তীব্র দাবদাহ থাকতে পারে আরো ৮ দিন

বিগত কয়েকদিন ধরে দুঃসহ গরমে দগ্ধ হচ্ছেন মানুষ। কী বা দিন আর রাত, কিংবা ঘরের ভেতরে বা গাছতলায়; কোথাও স্বস্তি নেই। গাছের পাতা নড়ার কারণে যেটুকু বাতাস বয় তাও গরম, লু হাওয়া।

এরসঙ্গে এবার বাড়তি যুক্ত হয়েছে ঠোঁট ফাটা আর শরীর জ্বলার সমস্যা। বাতাসে জলীয় বাষ্প খুবই কম। যার প্রভাবে এই দশা। এরচেয়েও দুঃসংবাদ হচ্ছে, আজ গরম আরও বাড়তে পারে। বর্তমানে মৃদু থেকে মাঝারি পর্যায়ের তাপপ্রবাহ আছে। এটা সর্বোচ্চ মাঝারি পর্যায়ে পৌঁছাতে পারে। পাশাপাশি গরমের এই ঊর্ধ্বমুখী পরিস্থিতি ২১ এপ্রিল পর্যন্ত একইরকম বিরাজ করতে পারে।

অন্যদিকে বৃহস্পতিবার মৌসুমের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছে চুয়াডাঙায়। সেখানে ব্যারোমিটারের পারদ উঠেছিল ৪১ ডিগ্রি সেলসিয়াসে। এ দিন ঢাকায় সর্বোচ্চ তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয় ৩৯ দশমিক ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস। এটা গত ৩ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ।

এরআগে ২০২১ সালের এপ্রিলে ৩৯ দশমিক ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছিল। এই দুই স্থানের তাপমাত্রাই আগের দিনের চেয়ে বেশি ছিল। বুধবার দেশে সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ছিল চুয়াডাঙ্গায় ৩৯ দশমিক ৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস। আর ঢাকায় বুধবার ছিল ৩৮ দশমিক ৯ ডিগ্রি সেলসিয়াস।

এদিন রাজশাহীতে সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ছিল ৪০ দশমিক ৫ আর বগুড়ায় ৩৭ দশমিক ৫ ডিগ্রি।

আবহাওয়াবিদ মো. ওমর ফারুক মনে করেন, বর্তমান এই পরিস্থিতির জন্য সবচেয়ে বড় দায় পশ্চিমা লঘুচাপের। এর প্রভাবে ভারতের রাজস্থানের মরুভূমি থেকে তপ্ত বায়ু ধেয়ে আসছে। তা সাধারণত বিহার পর্যন্ত বিস্তৃত থাকে। কিন্তু ওই লু হাওয়ার ঝাপটা পশ্চিমবঙ্গ হয়ে বাংলাদেশের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চল ও পশ্চিমাঞ্চলকেও উষ্ণ করে তোলে। সেই বায়ু বিস্তার লাভ করেছে বাংলাদেশের অন্তত ৭টি বিভাগে।

তবে বৃষ্টির দেখা মিললে স্বস্তি মিলত। কিন্তু বৃষ্টিশূন্যতা এ তাপপ্রবাহকে আরও প্রভাবিত করেছে। দেশের বেশিরভাগ স্টেশনে তাপমাত্রা আজ আরও বাড়তে পারে। সাধারণত কোনো এলাকার তাপমাত্রা ৩৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস পার হলে সেখানে মৃদু তাপপ্রবাহ শুরু হয়। এটি ৩৮ ডিগ্রি পার হলে তা পরিণত হয় মাঝারি তাপপ্রবাহে। আর ৪০ ডিগ্রি পার হলে সেটাকে তীব্র তাপপ্রবাহ বলা হয়। যদি ৪২ ডিগ্রি পার হয়, সেটা অতি তীব্র তাপপ্রবাহে রূপ নেয়।

বৃহস্পতিবার মার্কিন আবহাওয়া চ্যানেল ‘দ্য ওয়েদার চ্যানেল’র ১০ দিনের এক পূর্বাভাসে দেখা যায়, দেশের বিভিন্ন স্থানে আজ তাপমাত্রা ৪০ ডিগ্রি সেলসিয়াস থাকতে পারে। কিন্তু ঢাকায় পরিস্থিতির আরও অবনতি ঘটতে পারে। আজ তাপমাত্রা ৪১ ডিগ্রিতে পৌঁছাতে পারে।

এই অবস্থা ঢাকায় ১৬ এপ্রিল পর্যন্ত থাকতে পারে। ১৭ এপ্রিল তাপমাত্রা ১ ডিগ্রি কমে ৪০ ডিগ্রি হলেও তা ১৮ থেকে ২০ এপ্রিল ফের ৪১ ডিগ্রি সেলসিয়াস হবে। ২১ এপ্রিল ফের ৪০ ডিগ্রিতে তাপমাত্রা নামতে পারে। এরপর অবশ্য ২৭ এপ্রিল পর্যন্ত তাপমাত্রা নিম্নমুখী থাকতে পারে। ২৩ এপ্রিল থেকে ঝড়ো হাওয়াসহ কালবৈশাখি বয়ে যেতে পারে।

আবহাওয়া বিজ্ঞানীরা মনে করেন, এপ্রিল বাংলাদেশের উষ্ণতম মাসগুলোর একটি। খরতাপে প্রকৃতি পাগলা হাতির মতো নেচে উঠবে-এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু এর মধ্যেও কখনো স্বস্তির বৃষ্টি হবে। এতে শান্তি আর স্বস্তি খুঁজে পাবে মানুষ। কিন্তু দেশের বিভিন্ন অঞ্চল টানা গরমে পুড়ছে। আবহাওয়া বিভাগের সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, দেশের ৫৬ জেলার উপর দিয়ে মৃদু থেকে তীব্র তাপপ্রবাহ বইছে।

এই গরম পরিস্থিতিকে আরও চরম ভাবাপন্ন করে তুলেছে ‘অনুভব তাপমাত্রা’। বাস্তবে ব্যারোমিটারে যে গরম ধরা পড়ছে, কিন্তু তারচেয়েও বেশি তাপ অনুভূত হচ্ছে। যেমন বৃহস্পতিবার বিকাল সাড়ে ৪টায় ঢাকার বাড্ডা এলাকায় তাপমাত্রা ছিল ৩৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস। কিন্তু এর অনুভূতি ছিল ৩৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস। অপর মার্কিন আবহাওয়া চ্যানেল এসিসিইউ ওয়েদার জানায়, বৃহস্পতিবার বিকাল সোয়া ৪টায় ঢাকার তাপমাত্রা ছিল ৩৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস।

কিন্তু মানুষের কাছে এর অনুভূতি ছিল ৪০ ডিগ্রি সেলসিয়াস। দুপুর দেড়টায় ঢাকার তাপমাত্রা যখন সর্বোচ্চ ৩৮ দশমিক ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস ছিল, তখন রাজধানীর মানুষের শরীরে এর অনুভূতি ছিল ৪৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস। এভাবে দুপুর ১২টার পরই এই অনুভূতি তাপমাত্রার পার্থক্য বাস্তবতার চেয়ে বাড়তে থাকে। দুপুর ২টার দিকে ঢাকার এলাকা ভেদে ২ থেকে ৮ ডিগ্রি পর্যন্ত বেশি অনুভূতি তাপমাত্রা থাকে বলে বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে।

এদিকে এই অনুভূতি তাপমাত্রার সঙ্গে এবারের গরমের নতুন দিক হচ্ছে ঠোঁট ফেটে যাওয়া ও শরীরের চামড়া পোড়া অনুভব করা। আবহাওয়াবিদরা জানান, এর একমাত্র কারণ হচ্ছে জলীয় বাষ্পের ঘাটতি। বাতাসে জলীয় বাষ্প থাকলেও গরম বেশি অনুভব হয়। বিশেষ করে শরীর থেকে অনেক ঘাম ঝরে। তবে ইতিবাচক দিক হচ্ছে, নিঃশ্বাসের সঙ্গে শরীরে আর্দ্রতাপূর্ণ বায়ু প্রবেশ করায় ঘাম ঝরার পরও শরীর খুব একটা ক্লান্ত হয় না।

কিন্তু এখন ঘাম ঝরে না। রুক্ষ বায়ু আর গরম মিলে ত্বকের পানি শুকিয়ে ফেলে। ফলে জ্বালাপোড়া অনুভব হয়। আর জলীয় বাষ্প কম থাকায় ঠোঁটও শুকিয়ে যায়। এ অবস্থায় প্রচুর পানি পান এবং সম্ভব হলে মাঝে-মধ্যে ভেজা নরম কাপড় দিয়ে শরীর মুছে নিলে আরাম বোধ করা যায়। বিশেষ করে শিশুদের ক্ষেত্রে এই থেরাপি খুবই ইতিবাচক হয়।

বাংলাদেশে ডিসেম্বর থেকে ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত যে বায়ু প্রবাহিত হয়, তা উত্তর থেকে পশ্চিম দিকে যায়। ওই বাতাস শুষ্ক থাকে ও আর্দ্রতা কম থাকে। কিন্তু বায়ু শীতল থাকায় শরীরে জ্বালাভাব থাকে না। শুধু আর্দ্রতার অভাবে মানুষের ঠোঁট ফাটে। ঘাম হয় না বললেই চলে।

আর মার্চ থেকে শুরু হয়ে গোটা বর্ষাকালে দক্ষিণ থেকে পশ্চিম দিকে বায়ু প্রবাহিত হয়। এই বাতাস বঙ্গোপসাগর থেকে প্রচুর জলীয় বাষ্প নিয়ে আসে। ফলে বাতাসে আর্দ্রতা বেড়ে যায়। এই হিসাবে এপ্রিলে দক্ষিণ থেকে পশ্চিম দিকে বায়ু যাওয়ার কথা। কিন্তু বর্তমানে বাংলাদেশে পশ্চিমা বায়ু প্রভাব বিস্তার করেছে। এই বায়ু গরম, যা রাজস্থানের দিক থেকে এসেছে।

বিএমডির আবহাওয়াবিদ মো. ওমর ফারুক বৃহস্পতিবার বলেন, এবার বাতাসে আর্দ্রতা স্বাভাবিকের তুলনায় ৩০ শতাংশ কম। বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় ঢাকার বাতাসের আর্দ্রতা ছিল মাত্র ২২ শতাংশ। বুধবার এটা ছিল ৫৩ শতাংশ। অথচ এই সময় এটা ৭০ থেকে ৮৫ শতাংশ পর্যন্ত হয়ে থাকে।

কিন্তু তাপপ্রবাহ শুরুর পর থেকে আর্দ্রতার পরিমাণ কমে গেছে। সংস্থাটি জানায়, বৃহস্পতিবারও দেশের ৭ বিভাগ-রাজশাহী, ময়মনসিংহ, ঢাকা, খুলনা, বরিশাল, চট্টগ্রাম ও সিলেট বিভাগের ওপর দিয়ে মৃদু থেকে মাঝারি ধরনের তাপপ্রবাহ বয়ে যায়। শুধু রংপুর বিভাগের ৮ জেলায় তাপমাত্রা ছিল তাপপ্রবাহের নিচে।

এদিকে বিএমডি দেশের ৪২ স্টেশনে তাপমাত্রা পরিমাপের তথ্য প্রকাশ করে থাকে। বৃহস্পতিবার রাতে প্রকাশিত বুলেটিনে দেখা যায়, উল্লিখিত কোনো স্টেশনেই বৃষ্টিপাতের রেকর্ড নেই। আগামী তিন দিন এমনই বৃষ্টিশূন্য থাকতে পারে দেশ। ১৭ এপ্রিল দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চল বা সিলেট-ময়মনসিংহের দিকে সামান্য বৃষ্টি হতে পারে। কিন্তু অর্থপূর্ণ বৃষ্টির দেখা মিলতে পারে ঈদের পর ২৪ এপ্রিলের দিকে। কিন্তু তা কালবৈশাখি আকারে আসতে পারে। তবু সেই বৃষ্টি প্রাণ-প্রকৃতিকে শীতল করতে পারে।