আন্দোলন-কর্মসূচির পাশাপাশি সব পর্যায়ের কমিটি ঢেলে সাজাবে বিএনপি

নির্বাচনকালীন নির্দলীয় ও নিরপেক্ষ সরকারের দাবিতে চূড়ান্ত আন্দোলনে যাওয়ার আগে পুনর্গঠনের কাজ শেষ করতে চায় বিএনপি। এজন্য চলমান নানা ইস্যুতে আন্দোলন-কর্মসূচির পাশাপাশি জেলা থেকে ইউনিয়ন পর্যন্ত সব পর্যায়ের কমিটি ঢেলে সাজানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে দলটি। জুনের মধ্যে মেয়াদোত্তীর্ণ সাংগঠনিক জেলা ও ইউনিটে কাউন্সিল করে সরাসরি ভোটে নেতৃত্ব নির্বাচনের নির্দেশ দিয়েছে হাইকমান্ড। সেই অনুযায়ী গত সপ্তাহে বগুড়া জেলার সদর উপজেলা ও পৌর ইউনিটের কমিটি গঠন করা হয়েছে।
এছাড়া চলতি মাসে সিলেট, দিনাজপুর, ঢাকা, গাজীপুর জেলাসহ অন্তত ১৫ সাংগঠনিক জেলা ও ৫০টি ইউনিটে কাউন্সিল হওয়ার কথা রয়েছে। বিএনপি সূত্রে জানা গেছে এসব তথ্য।

বিএনপির একাধিক সিনিয়র নেতা জানান, ২০১৮ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর থেকে ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান দল পুনর্গঠনের উদ্যোগ নেন। পরে করোনা মহামারি ও রাজনৈতিক পরিস্থিতি বড় বাধা হয়ে দাঁড়ায়। কিন্তু সম্প্রতি র‌্যাব ও সংস্থটির সাবেক-বর্তমান সাত কর্মকর্তার ওপর মার্কিন নিষেধাজ্ঞার পর দলের মধ্যে স্বস্তি ফিরেছে। বিএনপি মনে করছে, চলমান পরিস্থিতিতে সরকার চাপে রয়েছে। এই সুযোগে তারা দল পুনর্গঠনের কাজটি শেষ করতে সক্ষম হবে।

দলীয় সূত্রে জানা যায়, বিএনপির মোট ৮২ সাংগঠনিক জেলা শাখার মধ্যে ৫৬টিতে আহ্বায়ক কমিটি রয়েছে। তিন মাস মেয়াদে এসব আহ্বায়ক কমিটি গঠন করা হয়। নির্দেশনা ছিল নির্ধারিত সময়ের মধ্যে সংশ্লিষ্ট জেলার সব ইউনিটে কাউন্সিল করে কমিটি দিতে হবে। পরে একই প্রক্রিয়ায় জেলার নেতৃত্ব নির্বাচন হবে। শুধু যথাসময়ে নীলফামারী ও মানিকগঞ্জসহ কয়েকটি জেলা কাউন্সিল করে কমিটি করতে পেরেছেন। এছাড়া সব জেলার আহ্বায়ক কমিটির মেয়াদ শেষ হলেও নেতারা ইউনিটগুলোর কমিটি গঠনের কাজ শেষ করতে পারেনি। এনিয়ে হাইকমান্ড জেলা নেতাদের ওপর অসন্তুষ্ট।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বিএনপির দায়িত্বপ্রাপ্ত এক নেতা জানান, সম্প্রতি ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান টানা ৫ দিন ১০ সাংগঠনিক বিভাগের গুরুত্বপূর্ণ নেতাদের সঙ্গে বৈঠক করেন। থানা, উপজেলা, পৌরসভা ও ইউনিয়ন কমিটি গঠনের পর জুনের মধ্যেই মেয়াদোত্তীর্ণ সব জেলা শাখার সম্মেলন করার নির্দেশ দেন। কাউন্সিলের মাধ্যমে সরাসরি ভোটে নতুন নেতৃত্ব নির্বাচন করতে হবে। ইতোমধ্যে সাংগঠনিক জেলাসহ সংশ্লিষ্ট সব ইউনিটের কমিটি গঠন শুরু হয়েছে। সোমবার সিলেট ও ২৮ মার্চ দিনাজপুর জেলার কাউন্সিল হবে। সেখানে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর প্রধান অতিথি হিসাবে থাকবেন। ২৯ মার্চ গাজীপুর জেলা ও ৩০ মার্চ ঢাকা জেলা সম্মেলন হওয়ার কথা রয়েছে। এছাড়া শেরপুর, নেত্রকোনা, পটুয়াখালী, ঝালকাঠি, বগুড়া, রাজশাহী, সিরাজগঞ্জ, নাটোর, কক্সবাজার, চট্টগ্রাম দক্ষিণ ও খাগড়াছড়ি জেলা বিএনপির কাউন্সিল মার্চের মধ্যে সম্পন্ন করার নির্দেশনা রয়েছে।

বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী বলেন, ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান দেশনায়ক তারেক রহমান তৃণমূল থেকে গণতান্ত্রিকভাবে নেতৃত্ব নির্বাচন করার প্রক্রিয়াটি তত্ত্বাবধায়ন করছেন। সারা দেশের মেয়াদোত্তীর্ণ জেলা শাখা এবং থানা-উপজেলা-পৌর-ইউনিয়ন পর্যায়ে কাউন্সিল করে সরাসরি ভোটে নেতৃত্ব নির্বাচনের কাজ চলছে। আমরা রাষ্ট্রীয় গণতন্ত্রের জন্য লড়াই করছি। আমরা যদি দলের অভ্যন্তরে গণতন্ত্রের চর্চা না করি, তাহলে তো এটা সাংঘর্ষিক হয়ে যায়। সুতরাং ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান রাষ্ট্রীয় গণতন্ত্রের বিকাশের জন্য তৃণমূল থেকে নিজের দলের গণতান্ত্রিক চর্চার যে প্রক্রিয়া শুরু করেছেন, তা পুরোদমে চলছে।

এদিকে কাউন্সিল করার ক্ষেত্রে কাউন্সিলর (ভোটার) কারা হবেন, তা নিয়ে বেশ কয়েকটি জেলা শাখায় জটিলতা দেখা দিয়েছে।

নাম প্রকাশে অনেচ্ছুক উত্তর ও দক্ষিণাঞ্চলের চারটি জেলা শাখার নেতারা জানান, তাদের জেলার অর্ধেক থানা ও উপজেলার পূর্ণাঙ্গ কমিটি রয়েছে, বাকি অর্ধেক ইউনিটে ৫ সদস্যের আহ্বায়ক কমিটি রয়েছে। কিন্তু দলের গঠনতন্ত্র অনুযায়ী পূর্ণাঙ্গ কমিটি থাকতে হবে এবং তারাই কাউন্সিলর হবেন। অথচ উপজেলা ও থানা কমিটি পূর্ণাঙ্গ করার সুযোগ না দিয়ে তাড়াহুড়ো করে জেলা কমিটির কাউন্সিল করার জন্য জোর করছেন কয়েকজন দায়িত্বশীল কেন্দ্রীয় নেতা। এটি করা হলে ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের যে নির্দেশনা, গণতান্ত্রিক উপায়ে সরাসরি ভোটে নির্বাচনের সুন্দর প্রক্রিয়া তাতে ত্রুটি থেকে যাবে, যোগ্য ও পরীক্ষিত নেতারা ভোটদানের সুযোগ পাবেন না। তাই তারা সব ইউনিটের কমিটি দ্রুতই পূর্ণাঙ্গ করে জেলার কাউন্সিল দিতে চান। এজন্য ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের হস্তক্ষেপও কামনা করেছেন।

বিএনপির গঠনতন্ত্র অনুযায়ী, ইউনিয়ন ওয়ার্ড নির্বাহী কমিটি হবে ৫১ সদস্যের; ইউনিয়ন এবং মহানগর/পৌরসভা ওয়ার্ড নির্বাহী কমিটি হবে ৭১ সদস্যের; ইউনিয়ন কাউন্সিল ও ইউনিয়ন নির্বাহী কমিটি হবে ৭১ সদস্যের, উপজেলা/থানা কাউন্সিল ও উপজেলা/থানা নির্বাহী কমিটি হবে ১০১ সদস্যের, পৌরসভা কাউন্সিল ও পৌরসভা নির্বাহী কমিটিও ১০১ সদস্যের হবে।

এ প্রসঙ্গে রুহুল কবির রিজভী বলেন, গঠনতন্ত্র অনুযায়ী সব কাউন্সিল হবে, সেখানে যেভাবে বলা আছে সেভাবেই। সাংগঠনিক জেলার ক্ষেত্রে কাউন্সিলর হবে থানা বা উপজেলার নির্বাহী কমিটি। থানার ক্ষেত্রে হবে ইউনিয়ন নির্বাহী কমিটি।

সূত্র জানায়, একই প্রক্রিয়া মেনে ১১ মার্চ বিএনপির বগুড়া সদর উপজেলা ও ১২ মার্চ পৌর ইউনিটে দ্বিবার্ষিক কাউন্সিল সম্পন্ন হয়। এতে অনুসরণ করা হয়েছে ভোটের মাধ্যমে নেতা নির্বাচনে সব ধরনের গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া। এই নির্বাচন পর্যবেক্ষণের জন্য ঢাকা থেকে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায়ের নেতৃত্বে সাত সাংগঠনিক বিভাগের সাতজন সাংগঠনিক সম্পাদক ও সহ-সাংগঠনিক সম্পাদকরা বগুড়া যান।
গয়েশ্বর চন্দ্র রায় বলেন, বিএনপি একটি গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক দল। আমরা যেমন দেশে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য লড়াই করছি, একইভাবে দলেও গণতন্ত্রের ভিত আরও মজবুত করতে চাই। সেই চিন্তা থেকেই দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান দল পুনর্গঠনে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া অনুসরণ করছেন। তার চিন্তাকে বাস্তবে রূপ দিতে বগুড়া সদর উপজেলা ও পৌর ইউনিটে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া অনুসরণ করা হয়েছে। একইভাবে সারা দেশে এই প্রক্রিয়া অনুসরণ করে আগামী দিনে দলের তৃণমূলকে সাজানো হবে।

গত ১৪ সেপ্টেম্বর থেকে কেন্দ্রীয় নেতাদের সঙ্গে বড় পরিসরে ধারাবাহিক মতবিনিময় করেন তারেক রহমান। তখন দলের নেতাদের অধিকাংশ নেতাই তৃণমূলকে ঠেলে সাজানোর পক্ষে মত দেন।
তারা বলেন, তৃণমূল শক্তিশালী না হলে কোনো আন্দোলনই সফল হয় না। একাধিক সিনিয়র নেতা জানান, আগামী দিনে কঠোর আন্দোলনে যাওয়ার আগে পুনর্গঠনের মাধ্যেমে তৃণমূলকে প্রস্তুত করা হচ্ছে। যে প্রক্রিয়ায় তৃণমূলের কমিটি হচ্ছে, এতে দল অনেক শক্তিশালী হবে।

ঢাকা বিভাগীয় বিএনপির কেন্দ্রীয় সহ-সাংগঠনিক সম্পাদক অ্যাডভোকেট আব্দুস সালাম আজাদ বলেন, নির্ধারিত সময়ের মধ্যেই ঢাকা বিভাগের সব জেলায় কাউন্সিল করতে পারব বলে আশা করছি।
খবর: যুগান্তর