লালমনিরহাটের হাতীবান্ধায় যৌতুকের টাকার জন্য গৃহবধূ নির্যাতন..হাসপাতালে ভর্তি হলেও থামেনি নির্যাতন

লালমনিরহাটের হাতীবান্ধায় যৌতুকের টাকা দিতে না পারায় রাশেদা বেগম নামে এক গৃহবধূকে আটকে রেখে মারধর ও নির্যাতন করেন পাষন্ড স্বামী মকছেদ আলী ও তার মা-বাবা, ভাই। নির্যাতনের শিকার ওই গৃহবধূ স্থানীয় থানায় লিখিত অভিযোগ করায়, উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে প্রবেশ করে চিকিৎসাধীন রাশেদা বেগম ও তার মা, ভাই ভাবির উপর অতর্কিত ভাবে হামলা করেছেন স্বামীর চাচাতো ভাই মোতাহার ও তার লোকজন। খবর পেয়ে পুলিশ গিয়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করেন। অতর্কিত হামলায় ৭জন আহত হয়েছে। তাদের মধ্যে রাশেদার ভাই ব্যাংক কর্মকর্তা আব্দুল হালিমের মাথায় মারাত্মক যখম হয়েছে।

এ দিকে স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের রোগীর ওয়ার্ডে প্রবেশ করে চিকিৎসাধীন রোগী ও তার পরিবারের উপর অতর্কিত ভাবে হামলার ঘটনা ন্যাক্কারজনক বলে আলোচনা সমালোচনার ঝড় উঠেছে পুরো উপজেলা শহর জুড়ে। তবে এই ন্যাক্কারজনক ঘটনায় এ রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত পুলিশ কাউকে আটক করতে পারেনি।

বৃহস্পতিবার (৬ এপ্রিল) সকালে ১২জনের নাম উল্লেখ করে হাতীবান্ধা থানায় একটি লিখিত অভিযোগ করেন নির্যাতনের শিকার গৃহবধূ রাশেদা বেগম। এর আগে বুধবার রাতে হাতীবান্ধা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের অসুস্থ রোগী থাকা নারী ওয়ার্ডে এই মারধরের ঘটনাটি ঘটেছে।

আহতরা হলেন, উপজেলার সিংগীমারী ইউনিয়নের ৪নং ওয়ার্ডের দক্ষিণ গড্ডিমারী গ্রামের মৃত আজিজার রহমানের মেয়ে রাশেদা বেগম( ৪০), রাশেদার মা হালিমা বেগম( ৬০), বোন আলোয়া বেগম (৩৫), ভাই আনোয়ার হোসেন (৪৭),হাবিবুর রহমান(৪০), আব্দুল হালিম (৩৮) ও ভাবি রুমি খানম (৩৫)গুরতর আহত আব্দুল হালিম হাতীবান্ধা পল্লী সঞ্চায় ব্যাংকের মাঠ সহকারী।

আর অভিযুক্তরা হলেন, রাশেদার স্বামী মকছেদ আলী(৪০), দেবর মমিনুর রহমান(৩৫), শ্বশুর লুৎফর রহমান(৬০), শ্বাশুড়ী জোহরা বেগম(৫০), চাচা শ্বশুড়ের ছেলে মোতাহার হোসেন(৪০) ও মোতাহারের লোক ফরিদুল ইসলাম(৩৫), মামুদ(৩০), মুন্না(৩২), আসাদুজ্জামান(৩৪), মুন্না(২৬), সালাম(৪৫) এবং আইদুল(২৫)।

জানাগেছে, ২০ বছর আগে উপজেলার সিংগীমারী ইউনিয়নের ৪নং ওয়ার্ডের দক্ষিণ গড্ডিমারী গ্রামের মৃত আজিজার রহমানের মেয়ে রাশেদা বেগমের সাথে বিয়ে হয় একই ইউনিয়নের ৮নং ওয়ার্ডের মধ্যে সিংগীমারী গ্রামের লুৎফর রহমানের ছেলে মকছেদ আলীর সাথে। বর্তমান তাদের এক ছেলে এক মেয়ে রয়েছে। বিয়ে পর থেকে ২লক্ষ টাকা যৌতুকের জন্য মমিনুর ও তার পরিবারের লোকজন রাশেদাকে চাপ দেয়। রাশেদার বাবার বাড়ির লোকজন টাকা দিতে না পারায় তারা প্রায় সময় রাশেদাকে নির্যাতন করেন।

এমতাবস্থায় গত ৪মার্চ মঙ্গলবার সন্ধ্যায় মকছেদ আলী তার স্ত্রী রাশেদাকে তার বাবার রেখে যওয়া জমির ভাগ বিক্রয় করে টাকা আনতে বলেন। এতে রাজি না হওয়ায় স্বামী মকছেদ, দেবর মমিনুর, শ্বশুর লুৎফর ও শ্বাশুড়ি জোহরা বেগম রাশেদাকে মারধর ও নির্যাতন করে ঘরে আটকে রাখে। পরের দিন, ৫মার্চ বুধবার সকালে স্থানীয়দের সহযোগিতা নিয়ে রাশেদা হাতীবান্ধা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ভর্তি হয়।

এ ঘটনায় বুধবার বিকেলে রাশেদা বেগম বাদি হয়ে স্বামী, স্বামীর ভাই, শ্বশুর ও শ্বাশুড়ির নাম উল্লেখ করে হাতীবান্ধা থানায় একটি লিখিত অভিযোগ করেন। এতে করে অভিযুক্তরা আরও বেশি ক্ষিপ্ত হয়।

এদিকে বুধবার রাতে হাসপাতালে গিয়ে বিষয়টি আপোষ মিমাংসা করার জন্য চাপ সৃষ্টি করেন রাশেদার স্বামী ছাদেকুল আলমের চাচা আবুল হোসেন। এতে তারা রাজি না হলে আবুল হোসেন ফোন করেন তার ছেলে মোতাহারকে বিষয়টি জানান। আর এতে করে আরও বেশি ক্ষিপ্ত হয়ে হাসপাতালে প্রবেশ করে চিকিৎসাধীন রাশেদা ও তার বাবার বাড়ির লোকজনদের উপর অর্তকিত ভাবে হামলা চালিয়ে মারধর করেন মোতাহার ও তার লোকজন। এ সময় তাদের হামলায় রাশেদার ভাই হালিম গুরতর আহত হয়। পরে খবর পেয়ে হাসপাতালে গিয়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করেন পুলিশ।

এ বিষয়ে নির্যাতনের শিকার গৃহবধূ রাশেদা বেগম বলেন, বিয়ের পর থেকে আমার স্বামী ও তার ভাই, মা-বাবা যৌতুকের টাকা জন্য প্রায় আমাকে মারধর ও নির্যাতন করেন। আমি আমার বাবার বাড়িতে ৬শতক জমি ভাগ পেয়েছি। সেই জমি বিক্রি করে টাকা আনতে বলেন। আমি বলছি ওই জমি এখন বিক্রি করবো না, মেয়ে বড় হয়েছে তাই ওই জমি বিক্রি করে মেয়ের বিয়ে দিবো। আর এতেই তারা আরও ক্ষিপ্ত হয়ে আমাকে আরও মারধর ও নির্যাতন করে। আমি থানায় মামলা করেছি আর তাই তারা আরও বেশি ক্ষিপ্ত হয়ে হাসপাতালে এসে আমাকে ও আমার মা ভাই ভাবিকে মারধর করেছে। আমি এর বিচার চাই।

এ বিষয়ে ভুক্তভোগীর ভাই গুরতর আহত আব্দুল হালিম বলেন, মোতাহার একজন মাদক ব্যবসায়ী। এলাকার সবাই জানে সে মাদক ও সুদের ব্যবসা করে। মোতাহারের বাবা আবুল হোসেন বিষয়টি আপোষ মিমাংসা করার জন্য চাপ দেয়। আমরা রাজি না হওয়ার আবুল ক্ষিপ্ত হয়ে তার ছেলে মোতাহারকে ফোন দেয়। আর মোতাহার তার গুন্ডা বাহিনী নিয়ে এসে হাসপাতালে আমাদের উপর হামলা করে। তারা আমার মাথায় আঘাত করেছে ঘটনা স্থলে থাকা লোকজন আমাকে তাদের নিকট থেকে ছিনিয়ে না নিলে তারা আমাকে হত্যা করতো। তারা এতো জঘন্য যে হাসপাতালে এসে হামলা করেছে। আমি এর সঠিক বিচার চাই।

এ বিষয়ে অভিযুক্ত রাশেদার স্বামী ছাদেকুল আলম বলেন, আমার স্ত্রী একজন পাগল। তার মানসিক সমস্যা আছে। সে আমার মায়ের চুল ধরে টানা হেছড়া করে। তাই তাকে সরানোর জন্য একটু মারধর করেছি। আর তার ভাই হালিম আমার চাচাকে হাসপাতালে চড় মরেছে। তাই আমি তার ছেলে মোতাহারকে ফোন করে বিষয়টি জানাই। পরে মোতাহার ও তার লোকজন এসে হালিমকে মারধর করে। হালিম খুব খারাপ।

এ বিষয়ে হাসপাতালে হামলার মূলহোতা মোতাহার হোসেনকে মুঠোফোনে কল করা হলে তিনি বলেন, আপনি কোথায় আছেন, আমি আসতেছি। আমি দেখা করে কথা বলতেছি বলে ফোনটি কেটে দেয়।

এ বিষয়ে হাতীবান্ধা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা(প.প) চিকিৎসক নাঈম হাসান নয়ন বলেন, বিষয়টি উর্দ্ধত্বন কতৃপক্ষকে ও স্থানীয় প্রশাসনকে জানানো হয়েছে। বিষয়টি নিয়ে স্থাস্থ্য কমিটির সাথে আলোচনা করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।

এ বিষয়ে হাতীবান্ধা থানার উপ-পরিদর্শক(এসআই) মহিদুল ইসলাম বলেন, রাশেদা বেগম একটি লিখিত অভিযোগ করেছেন। তদন্ত চলছে, তদন্ত শেষে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

এ বিষয়ে হাতীবান্ধা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা নাজির হোসেন (ইউএনও) বলেন, বিষয়টি জানা নেই। তবে খোঁজ নিয়ে জানতে হবে।

এ বিষয়ে জেলা সিভিল সার্জন চিকিৎসক নির্মলেন্দু গুন বলেন, হাসপাতাল কতৃপক্ষকে ব্যবস্থাকে নিতে পরামর্শ দেওয়া হয়েছে।