‘কিংস পার্টি’ হিসেবে স্বকৃতি পেলেও, নির্বাচনে পেল শুধুই আশ্বাস
রাজধানীর গুলশান-২ নম্বরে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের (বিএনএম) নতুন কেন্দ্রীয় কার্যালয়। রোববার ১৭ ডিসেম্বর) বিকেলে গিয়ে দেখা গেল, আলিশান কার্যালয়টিতে কোনো নেতা-কর্মী নেই। আছেন শুধু একজন অফিস সহকারী।
দলটি এবারের জাতীয় নির্বাচনের আগে নিবন্ধন পাওয়া দুটি দলের একটি। অন্যটি তৃণমূল বিএনপি। এই দুই দলের মাধ্যমে বিএনপির নেতাদের অনেককে নির্বাচনে আনার চেষ্টা ছিল। কিন্তু সেই চেষ্টা সফল হয়নি। দল দুটি পরিচিতি পেয়েছে ‘কিংস পার্টি’ হিসেবে।
দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে মনোনয়নপত্র প্রত্যাহারের শেষ দিন আজ দেখা গেল, বিএনএম ও তৃণমূল বিএনপি আওয়ামী লীগের কাছ থেকে কোনো আসনে ছাড় পায়নি। যদিও সংসদে বিরোধী দল ও এবারের নির্বাচনে নিজেদের প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী জাতীয় পার্টিকে ২৬টি আসনে ছাড় দিয়েছে আওয়ামী লীগ। দলটির জোট শরিকেরা ছাড় পেয়েছে ৬টি আসনে।
বিএনএম ও তৃণমূল বিএনপি সূত্র বলছে, তারা পেয়েছে শুধু আশ্বাস। সেটা হলো, দু-একটি আসনে তাদের প্রার্থীদের জেতাতে আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে সহায়তা করা হবে।
বিএনএমের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান শাহ মো. আবু জাফর প্রথম আলোকে বলেন, ‘সরকারের সঙ্গে কোনো আলাপ-সমঝোতা হয়নি। তবে নিরপেক্ষ নির্বাচন হবে, এই আশ্বাস পেয়েছি।’ তিনি বলেন, ‘আমার শক্তি জনগণ, সরকার না। আমাদের প্রার্থীরা নিজেদের সামর্থ্য অনুযায়ী ভোটের মাঠে থাকবেন। নির্বাচনের পরিবেশ না থাকলে পরিস্থিতি বুঝে ব্যবস্থা নেব।’
নির্বাচন কমিশন গত ১০ আগস্ট বিএনএমকে নিবন্ধন দেয়। তবে তখন নিবন্ধন পায়নি নাগরিক ঐক্য, গণসংহতি আন্দোলন, গণ অধিকার পরিষদসহ সক্রিয় কয়েকটি দল। এ নিয়ে ব্যাপক সমালোচনা হয়েছিল। আদালতের নির্দেশে তৃণমূল বিএনপি নিবন্ধন পেয়েছিল গত ফেব্রুয়ারিতে।
আওয়ামী লীগ থেকে জাতীয় পার্টি হয়ে বিএনপিতে যাওয়া সাবেক সংসদ সদস্য শাহ মো. আবু জাফর বিএনএমের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের দায়িত্বে। তিনি গত ২৪ নভেম্বর বলেছিলেন, কয়েক দিনের মধ্যে ৩০ থেকে ৩৫ জন সাবেক সংসদ সদস্য বিএনএমে যোগ দেবেন।
দলটির মহাসচিব মো. শাহ্জাহান বলেছিলেন, তাঁদের চেয়ারম্যান হিসেবে যোগ দেবেন আন্তর্জাতিকভাবে পরিচিত ও চৌকস একজন রাজনীতিবিদ। অবশ্য এখনো কেউ যোগ দেননি।
বিএনএমের কার্যালয় ছিল মহাখালীতে, ছোট দুটি কক্ষে। গত ১৫ নভেম্বর নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার পরে গুলশানে আলিশান কার্যালয় নেওয়া হয়। সেখানে নেতা-কর্মীদের ভিড়ও হতো।
দলটির কার্যালয়ে গিয়ে আজ বেলা সাড়ে তিনটায় দেখা যায়, ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান, মহাসচিব, মুখ্য সমন্বয়কসহ সবার কক্ষই খালি। অফিস সহকারী সাইফুল ইসলামের কাছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, নেতারা মাঝেমধ্যে আসেন।
বিএনএম দলের মনোনয়ন দিতে পেরেছিল ৩০০টির মধ্যে ৮২টি আসনে। তবে নির্বাচন কমিশনের (ইসি) হিসাব অনুযায়ী, বিভিন্ন আসনে বিএনএমের হয়ে মনোনয়নপত্র জমা দিয়েছিলেন ৪৯ জন। কতজন শেষ পর্যন্ত টিকে আছেন, তা জানাতে পারেননি দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান। অবশ্য একজন শীর্ষ নেতার দাবি, প্রার্থিতা প্রত্যাহারের সময় শেষে তাঁদের ৪৪টি আসনে প্রার্থী রয়েছে।
বিএনএমের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান শাহ মো. আবু জাফর প্রার্থী হয়েছেন ফরিদপুর-১ আসন থেকে। ওই আসনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী দলের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য আবদুর রহমান। সেখানে জাতীয় পার্টির প্রার্থীও রয়েছেন, নাম আকতারুজ্জামান খান।
আওয়ামী লীগ ও বিএনএমের একটি সূত্র বলছে, শাহ মো. আবু জাফর ভোটের ক্ষেত্রে কোনো ধরনের বাধা পাবেন না, নেতা-কর্মীদের হয়রানি করা হবে না, এমন আশ্বাস দেওয়া হয়েছে।
শক্ত ‘পরীক্ষায়’ সমশের ও তৈমুর
প্রয়াত মন্ত্রী নাজমুল হুদা প্রতিষ্ঠিত তৃণমূল বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান ছিলেন তাঁর মেয়ে অন্তরা হুদা। তাঁকে সরিয়ে গত ১৯ সেপ্টেম্বর দলের প্রথম সম্মেলনে সভাপতি হন বিএনপির সাবেক ভাইস চেয়ারম্যান সমশের মবিন চৌধুরী, যিনি আমলা থেকে রাজনীতিবিদ হয়েছিলেন। তৃণমূলে আসার আগে ছিলেন বিকল্পধারায়।
মহাসচিব হন বিএনপির চেয়ারপারসনের সাবেক উপদেষ্টা (২০২২ সালে নারায়ণগঞ্জ সিটি নির্বাচনের সময় বহিষ্কৃত) তৈমুর আলম খন্দকার।
তৃণমূল বিএনপি নেতারা নির্বাচনে ৩০০ আসনে প্রার্থী দেওয়া এবং সংসদে প্রধান বিরোধী দল হওয়ার প্রত্যাশার কথাও জানিয়েছিলেন।
তৃণমূল বিএনপি ২৯০টি আসনে মনোনয়ন দিয়েছিল। তবে ইসির তথ্য অনুযায়ী, দলটির প্রার্থী হয়ে মনোনয়নপত্র জমা দেন ১৫১ জন।
দলের নেতারা জানিয়েছেন, রোববার প্রার্থিতা প্রত্যাহারের সময় শেষে তাদের ১৪০ জনের মতো প্রার্থী টিকেছেন।
তৃণমূল বিএনপির চেয়ারপারসন সমশের মবিন চৌধুরী সিলেট-৬ (বিয়ানীবাজার-গোলাপগঞ্জ) আসনে নির্বাচন করছেন। এই আসনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী সাবেক শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ।
তৈমুর আলম খন্দকার নারায়ণগঞ্জ-১ (রূপগঞ্জ) আসন থেকে নির্বাচন করছেন। এই আসনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী বস্ত্র ও পাটমন্ত্রী গোলাম দস্তগীর গাজী।
আওয়ামী লীগ ও তৃণমূল বিএনপি সূত্র বলছে, তৃণমূল বিএনপির শীর্ষ নেতাদের জন্যও অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টির আশ্বাস দেওয়া হয়েছে।
তৈমুর আলম খন্দকার প্রথম আলোকে বলেন, ‘শুরু থেকেই বলেছি, আমরা সরকারের সঙ্গে কোনো জোটে নেই। সরকারের সঙ্গে সমঝোতারও সুযোগ নেই। আসন ভাগাভাগির আলোচনা আমরা করিনি। আমাদের প্রার্থীরা নিজেদের মার্কা নিয়ে লড়বেন।’
সুপ্রিম পার্টিও ‘কিছু’ পায়নি
১৪-দলীয় জোটের শরিক তরীকত ফেডারেশনের চেয়ারম্যান নজিবুল বশর মাইজভান্ডারী চট্টগ্রাম-২ আসনে জোটের মনোনয়ন পাননি। এই আসনে নজিবুল বশরের ভাতিজা ও নতুন নিবন্ধিত দল বাংলাদেশ সুপ্রিম পার্টির চেয়ারম্যান সৈয়দ সাইফুদ্দিন আহমদ মাইজভান্ডারীও প্রার্থী হয়েছেন।
আলোচনা ছিল, এই আসনে সাইফুদ্দিন আহমদকে ছাড় দিতে পারে আওয়ামী লীগ। তবে প্রার্থিতা প্রত্যাহারের শেষ দিনে আনুষ্ঠানিক কোনো ঘোষণা আসেনি।
এই আসনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী প্রয়াত সংসদ সদস্য রফিকুল আনোয়ারের মেয়ে সংরক্ষিত মহিলা আসনের সংসদ সদস্য খাদিজাতুল আনোয়ার (সানি)। তিনি গতবারও দলের মনোনয়ন পেয়েছিলেন। কিন্তু জোটের কারণে সরে দাঁড়ান। এবার জোটকে না ছাড়ায় তিনি লড়াইয়ে রয়েছেন।
এই বিষয়ে কথা বলতে সুপ্রিম পার্টির চেয়ারম্যান সৈয়দ সাইফুদ্দিন আহমদের মুঠোফোনে যোগাযোগ করা হলে তা বন্ধ পাওয়া যায়।
সূত্র বলছে, নির্বাচনে আসন ভাগাভাগির ক্ষেত্রে নিজেদের ‘গুরুত্ব’ ধরে রাখতে পারেনি তৃণমূল বিএনপি, বিএনএম ও সুপ্রিম পার্টির মতো দলগুলো। বিশেষ করে বিএনপির নেতাদের নির্বাচনে আনতে না পারায় দলগুলোর বিষয়ে আওয়ামী লীগের আগ্রহ ফুরিয়ে যায়। তবে তৃণমূল বিএনপি ও বিএনএমের শীর্ষ নেতাদের ভোটে সহায়তা করা হতে পারে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক আওয়ামী লীগের একজন জ্যেষ্ঠ নেতা রোববার রাতে বলেন, আনুষ্ঠানিক সমঝোতা হয়নি। তবে দলগুলোকে সরকারের বিভিন্ন পক্ষ থেকে ভোটে সহযোগিতা করা হবে।
এই রকম সংবাদ আরো পেতে হলে এই লেখার উপরে ক্লিক করে আমাদের ফেসবুক ফ্যান পেইজে লাইক দিয়ে সংযুক্ত থাকুন। সংবাদটি সম্পর্কে মন্তব্য করতে হলে এই পেইজের নীচে মন্তব্য করার জন্য ঘর পাবেন