জোট ভেঙে ৩০০ আসনেই প্রার্থী দেবে জামায়াত

আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ৩শ আসনেই প্রার্থী দেওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে জামায়াত। নিবন্ধন বাতিল হওয়া দলটি এক্ষেত্রে কৌশল হিসেবে স্বতন্ত্র প্রার্থী দেবে। আর নির্বাচনের দিন-ক্ষণ ঘোষণার আগেই ২০ দলীয় জোট ত্যাগ করবে দলটি। এজন্য দলের পক্ষ থেকে নীতিগত সিদ্ধান্তও নেওয়া হয়েছে বলে জানা যায়।

জামায়াতের একাধিক নেতার সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, সামনের নির্বাচনে তাদের ২০ দলীয় জোটে না থাকার বিষয়টি মোটামুটি চূড়ান্ত। তবে কৌশলগত কারণে এখনই জোট ভাঙার ঘোষণা দিচ্ছে না। জামায়াত নেতারা মনে করেন, বিএনপির পক্ষ থেকে যে অবমূল্যায়ন হচ্ছে, তা আরও গাঢ় হলে বিভাজনটা স্পষ্ট করা সহজ হবে।

স্বৈরাচার এরশাদ বিরোধী আন্দোলনে গাঁটছড়া বেঁধেছিল জামায়াত-বিএনপি জোট। আলাদা হলেও আওয়ামী লীগ আর বিএনপি-জামায়াত নেতৃত্বাধীন দুই জোটের যুগপৎ আন্দোলনেই পতন ঘটে এরশাদের। সংখ্যায় কম, অথচ জামায়াতের ভোটে ভর করেই ১৯৯১ সালে সরকার গঠন করে বিএনপি। ফিরে আসে সংসদীয় গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থা। ২০০১ সালে আনুষ্ঠানিকভাবে চারদলীয় জোট করে ফের ক্ষমতায় আসে বিএনপি-জামায়াত।

রাজনীতির এই মেরুকরণের তিন দশক পার হয়েছে। রাজনীতির পালাও বদলেছে অনেক। এই পালাবদলে সবচেয়ে বেকায়দায় আছে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে সরাসরি বিরোধিতাকারী সংগঠন বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী। প্রতিষ্ঠার পর এমন কোণঠাসায় আর পড়তে দেখা যায়নি দলটিকে। বিএনপির ঘাড়ে ভর করে মন্ত্রী বনে গেলেও জামায়াতের যুদ্ধাপরাধী শীর্ষ নেতাদের শেষ রক্ষা হয়নি। দল হিসেবেও এখন অপরাধী জামায়াত। ভেঙে দেওয়া হয়েছে জামায়াতের সাংগঠনিক কাঠামো। নিবন্ধন বাতিল হয়েছে বেশ ক’বছর হলো। দলটির ছাত্র সংগঠন ইসলামী ছাত্র শিবিরও সবচেয়ে বিপর্যস্ত সময় পারে করছে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে বিতাড়িত শিবির এখন রাজনীতি করছে গোপনে।
এমন বিপর্যস্ত সময়ে জোট ছেড়ে একলা চলা নীতির সিদ্ধান্ত কেন গুরুত্ব পাচ্ছে- এ বিষয়ে আলোচনা হয় জামায়াতের ঢাকা মহানগরীর একাধিক নেতার সঙ্গে।

ঢাকা মহানগর দক্ষিণের দায়িত্বশীল এক নেতা বলেন, ‘রাজনৈতিক কৌশল হিসেবে জোট করা। আবার রাজনৈতিক কৌশল হিসেবেই জোট ভাঙতে পারে। জামায়াত যে উদ্দেশ্যে জোট করেছিল, তা থেকে জোটের অন্য শরিক দলগেুলো বহু দূরে সরে গেছে। আর একক সংগঠন হিসেবে জামায়াত এখন ব্যাপক জনপ্রিয় দল। আমরা এই সুযোগ হাতছাড়া করতে চাই না। ৩শ আসনে এককভাবে নির্বাচনের প্রস্তুতি নিচ্ছি।

শিবিরের কেন্দ্রীয় সাবেক এই সভাপতি বলেন, তরুণরা পরিবর্তন চাইছে। আমরা ক্ষমতার জন্য ত্যাগ স্বীকার করছি না। আল্লাহর সন্তুষ্টি আর মানুষের কল্যাণের জন্য আন্দোলন করছি। মানুষ জুলুমবাজদের থেকে পরিত্রাণ চাইছে। তরুণদের সাড়া পাচ্ছি। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তার প্রতিফলন দেখছি। স্থানীয় সরকার নির্বাচনগুলোয় ভোটের ফলাফলও আমাদের আত্মবিশ্বাস বাড়িয়েছে।

ঢাকা মহানগরের শীর্ষ আরেক নেতা বলেন, জামায়াত ৩শ আসনে নির্বাচন করার প্রস্তুতি নিচ্ছে। প্রতিষ্ঠার পর থেকে আমরা এককভাবেই বেশি নির্বাচন করে আসছি। তাছাড়া জোট তো আসলে চিরস্থায়ী কোনো ব্যবস্থা নয়।’

সরকারের এজেন্ডা বাস্তায়নের জন্য ২০ দলীয় জোট ছাড়ছেন এমন অভিযোগও উঠছে রাজনীতির মাঠে’ জবাবে এই নেতা বলেন, আমাদের কাছে আপসের জন্য বহু প্রস্তাব এসেছে। জামায়াত কোনো বাতিল শক্তির সঙ্গে আপস করে না। আর আমাদের এখন হারানোর কিছু নেই। বহু রক্ত ঝরিয়ে টিকে আছি। আপস করার জন্য নয়।

‘২০ দলীয় জোটে গুরুত্ব বাড়াতে বা দরকষাকষির জন্য এমন ঘোষণা হতে পারে কি না- উত্তরে তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশের রাজনীতিতে আমাদের গুরুত্ব কী, তা সবাই জানেন। জোটের কাছে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠা বিষয় না। জামায়াত দেশের মানুষের কাছে গুরুত্বপূর্ণ কি না সেটিই মুখ্য বিষয়।

নির্বাচন প্রসঙ্গে কথা হয় জামায়াত ইসলামি নীলফামারী জেলার সাবেক সেক্রেটারি খায়রুল আনামের সঙ্গে। তিনি বলেন, কেন্দ্র থেকে নির্বাচনের জন্য সংগঠনকে তাগিদ দেওয়া হয়েছে। জামায়াত নির্বাচনমুখী রাজনীতি করে আসছে। তৃণমূলের মতামত নিয়ে প্রার্থী ঘোষণা করা হয়। আমরা সেভাবেই এগিয়ে যাচ্ছি। আর নীলফামারীর মাটি জামায়াতের জন্য উর্বর। জামায়াত এখানে বরাবরই ভালো করছে। আমরা সামনে আরও ভালো করবো ইনশাল্লাহ। আর নির্বাচন, জোটের সিদ্ধান্ত কেন্দ্রের ব্যাপার। এ নিয়ে আমরা মন্তব্য করতে পারি না।

জামায়াত প্রসঙ্গে কথা হয় বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য খন্দকার মোশারফ হোসেনের সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘জামায়াতের সিদ্ধান্তের ব্যাপারে আমরা মতামত দিতে পারি না। তবে এ নিয়ে জোটের মধ্যে কোনো আলোচনা হয়নি এখনো।

এর আগে জামায়াতের আমির ডা. শফিকুর রহমানের বক্তব্যের একটি ভিডিও ছড়িয়ে পড়লে জোট ভাঙার আলোচনা চাঙা হয়। ওই ভিডিওতে তাকে বলতে শোনা যায়, আমরা এতদিন একটা জোটে ছিলাম। ছিলাম বলে আপনারা হয়তো ভাবছেন, কিছু হয়ে গেছে নাকি? আমি বলি হয়ে গেছে। ২০০৬ সাল পর্যন্ত এটি একটি জোট ছিল। ২০০৬ সালের ২৮ অক্টোবর জোট তার দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হয়েছে। সেদিন বাংলাদেশ পথ হারিয়েছিল। সেটা আর ফিরে আসেনি।

তিনি বলেন, বছরের পর বছর এ ধরনের অকার্যকর জোট চলতে পারে না। এই জোটের সঙ্গে বিভিন্ন দল যারা আছে, বিশেষ করে প্রধান দলের (বিএনপি) এই জোটকে কার্যকর করার কোনো চিন্তা নেই। বিষয়টা আমাদের কাছে স্পষ্ট দিবালোকের মতো এবং তারা আমাদের সঙ্গে বসে সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এখন বাস্তবতা হচ্ছে নিজস্ব অবস্থান থেকে আল্লাহর ওপর ভর করে পথচলা। তবে হ্যাঁ, জাতীয় স্বার্থে একই দাবিতে যুগপৎ কর্মসূচি বাস্তবায়ন করবো ইনশাআল্লাহ।

বিএনপির সঙ্গে জোট নিয়ে আলোচনা হয়েছে উল্লেখ করে জামায়াতের আমির ওই বক্তব্যে বলেন, আমরা তাদের সঙ্গে খোলামেলা আলোচনা করেছি। তারা ঐকমত্য পোষণ করেছে। তারা আর কোনো জোট করবে না। এখন যার যার অবস্থান থেকে সর্বোচ্চটা দিয়ে চেষ্টা করবো। যদি আল্লাহ আমাদের তৌফিক দান করেন তাহলে আমাদের আগামী দিনগুলোতে কঠিন প্রস্তুতি নিতে হবে। অনেক বেশি ত্যাগ স্বীকার করতে হবে। দোয়া করেন, এসব ত্যাগ যেন আল্লাহর দরবারে মঙ্গলজনক হয়। এ ত্যাগের বিনিময়ে আল্লাহ পাক যেন আমাদের পবিত্র একটি দেশ দান করেন। যে দেশটা কোরআনের আইনে পরিচালিত হবে।

জামাতের আমিরের এই বক্তব্যের বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে জোটের সমন্বয়কারী ও বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য নজরুল ইসলাম খান বলেন, আমি ভিডিওটি দেখিনি। তাই এ বিষয়ে কোনো বক্তব্য দেবো না।