সাব-রেজিস্ট্রার অফিসে দুর্নীতি প্রতিরোধে দুদকের ১০ সুপারিশ

সাব-রেজিস্ট্রার অফিসে দুর্নীতির উৎস চিহ্নিত করে তা প্রতিরোধে ১০টি সুপারিশ করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন-দুদক। দুর্নীতির উৎস ও সুপারিশমালার বিষয়ে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য মন্ত্রিপরিষদ সচিব, মন্ত্রিপরিষদ বিভাগসহ সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ে প্রেরণ করেছে দুদক। দুদক সূত্র এ তথ্য নিশ্চিত করেছে।

মন্ত্রিপরিষদ বিভাগে পাঠানো চিঠিতে দুদক সচিব মাহবুব হোসেন বলেন, রেজিস্ট্রেশন আইন, বিধি, পরিচালন পদ্ধতি, সরকারি অর্থ অপচয়ের দিকসমূহ পর্যবেক্ষণ ও বিশ্লেষণ করে উক্ত প্রতিষ্ঠানের সীমাবদ্ধতা, প্রতিবন্ধকতা ও দুর্নীতি প্রতিরোধের নিমিত্ত সুপারিশমালা প্রণয়নের লক্ষ্যে কমিশনের একজন পরিচালকের নেতৃত্বে একজন উপপরিচালক এবং একজন সহকারী পরিচালকের সমন্বয়ে ‘সাব-রেজিস্ট্রার অফিস ও রেজিস্ট্রেশন কমপ্লেক্স, ঢাকা’ এর দুর্নীতি সংক্রান্ত সুপারিশ প্রদানের জন্য একটি প্রাতিষ্ঠানিক টিম গঠন করা হয়। এই প্রাতিষ্ঠানিক টিম তাদের অনুসন্ধানকালে সাব রেজিস্ট্রার অফিসসমূহের অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তা, বর্তমানে কর্মরত কর্মকর্তা এবং এতদবিষয়ে যারা সম্যক ধারণা রাখেন তাদের সাথে আলোচনার মাধ্যমে তথ্য সংগ্রহপূর্বক তা পর্যালোচনা করে।

এছাড়া প্রাতিষ্ঠানিক টিম সাব রেজিস্ট্রার অফিসসমূহের বিভিন্ন অনিয়ম ও দুর্নীতি সম্পর্কিত বিভিন্ন দৈনিক পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত তথ্যসহ ভুক্তভোগী সেবা গ্রহীতাদের বক্তব্য পর্যালোচনা করে। সার্বিক পর্যালোচনার ভিত্তিতে প্রাতিষ্ঠানিক টিম ‘সাবরেজিস্ট্রার অফিস ও রেজিস্ট্রেশন বমপ্লেক্স, ঢাকা’ এর দুর্নীতির উৎস ও ক্ষেত্রসমূহ চিহ্নিত করে তা প্রতিরোধে সুপারিশমালা প্রতিবেদন আকারে কমিশনে দাখিল করে।

প্রতিবেদনের দুর্নীতির ১০টি উৎসের বর্ণনা দিয়ে বলা হয়, সময়মত ভলিউমে কপি না হওয়ার কারণে মূল দলিল সরবরাহ করতে বিলম্ব হয় ও সার্টিফাইড কপি সরবরাহেও জটিলতার সৃষ্টি হয়। তাতে সেবা গ্রহীতা দালালের খপ্পরে পড়ছে এবং দ্রুত সেবা পাওয়ার জন্য উৎকোচ দিতে বাধ্য হচ্ছেন।

দলিল রেজিস্ট্রেশনের সময় সরকারি রাজস্ব হিসাবে জমাকৃত পে-অর্ডার, ব্যাংক ড্রাফ্ট, চেক ইত্যাদি সংশ্লিষ্ট ব্যাংকের হিসাবে নির্ধারিত সময়ের মধ্যে জমা হয় না। এতে এসব ব্যাংক ড্রাফ্ট, পে-অর্ডার, চেকসমূহ সংশ্লিষ্ট দপ্তর হতে খোয়া যাচ্ছে এবং জালিয়াতির মাধ্যমে এই অর্থ আত্মসাতের সুযোগ সৃষ্টি হচ্ছে।

জমি রেজিস্ট্রেশন হওয়ার সময় জমাকৃত জাল পে-অর্ডার, ব্যাংক ড্রাফ্ট, চেক ইত্যাদি নির্ধারিত সময় ব্যাংকে জমা না দেওয়ার কারণে ধরা পড়ছে না। পে-অর্ডার, ব্যাংক ড্রাফ্ট, চেক ইত্যাদি এন্ট্রি দেয়ার জন্য রক্ষিত রেজিস্টারের সকল কলঅমগুলো পূরণ করা হয় না। দলিল রেজিস্ট্রেশন হওয়ার পর নোটিশ সংশ্লিষ্ট এসি ল্যান্ড অফিসে প্রেরণ করার কথা থাকলে তা করা হচ্ছেনা। দাতা গ্রহীতার মধ্যে জমির প্রকৃত বিনিময় মূল্য বেশী হলেও তা দলিল লেখক ও সাব-রেজিস্ট্রারের সহায়তায় কম দেখিয়ে রেজিস্ট্রেশন করার কারণে প্রকৃত রেজিস্ট্রেশন ফি হতে সরকার বঞ্চিত হচ্ছে।

নিয়োগ বদলির ক্ষেত্রে ব্যাপক বাণিজ্যের জনশ্রুতি রয়েছে, আইন ও ম্যানুয়েল অনুযায়ী তৃতীয় চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারী বদলি, দলিল লেখক, নকলনবিস (এক্সট্রা মোহরার) নিয়োগের ক্ষমতা সংশ্লিষ্ট জেলা রেজিস্ট্রারের কিন্তু বাস্তবে এ নিয়োগ ও বদলি আই.জি.আর এর দপ্তর হতে করা হয়। অনুসন্ধানকালে দেখা যায় যে, নিয়োগ বহির্ভূত অনেক লোক রেজিস্ট্রেশন কমপ্লেক্সে কাজ করেন যাদেরকে উমেদার (পিয়ন) বলে। অধিকাংশ অবৈধ লেনদেন তাদের মাধ্যমে হয়ে থাকে।

এসকল দুর্নীতি প্রতিরোধে ১০ দফা সুপারিশ করে দুদক। এসকল সুপারিশের মধ্যে রয়েছে, মূল দলিল গ্রহীতাকে তাৎক্ষণিক ডেলিভারী প্রদানের লক্ষ্যে ০৩ কপি দলিল সম্পাদন করে রেজিস্ট্রেশন করা যেতে পারে, যাতে রেজিস্ট্রেশন সম্পন্ন হওয়ার সাথে সাথে দাতা ও গ্রহীতাকে ০১ কপি প্রদান করে ০১ কপি ভলিউমে উত্তোলনের জন্য সংরক্ষণ করা যায়। প্রতিটি দলিল ডাটাবেজে সংরক্ষণ করা যেতে পারে। রেজিস্ট্রেশন ‘ফি’ হিসেবে প্রাপ্ত পে-অর্ডার, ব্যাংক ড্রাফ্ট, রেজিস্টারে এন্ট্রিসহ সময়মত সংশ্লিষ্ট ব্যাংকে জমা প্রদান এবং সিটিআর রিপোর্ট সংগ্রহ করা নিশ্চিত করা প্রয়োজন।

জমির হাল নাগাদ খতিয়ানের কপি সংশ্লিষ্ট সাব-রেজিস্ট্রার অফিসে সংরক্ষণ নিশ্চিত করা প্রয়োজন এবং সে অনুযায়ী দলিল রেজিস্ট্রি করার পূর্বে জমির মালিকানা সংক্রান্ত বিষয় নিশ্চিত হওয়া প্রয়োজন। আইন সংশোধনের মাধ্যমে জাল দলিল বাতিল ও সংশোধনের আপিল ও রিভিউ ক্ষমতা জেলা রেজিস্ট্রার ও তার উর্ধ্বতন কর্মকর্তা (আই.জি.আর) আইনের দ্বারা কোন অথরিটিকে দেয়া যেতে পারে।

কোন দলিল রেজিস্ট্রেশন কার্য শেষ হয়ে গেলে যদি সেটি জাল দলিল হিসেবে রেজিস্ট্রি হয় তবে দেওয়ানি আদালত ছাড়া উক্ত দলিল বাতিল করা জমির প্রকৃত মালিকের পক্ষে সম্ভব হয় না, যা একটি দীর্ঘমেয়াদী প্রক্রিয়া। যদি এক্ষেত্রে আইন সংশোধনের মাধ্যমে আপিল ও রিভিউ ক্ষমতা জেলা রেজিস্ট্রার ও তার ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা (এআইজিআর) আইনের দ্বারা কোন অথরিটিকে দেওয়া যায়, তাহলে দেওয়ানি আদালতে মামলা জট হ্রাস পাবে এবং জমির প্রকৃত মালিক দীর্ঘমেয়াদী বিড়ম্বনা থেকে রেহাই পাবে।

সম্পাদিত দলিলের দাতা/গ্রহীতা, দলিল মূল্য, জমির বিবরণের ডাটাবেইজ তৈরি করা যেতে পারে। এর ফলে স্বয়ংক্রিয়ভাবে মৌজার গড় মূল্য সহজে পাওয়া যাবে এবং ক্রয়-বিক্রয় করা জমি সহজে চিহ্নিত করা যাবে।

সহকারী কমিশনার (ভূমি) ও সাব রেজিস্ট্রার অফিস একই কর্তৃপক্ষের অধীনে এনে একই কমপ্লেক্সে স্থাপন করা যেতে পারে, যাতে করে জমি রেজিস্ট্রেশন হওয়ার সাথে সাথেই নামজারী/জমাভাগের কাজ স্বয়ংক্রিয়ভাবে সম্পন্ন করা যায়।

দুর্নীতিমুক্ত জনসেবা নিশ্চিতকরণ ও সরকারি রাজস্ব আদায়ের স্বার্থে রেজিস্ট্রিকার্য সম্পাদনের সময় বিক্রিত জমির প্রকৃতি শেষে এর এর কপি সংশ্লিষ্ট সাব-রেজিস্ট্রি অফিসে প্রদান করার ব্যবস্থা করা যেতে পারে। (যেমন-নালা, চালা, ডোবা, নাল, ভিটি ইত্যাদি) নিশ্চিত হওয়ার জন্য ভূমি জরিপ অধিদপ্তর কর্তৃক জরিপ কার্য সম্পাদন রেজিস্ট্রেশন কমপ্লেক্স, ঢাকা এর সকল পর্যায়ে ডিজিটালাইজেশন/অটোমেশন পদ্ধতি চালু করার প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করার লক্ষ্যে সংশ্লিষ্ট দপ্তরকে পরামর্শ প্রদান করা যেতে পারে।

সাব-রেজিস্ট্রার ও স্টাফ বদলির ক্ষেত্রে সুনির্দিষ্ট বদলির নীতিমালা থাকা প্রয়োজন। বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্র ছাড়া লটারীর মাধ্যমে বদলির ব্যবস্থা গ্রহণ করার জন্য মহাপরিদর্শক, নিবন্ধন পরিদপ্তরকে পরামর্শ প্রদান করা যেতে পারে।