী, ড্রাফটস্ম্যান সেলিম রেজা ও বহিরাগত দালাল তরিকুল ইসলাম। এই সেটেলমেন্ট অফিসে ছাপা খতিয়ান বিতরণ, মাঠ জরিপ, হাজিরা ফি ও আপত্তি শুনানীসহ বিভিন্ন কার্যক্রমে ব্যাপক দুর্নীতি ও অনিয়ম চলছে ওপেন সিক্রেট। এ নিয়ে ভুক্তভোগীদের মাঝে ব্যাপক ক্ষোভের সৃষ্টি হলেও তাদের কাছে কাবু হয়ে কপালে হাত রেখে বসে থাকতে হয়।
ভুক্তভোগীদের ভাষ্যমতে, তেঁতুলিয়া সেটেলমেন্ট অফিসে খানকি কিসমত মৌজার ছাপা খতিয়ান বিতরণ শেষে সর্দারপাড়া মৌজার মাঠ জরিপ এটেস্টেশন ২৯ ধারা, শেখগছ মৌজার মাঠ জরিপ, এটেস্টেশন, ২৯ ধারা শেষে ৩০ ধারা আপত্তি শুনানী এবং মাথাফাটা মৌজার মাঠ জরিপ, পর্চা সরবরাহসহ ২৯ধারা চলছে। এসব কার্যক্রমে ওই অফিসে খোলামেলাভাবেই চলছে ঘুষ বাণিজ্য। অফিসের গঠিত চক্রের মাধ্যমে বহিরাগত সদর ইউনিয়নের খালপাড়া গ্রামের এনামুল হকের ছেলে তরিকুল ইসলাম, তিরনইহাট ইউনিয়নের মুনিগছ গ্রামের ইসমাইল হকের ছেলে মোফাজ্জল (বর্তমানে মাস্টার রোলে নৈশ্যপ্রহরী), উপজেলার দেবনগড় ইউনিয়নের নন্দগছ গ্রামের মতিয়ার (বর্তমানে মাস্টার রোলে পরিচ্ছন্ন কর্মী), শালবাহানহাট ইউনিয়নের ক্লান্দিগঞ্জ গ্রামের মৃত নজরুল ইসলামের ছেলে আমানকে দালাল সরুপ আফিসের চেয়ার টেবিলে বসিয়ে এবং উপজেলার দেবনগড় ইউনিয়নের হরবাবি গ্রামের রিপন, বাংলাচন্ডি গ্রামের মহসিন, ফতুয়াপাড়া গ্রামের আশরাফুলসহ আরোও ২ থেকে ৩জনকে অফিসের বাহিরে সাধারন মানুষকে বুঝানোর জন্য ছড়িয়ে ছিটিয়ে রেখে অফিস কর্মকর্তা কর্মচারীদের সহযোগে আদায় করা হচ্ছে মোটা অংকের ঘুষের টাকা। ভাগবাটোয়ারা করা হয় লেভেল বুঝে।
সরেজমিনে সেটেলমেন্ট অফিসে ঘুরে দেখা গেছে, অফিসের তথাকথিত নৈশ্যপ্রহরী মোঃ মোফাজ্জল ও বহিরাগত দালাল তরিকুল ইসলাম এবং আমান শেখগছ মৌজার ৩০ধারা আপত্তি শুনানীকালে অফিসের ভিতরে করিডোরে চেয়ার-টেবিল নিয়ে বসে প্রতি কেস হাজিরা ফি ১০০ টাকা নিয়ে বিচারকের টেবিলে জমা দেয়। অপরদিকে অফিসের পরিচ্ছন্ন কর্মী মতিয়ার রহমানকে দিয়ে করানো হয় আপত্তি কেসের নকল লেখা থেকে শুরু করে অফিসিয়াল বিভিন্ন কাজ। এছাড়া অন্যান্য জনেরা সাধারন মানুষদের কাছ থেকে টাকা আদায়ের কৌশল অবলম্বন করে কিভাবে তরিকুল, মতিয়ার, মোফাজ্জল, আমান ও সেলিম পর্যন্ত নিয়ে যাওয়া যায় অফিস কর্তৃক মৌখিকভাবে নিয়োজিত রয়েছেন। শুধু তাই নয়, বিভিন্ন মৌজার মাঠ জরিপকালে কিংবা আপত্তি শুনানীর মঞ্জুরকৃত কেসের খতিয়ান গ্রহণে অতিরিক্ত টাকা প্রদানে অস্বীকৃতি জানালে ভুক্তভোগীদের পোহাতে হয় নানা লাঞ্ছনা।
গরীব অসহায় ভুক্তভোগী তমিজুল হক জানান, শেখগছ মৌজার ২৫৭৮ ও ২৫৭৯ নং আপত্তি কেসের শুনানী প্রায় ৪ মাস হল এখনও পর্চা দিচ্ছেনা। টাকাও নিয়েছেন। তিনি বলেন, শুনানীর পর ওই অফিসের বিচারক আইয়ুব আলী খরচা লাগবে জানিয়েছে। এতে ড্রাফটসম্যান সেলিম ও দালাল তরিকুল ৫৯ শতাংশ জমির পর্চা খতিয়ান দিতে ১০হাজার টাকা দাবি করলে অনেক কাকুতি মিনতির পর বিনা রশিদে পাঁচ হাজার টাকা হাতিয়ে নেয় তাঁরা।
ওই মৌজার ভুক্তভোগী হাটুপাড়া গ্রামের মৃত হবিবর রহমানের ছেলে আছিরুল ইসলামের কাছ থেকে আপত্তি শুনানীর পর ৯শতাংশ জমির পর্চা সরবরাহে নেয় ৫হাজার টাকা। দেবনগড় ইউনিয়নের বানিয়াপাড়া গ্রামের ভুক্তভোগী আনছারুল ও তার ভাতিজা জানান, বাদীভুক্ত করতে মোফাজ্জল নিয়েছেন দুই হাজার টাকা পর্চা নিতে দুই হাজার টাকা সে চাইছিল দশ হাজার টাকা। তদন্ত করতে নিয়েছেন এক হাজার টাকা।
এছাড়াও হাটুপাড়া গ্রামের রিয়াজুলসহ আরোও আনেক ভুক্তভোগী জানান, আপত্তি শুনানীর খতিয়ান নিতে সেটেলমেন্ট অফিসে গেলে তরিকুল সেলিম ও মোফাজ্জল তাদের কাছ থেকে প্রতি খতিয়ানে ১ হাজার থেকে ৫হাজার টাকা করে চায়। পরে অনেক দরাদরি করে জমির পরিমান বুঝে কোনো খতিয়ান ২হাজার আবার কোনো খতিয়ান দেড় হাজার টাকা করে নেন। দালাল তরিকুলের ও তথাকথিত নৈশ্যপ্রহরী মোফাজ্জলের কাছ থেকে খতিয়ান না নিলে অনেক ভোগান্তির শিকার হতে হয় বলেও জানান ভুক্তভোগীরা।
ইতোপূর্বে খানকি কিসমত মৌজার ছাপা খতিয়ান সরবাহেরর সময় ৬৬৩, ১৮৫ ও ২৩৪ নং খতিয়ানের ভুক্তভোগীদের সঙ্গে কথা হলে তাঁরা জানান, এই ছাপা খতিয়ান নিতে তাদের পেশকার আবুল কালাম আজাদকে রশিদ ছাড়াই দিতে হয়েছে ২’শ থেকে শুরু করে ৫’শ টাকা পর্যন্ত। তাঁরা আরোও বলেন, জরিপ শুরু হওয়ার পর থেকে বাপ-দাদাদের জমি টিকিয়ে রাখতে দফায় দফায় জরিপ আমিনদেরকে জমির মূল্য দিয়ে জমি কিনে নেয়া হয়েছে।
সম্প্রতি উপজেলা সদরের মাথাফাটা গ্রামের কয়েকজন ভুক্তভোগী জানান, বর্তমানে মাথাফাটা মৌজার মাথাফাটা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে মৌজার কাজ চলছে। এই মৌজার কাজ করছে উপ-সহকারী সেটেলমেন্ট অফিসার আইয়ুব আলী, ড্রাফটসমেন্ট সেলিম রেজা, দালাল তরিকুলসহ আরো অনেক দাললও রয়েছেন। ভুক্তভোগীরা বলেন, মাঠ পর্চা সরবরাহে নেয়া হচ্ছে ৫’শ থেকে শুরু করে ২০ হাজারেরও অধিক টাকা। টাকা দিতে অস্বীকার করলে জমির মালিকানা কাগজ তো আছে বটেই তবুও খাজনা খারিজ বিভিন্ন কাগজের ঘারতি দেখিয়ে সেসব কাগজ জোগার করিয়ে নিয়ে আসতে বলেন। এতে টাকা দিলে বাড়তি কাগজের প্রয়োজন হয়না।
তবে অনেক ভুক্তভোগীরাই জানান, বড় স্যার টাকা নেয়না। তিনি শেখগছ মৌজার আপত্তি শুনানীর অবৈধভাবে হাজিরার টাকা নেয়া বন্ধ করেন। এখন যারা নিচ্ছে তারা স্যারের অজান্তে লুকিয়ে নেই। আগে প্রকাশ্যে টাকা নিত।
এ বিষয়ে সহকারী সেটেলমেন্ট অফিসার মফিজুর রহমান বলেন, তিনি আসার পর অনেকটা অনিয়ম-দুর্নীতি কমিয়ে আনা হয়েছে। এই অনিয়ম-দুর্নীতির অভ্যাস দুর হতে একটু সময়ের ব্যবধানও লাগবে। আপনি জানতে পারবেন আমি ওই সমস্ত কাজ থেকে একটু দুরেই থাকি। তিনি বলেন, অফিসে হাজিরা নেয়া হচ্ছিল। তিনি হাজিরা নেয়া উম্মুক্তভাবে বন্ধ করেছেন। পরবর্তীতে যদি কেউ আমার অজান্তে গোপনে হাজিরা নেই তার বিরুদ্ধে তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা নেয়া হবে। উপ-সহকারী সেটেলমেন্ট অফিসার আইয়ুব আলী, ড্রাফটমেন্ট সেলিম ও দালাল তরিকুল কর্তৃক একজন গরীব অসহায় ব্যক্তিকে মাসের পর মাস এবং আর্থিক লেনদেনের বিষয়ে একটি ভিডিও সাক্ষাৎকার অবগত করলে তিনি এ বিষয়ে অভ্যান্তরীণ আলোকপাত করেন। পরে ওই অফিসের ড্রাফটসমেন্ট আমার সঙ্গে মুঠোফোনে অফিসে আসার কথা বলেন, যেন বিষয়টি আপোষ করা হয়।
এ ব্যাপারে পঞ্চগড় জেলা প্রশাসক মোঃ জহুরুল ইসলামের সঙ্গে কথা হলে তিনি জানান, ভূমি অফিসের উর্ধ্বতন কর্মকর্তাকে বলবেন এবং তিনি নিজেও বিষয়টি দেখতে চেয়েছেন।
এই রকম সংবাদ আরো পেতে হলে এই লেখার উপরে ক্লিক করে আমাদের ফেসবুক ফ্যান পেইজে লাইক দিয়ে সংযুক্ত থাকুন। সংবাদটি সম্পর্কে মন্তব্য করতে হলে এই পেইজের নীচে মন্তব্য করার জন্য ঘর পাবেন