শেখ রাসেল! অসমাপ্ত গল্পের চিরন্তন রাজকুমার
শতাব্দীর শেকল ভেঙ্গে মুক্তির বার্তা নিয়ে যিনি স্বাধীনতা শব্দটি আমাদের করে দিয়েছেন, অবিভক্ত ভারত থেকে পাকিস্তান, পাকিস্তান থেকে বাংলাদেশ পর্যন্ত যিনি শোষণ,বৈষম্য ও অন্যায়ের বিরুদ্ধে, নীতি ও আদর্শের প্রশ্নে ছিলেন আপোষহীণ। যিনি বাংলার আপামর জনগণের মনন-অভিধানে গেঁথে আছেন শ্রদ্ধাভরে, তিনি সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।
শেখ রাসেল জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও বঙ্গমাতা ফজিলাতুন নেছা মুজিবের কনিষ্ঠ পুত্র এবং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আদরের ছোট ভাই। রাজনীতির তীর্থস্থান ধানমন্ডির ৩২ নম্বর বাড়িতে ১৯৬৪ সালের ১৮ সেপ্টেম্বর তিনি জন্মগ্রহণ করেন। দীর্ঘ সাত বছর পর বঙ্গবন্ধু পরিবারে নতুন অতিথি আসার কারণে সবার মধ্যেই ছিল অন্যরকম আনন্দ উচ্ছ্বাস।রাসেলের জন্মের সময়ের স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা “আমাদের ছোট রাসেল সোনা” গ্রন্থে লিখেছেন,“রাসেলের জন্মের আগের মুহূর্তগুলো ছিল ভীষণ উৎকণ্ঠার। অমি, কামাল, জামাল, রেহানা ও খোকা চাচা বাসায়। বড় ফুফু ও মেঝ ফুফু মার সাথে। একজন ডাক্তার ও নার্সও এসেছেন। সময় যেন আর কাটে না। জামাল আর রেহানা কিছুক্ষণ ঘুমায় আবার জেগে ওঠে। আমরা ঘুমে ঢুলুঢুলু চোখে জেগে আছি নতুন অতিথির আগমন বার্তা শোনার অপেক্ষায়। মেঝ ফুফু ঘর থেকে বের হয়ে এসে খবর দিল আমাদের ভাই হয়েছে। খুশিতে আমরা আত্মহারা। কতক্ষণে দেখব। ফুফু বললেন, তিনি ডাকবেন। কিছুক্ষণ পর ডাক এলো। বড় ফুফু আমার কোলে তুলে দিলেন রাসেলকে। মাথাভরা ঘন কালোচুল। তুলতুলে নরম গাল। বেশ বড়সড় হয়েছিল রাসেল।
রাসেল নামকরণেরও আছে সুন্দর একটি ইতিহাস। বঙ্গবন্ধু ও বঙ্গমাতা দুজনই সময় পেলে বই পড়তেন, ছিলেন নোবেল বিজয়ী বিজ্ঞানী, দার্শনিক বার্ট্রান্ড রাসেলের ভক্ত।
বঙ্গবন্ধু ও বঙ্গমাতা আগেই সিদ্ধান্ত নিয়ে রেখেছিলেন যে তাদের যদি পুত্র সন্তান হয় তাহলে শান্তির দূত বার্ট্রান্ড রাসেলের নামের সঙ্গে মিল রেখে নাম রাখবেন রাসেল। আর বার্ট্রান্ড রাসেল শুধু একজন দার্শনিকই ছিলেন না, বিজ্ঞানীও ছিলেন। পারমাণবিক যুদ্ধবিরোধী আন্দোলনের একজন বড় মাপের বিশ্বনেতাও। আর বিশ্ব শান্তি রক্ষার জন্যে বার্ট্রান্ড রাসেল গঠন করেছিলেন ‘কমিটি অব হানড্রেড’। মানুষের বসবাস যাতে সুন্দর ও শান্তিময় হয়, সেই লক্ষ্যে কাজ করেছেন বার্ট্রান্ড।শেখ রাসেলের জন্মের দু’বছর আগে ১৯৬২ সালে কিউবাকে কেন্দ্র করে আমেরিকার প্রেসিডেন্ট কেনেডি এবং সোভিয়েত প্রধানমন্ত্রী ক্রুশ্চেফ-এর মধ্যে স্নায়ু ও কূটনৈতিক যুদ্ধ চলছিল।
এক পর্যায়ে সেই স্নায়ু ও কূটনৈতিক যুদ্ধটি সত্যিকারের ভয়ংকর তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের দিকে এগিয়ে যাচ্ছিল। তখন, বিশ্বমানবতার প্রতীক হয়ে আবির্ভূত হয়েছিলেন বিখ্যাত দার্শনিক বার্ট্রান্ড রাসেল। মানবসভ্যতা-বিধ্বংসী সম্ভাব্য তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধটি থামাতে তিনি সোচ্চার হয়ে উঠেছিলেন। প্রতিবাদমুখর হয়ে উঠেছিলেন। বিশ্ব জনমত গড়ে উঠেছিল রাসেলের যুক্তির পক্ষে। কেনেডি-ক্রুশ্চেফ এক পর্যায়ে যুদ্ধেংদেহী মনোভাব থেকে সরে আসতে বাধ্য হয়েছিলেন। তাই মহান বার্ট্রান্ড রাসেলের নামানুসারে নাম রাখা হয় রাসেল। এই নামটিকে ঘিরে নিশ্চয়ই পিতা মুজিবের মহৎ কোনো স্বপ্ন বা আকাঙক্ষা ছিল।পিতা মুজিব হয়তো স্বপ্ন দেখেছিলেন তাঁর ছোট ছেলে আপন প্রতিভায় একদিন দীপ্ত হয়ে উঠবে। হবেন লেখক, দার্শনিক কিংবা বিশ্বশান্তির নতুন কোন কান্ডারী।ছোট্ট শহীদ রাসেলের স্বল্প সময়ের জীবন বিশ্লেষন করলে আমরা সেটাই দেখতে পাই। তিনি ছিলেন প্রচণ্ড সাহসী,মানবিক ও রাজনৈতিক বোধ সম্পন্ন একজন ব্যক্তি।
শিশু রাসেলের জীবনের বেশিরভাগ সময় কেটেছে বাবাকে ছাড়াই। কারণ তার বাবা রাজনৈতিক বন্দী হয়ে কারাগারে ছিলেন দীর্ঘদিন। বাবাকে দেখতে না পেয়ে মা ফজিলাতুন্নেছা মুজিবকে আব্বা বলে সম্বোধন করতেন রাসেল। এই চাপা কষ্ট যেমন অনুভব করতেন ছোট্ট শিশু রাসেল ঠিক তেমনি তার বাবা বঙ্গবন্ধুও।এ প্রসঙ্গে বঙ্গবন্ধু কারাগারের রোজনামচায় বলেছেন
“৮ ফেব্রুয়ারি ২ বছরের ছেলেটা এসে বলে, আব্বা বাড়ি চলো। কী উত্তর ওকে আমি দিব। ওকে ভোলাতে চেষ্টা করলাম ও তো বোঝে না আমি কারাবন্দী। ওকে বললাম, ‘তোমার মার বাড়ি তুমি যাও। আমি আমার বাড়ি থাকি। আবার আমাকে দেখতে এসো।’ ও কি বুঝতে চায়! কী করে নিয়ে যাবে এই ছোট্ট ছেলেটা, ওর দুর্বল হাত দিয়ে মুক্ত করে এই পাষাণ প্রাচীর থেকে! দুঃখ আমার লেগেছে। শত হলেও আমি তো মানুষ আর ওর জন্মদাতা। অন্য ছেলেমেয়েরা বুঝতে শিখেছে। কিন্তু রাসেল এখনো বুঝতে শিখেনি। তাই মাঝে মাঝে আমাকে নিয়ে যেতে চায় বাড়িতে।
বঙ্গবন্ধুর আত্মজীবনীতে ছেলের জন্য তাঁর ভেতরের কষ্টের ছাপ স্পষ্ট হয়ে ওঠে। ১৯৬৬ সালের ৬ দফা আন্দোলনের পর থেকেই রাজবন্দী হিসেবে জেলে ছিলেন বঙ্গবন্ধু। কারাগারে দেখা করার সময় রাসেল কিছুতেই তার বাবাকে রেখে আসবে না। এ কারণেই তার মন খারাপ থাকত। কারাগারের রোজনামচায় ১৯৬৬ সালের ১৫ জুনের দিনলিপিতে রাসেলকে নিয়ে বঙ্গবন্ধু লিখেছেন, “১৮ মাসের রাসেল জেল অফিসে এসে একটুও হাসে না- যে পর্যন্ত আমাকে না দেখে। দেখলাম দূর থেকে পূর্বের মতোই ‘আব্বা আব্বা’ বলে চিৎকার করছে। জেল গেট দিয়ে একটা মাল বোঝাই ট্রাক ঢুকেছিল। আমি তাই জানালায় দাঁড়াইয়া ওকে আদর করলাম। একটু পরেই ভিতরে যেতেই রাসেল আমার গলা ধরে হেসে দিল। ওরা বলল আমি না আসা পর্যন্ত শুধু জানালার দিকে চেয়ে থাকে, বলে ‘আব্বার বাড়ি’। এখন ধারণা হয়েছে এটা ওর আব্বার বাড়ি। যাবার সময় হলে ওকে ফাঁকি দিতে হয়।
মাননীয় প্রধানমন্ত্রী দেশরত্ন শেখ হাসিনা তাঁর আদরের ছোট ভাই রাসেলকে নিয়ে লেখা ‘আমাদের ছোট রাসেল সোনা’ বই থেকে আমরা অনেক কিছুই জানতে পারি। তিনি বইয়ের ২১ পৃষ্ঠায় বঙ্গবন্ধু কে কারাগারে দেখতে যাওয়ার বিষয়ে স্মৃতিচারন করে লিখেছেন, আব্বার সাথে প্রতি পনের দিন পর পর আমরা দেখা করতে যেতাম।রাসেলকে নিয়ে গেলে ও আর আসতে চাইত না। খুব কান্না কাটি করতো। ওকে বোঝানো হয়েছিল আব্বার বাসা জেলখানায় আমরা আব্বার বাসায় বেড়াতে এসেছি। আমরা আমাদের বাসায় চলে যাব। বেশ কষ্ট করে ওকে নিয়ে আসতে হত। তখন আব্বার মনের অবস্থা যে কি হত তা আমরা বুঝতে পারতাম। বাসায়ও আব্বার জন্য
এই রকম সংবাদ আরো পেতে হলে এই লেখার উপরে ক্লিক করে আমাদের ফেসবুক ফ্যান পেইজে লাইক দিয়ে সংযুক্ত থাকুন। সংবাদটি সম্পর্কে মন্তব্য করতে হলে এই পেইজের নীচে মন্তব্য করার জন্য ঘর পাবেন