যশোরের মণিরামপুরে ভিজিডিতে নষ্ট, খাওয়ার অনুপযোগী চাল বিতরণের অভিযোগ

যশোরের মনিরামপুরে মাছনা গ্রামের বিধবা রোকেয়া বেগম। ফেয়ার প্রাইজে (১০ টাকার চালের) ৩০০ টাকা দিয়ে ৩০ কেজি চাল তুলেছেন। রোজায় কষ্ট কম হবে ভেবে চাল পেয়ে খুশি হয়েছিলেন। কিন্তু ভাত খেতে যেয়ে বিপত্তিতে পড়েছেন এ নারী। উপজেলা খাদ্যগুদাম থেকে সরবরাহ করা নষ্ট চাল পেয়েছেন তিনি।

রোকেয়া বেগম বলেন, ‘এবার খারাপ চাল দেছে। এ চালের ভাত খাতি পারিনে। রান্না করলি ভাত ভালো থাকে না। আমার যে কি কষ্ট তা বুঝাতি পারব না। গত বৃহস্পতিবার সেহেরীতে ভাত খাতি পারিনি। শুধু তরকারি খাইয়ে রোজা রইছি।’

উপজেলার দেবিদাসপুর গ্রামের রেনু বেগম পান সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনী কর্মসূচির (ভিজিডি) চাল। কদিন আগে তিনি চাল তুলেছেন। রেনু বেগম বলেন, ‘চালের রং সাদা ও লাল। পোকে ধরা। ভাত রানলি আলায় (নষ্ট হওয়া) যায়। ভাতে গন্ধ; খাওয়া যায় না। পরপর দুবার এ চাল দেছে।’

একই অভিযোগ ১০ টাকার কার্ডধারীদের। রঘুনাথপুর গ্রামের জীবন মল্লিক মার্চে উত্তোলন করা চাল খেতে না পেয়ে বাজারে কম দামে বেচে আটা কিনে খাচ্ছেন।

এদিকে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে উপজেলার ঝাঁপা, মনোহরপুর, রোহিতা ও খেদাপাড়া ইউনিয়নের বিভিন্ন এলাকার ভিজিডির কার্ডধারীরা মার্চের উত্তোলন করা চাল খেতে পারছেন না।

জানা গেছে, ২০২১-২২ চক্রে মনিরামপুরে ভিজিডির উপকারভোগী ২ হাজার ৭১৭ জন। ২ বছর মেয়াদি এ উপকারভোগীরা প্রতি মাসে বিনা মূল্যে ৩০ কেজি করে চাল পান। উপজেলা মহিলা বিষয়ক দপ্তরের তত্ত্বাবধানে খাদ্যগুদাম এ চাল সরবরাহ করে। সে হিসেবে গেল মার্চ মাসে উপজেলার ১৭টি ইউনিয়ন পরিষদে ৮১ দশমিক ৫১ মেট্রিক টন চাল সরবরাহ দিয়েছে গুদাম কর্তৃপক্ষ। যা বিতরণ করা হয়েছে কার্ডধারীদের মাঝে।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, মার্চে ভিজিডির উপকারভোগীদের বিতরণের জন্য ইউনিয়ন পরিষদে পাঠানো চাল খাওয়ার উপযোগী না। চালের রং সাদা ও লালচে। তার মধ্যে রয়েছে কালো চাল ও সাদাকালো পোকা। এ চালের ভাত থেকে গন্ধ বের হয়। ভাত বেশি সময় ভালো থাকে না। একবার রান্না করে দুবার খাওয়া যায় না। গেল ফেব্রুয়ারি মাসের চালও একই রকম ছিল, এমনটি অভিযোগ উপকারভোগীদের।

এদিকে উপজেলার ২৩ হাজার ৪১৯ জন উপকারভোগী মার্চে ১০ টাকা দরে ৩০ কেজি করে যে চাল পেয়েছেন তাও একই রকম বলে জানা গেছে। অধিকাংশ উপকারভোগীকে খাওয়ার অনুপযোগী চাল দেওয়া হয়েছে।

জানা গেছে, ইউনিয়ন পরিষদ থেকে ভিজিডির চাল বিতরণের সময় মহিলা বিষয়ক দপ্তরের প্রতিনিধিদের উপস্থিত থাকার নিয়ম রয়েছে। তবে এ দপ্তরের কেউ চাল বিতরণের কাজে অংশ নেননা। এমনকি ভিজিডিতে খাবার অনুপযোগী চাল বিতরণ হওয়ার বিষয়টি জানেন না উপজেলা মহিলা বিষয়ক কর্মকর্তা মৌসুমি আক্তার। যদিও গত বৃহস্পতিবারে অনুষ্ঠিত হওয়া এ সংক্রান্ত পর্যালোচনা সভায় খারাপ চালের বিষয়ে আলোচনা হয়েছে। সভায় উপস্থিত চেয়ারম্যান ও সচিবরা নষ্ট চালের বিষয়ে কথা বলেছেন। সেখানে ইউএনও এবং মহিলা বিষয়ক কর্মকর্তা উপস্থিত ছিলেন।

মনোহরপুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আক্তার ফারুক মিন্টু বলেন, ভিজিডির চাল খারাপ হওয়ার বিষয়টি উপজেলা সভায় ইউএনওকে জানাইছি। মহিলা বিষয়ক অধিদপ্তরের উপপরিচালক আনিচুর রহমান আমার পরিষদে এসেছিলেন। তিনি চালের নমুনা নিয়ে গেছেন।

মনিরামপুর খাদ্যগুদাম সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্র বলছে, খাদ্য গুদামের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা বরাবর একটি সিন্ডিকেট সঙ্গে নিয়ে ধান ও চাল ক্রয়ের অর্থ লোপাট করেন। গেল দুই বছর বাজারে ধানের দাম চড়া হওয়ায় এ ব্যবসা এখন আর চক্রটির হাতে নেই। তবে প্রতি বোরো ও আমন মৌসুমে সরকার ধানের পাশাপাশি চাল ক্রয় করে। এ চাল স্থানীয় ৪২-৪৪ জন চালকল মালিকের মাঝে বরাদ্দ দেওয়া হয়। কিন্তু খাদ্যগুদামের কর্মকর্তা সেলিম শিকদার কাগজে কলমে চাতাল মালিকদের কাজ থেকে চাল ক্রয় ঠিক রাখলেও অধিকাংশ মিলারের কাছ থেকে তিনি এ চাল নেননা। কৌশলে মিলারদের হাতে রেখে একটি চক্রের মাধ্যমে বাইরের এলাকা থেকে চাল সংগ্রহ করেন এ কর্মকর্তা।

সূত্রটি বলছে, সরকার ৪৪ টাকা করে চালের কেজি দিলেও তিনি উত্তরাঞ্চল থেকে পানিতে তলিয়ে যাওয়া নষ্ট ধান অর্ধেক দামে কিনে সেখানকার কোন অটো রাইচ মিল থেকে চাল বানান। সে চাল গুদামে ঢুকিয়ে বিতরণ করেন ফেয়ার প্রাইজ ও ভিজিডির কাজে। আর এ নষ্ট চাল নিয়ে বিপাকে পড়েন দুস্থ ও অসহায় হাজারো উপকারভোগীরা। যা ঘটেছে গত দুই মাসের ভিজিডিতে ও মার্চের ফেয়ার প্রাইজে।

তবে বিষয়টি অস্বীকার করেছেন মনিরামপুর উপজেলা খাদ্যগুদামের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা সেলিম শিকদার। তিনি বলেন, ‘গত মাসের বিতরণ করা চাল কুষ্টিয়া ও ঝিনাইদহ অঞ্চলের তিনটি গুদাম থেকে আনা হয়েছে। এ চাল গত বছরের বোরো মৌসুমের। এ কারণে চালের রং খারাপ।’ বিষয়টি নিয়ে লেখালিখি না করার জন্য তিনি অনুরোধ করেছেন।

মনিরামপুর উপজেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক ইন্দ্রজিৎ সাহা বলেন, ‘মার্চের ভিজিডির ও ফেয়ার প্রাইজের চাল খারাপ হওয়ার বিষয়টি শুনেছি। এক পরিবেশক আমাকে চাল দেখিয়েছেন। গুদামের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তাকে এ ব্যাপারে সতর্ক হতে বলেছি।’

এ বিষয়ে উপজেলা মহিলা বিষয়ক কর্মকর্তা মৌসুমি আক্তার বলেন, ‘ভিজিডিতে খারাপ চাল দেওয়ার বিষয়টি শুনিনি।’

ভিজিডির খারাপ চাল বিতরণের বিষয়ে কথা বলতে একাধিকবার ইউএনও সৈয়দ জাকির হাসানের মোবাইলে কল করা হয়েছে। তিনি ফোন ধরেননি। তবে তাঁর ফেসবুক মেসেঞ্জারে বস্তাসহ চালের কয়েকটি ছবি দেওয়া হয়েছে। যা তিনি দেখেছেন।