বিএনপির ঢাউস কমিটির ৬০০ নেতার ৬৩ জন কারাগারে, বাকিদের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন তৃণমূলের

প্রায় দেড় দশক ধরে সরকার বিরোধী আন্দোলন করে আসছে বিএনপি। কখনো ঠিমেতালে কখনো জোর বেগে মাঠে থাকার চেষ্টা করেছে দলটি। তবে সরকার কিংবা ক্ষমতাসীন দলের পক্ষ থেকে কোনো আঘাত এলেই রাজনীতির মাঠ ফাঁকা রেখে যে যার মতো আত্মগোপনে চলে যান দলটির অধিকাংশ কেন্দ্রীয় নেতা।

এবারও ওই অনুশীলনের ব্যত্যয় ঘটেনি। গত বছরের ২৮ অক্টোবর রাজধানীর নয়াপল্টনে দলের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে বিএনপির ডাকা মহাসমাবেশে সংঘাতকে কেন্দ্র করে প্রশাসন কাঁদানে গ্যাস ছুঁড়লে মাঠ ছেড়ে চলে যান দলটির নেতাকর্মীরা। এর পর আড়াই মাস কেটে গেলেও এখনও স্বাভাবিক রাজনীতিতে ফিরে আসতে পারেনি বিএনপি।

বিএনপির প্রায় ৬০০ সদস্যের ঢাউস কেন্দ্রীয় কমিটির বেশিরভাগ নেতা কোথায় আছেন জানেন না দলটির নেতাকর্মীরা। অনেকে গত আড়াইমাসে তৃণমূলের সঙ্গে কোনো যোগাযোগই রাখেননি। কেন্দ্রীয় নেতাদের মধ্যে মাত্র ৬৩ জন গ্রেফতার হয়েছেন। বাকিদের বেশিরভাগই এখনও আত্মগোপনে। তাদের অবস্থান ও ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন তৃণমূলের নেতারা ।

বিগত দিনে আন্দোলন-সংগ্রামে কেন্দ্রীয় নেতাদের ভূমিকা নিয়ে তৃণমূল নেতাদের যথেষ্ট অভিযোগ ছিল। এবারও আওয়ামী লীগকে একতরফা নির্বাচন করতে না দেওয়ার ঘোষণা দিয়ে কেন্দ্রীয় নেতারা ছিলেন ধরাছোঁয়ার বাইরে। ৭ জানুয়ারির নির্বাচনে ভোটারদের উপস্থিতি ঠেকাতে তাদের ভূমিকা চোখে পড়েনি।

যদিও বিএনপি নেতারা বলছেন, তাদের ডাকে সাড়া দিয়ে দেশবাসী নির্বাচন বয়কট করেছে। বাস্তবতা হচ্ছে দুএকটি ব্যতিক্রম বাদে প্রায় সব জায়গায়ই গুরুত্বপূর্ণ নেতারা ছিলেন ধরাছোঁয়ার বাইরে। রাজনৈতিক সঙ্কটে নেতাদের অনুপস্থিতি ভালোভাবে নিচ্ছে না তৃণমূল। দলটির একাধিক নেতার সঙ্গে কথা বলে এমন তথ্য জানা গেছে।

এদিকে বিএনপির কেন্দ্রীয় কমিটির নেতাদের বক্তব্য হচ্ছে—আওয়ামী লীগ ও প্রশাসনের মারমুখী আচরণে তারা প্রকাশ্যে নির্বাচন বানচালে ভূমিকা রাখতে না পারলেও ভেতরে ভেতরে কর্মী-সমর্থকদের মাঠে রেখেছেন। গ্রেফতার এড়াতে তারা আত্মগোপনে ছিলেন। কারণ ২৮ অক্টোবরের পর বিএনপিকে মাঠে দাঁড়াতে কোনো স্পেস দেয়নি পুলিশ-র্যাব-আইনশৃংখলা বাহিনী। যাকে যেখানে পেয়েছে তাকেই গ্রেফতার করা হয়েছে। বাড়ি বাড়ি গিয়ে তল্লাশি চালিয়েছে।

সরকারবিরোধী আন্দোলন করতে গিয়ে দলের হাজার হাজার নেতাকর্মী কারাগারে— এমনটিই দাবি করে আসছিল বিএনপি। নির্বাচনের দিন দলের পক্ষ থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে জানানো হয়, বিএনপির ১৩ হাজার ৪২৪ নেতাকর্মীকে গ্রেফতার করা হয়েছে। ৪৯৯ মামলার এফআইআরে দলটির ৫২ হাজার ৩৪২ নেতাকর্মীকে আসামি করা হয়েছে।

শনিবার বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াসহ কারাগারে থাকা ৬৩ শীর্ষ নেতার মুক্তি চেয়েছেন দলটির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী। তিনি কারাবন্দি নেতাদের যে তালিকা দিয়েছেন সেখানে দলের চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া ও মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরসহ ৬৩ জনের নাম রয়েছে।

তাদের মধ্যে আছেন— দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাস ও আমির খসরু মাহমুদ চৌধুরী; ভাইস চেয়ারম্যান আলতাফ হোসেন চৌধুরী, শামসুজ্জামান দুদু ও আব্দুস সালাম পিন্টু; চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা আমানউল্লাহ আমান, সৈয়দ মেহেদী আহমেদ রুমী, হাবিবুর রহমান হাবিব ও আতাউর রহমান ঢালী; যুগ্ম মহাসচিব মজিবর রহমান সরোয়ার, সৈয়দ মোয়াজ্জেম হোসেন আলাল, খায়রুল কবির খোকন ও আসলাম চৌধুরী; মিডিয়া সেলের আহ্বায়ক জহির উদ্দিন স্বপন; সদস্য সচিব ও দলের প্রচার সম্পাদক শহীদ উদ্দিন চৌধুরী এ্যানি এবং সাংগঠনিক সম্পাদক সৈয়দ এমরান সালেহ প্রিন্স।

সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্যদের মধ্যে কারাগারে রয়েছেন—স্থানীয় সরকারবিষয়ক সম্পাদক অধ্যক্ষ সোহরাব উদ্দিন, বাণিজ্যবিষয়ক সম্পাদক সালাহ উদ্দিন আহমেদ, সমবায়বিষয়ক সম্পাদক জি কে গউছ ও প্রকাশনাবিষয়ক সম্পাদক হাবিবুল ইসলাম হাবিব। সহ-সম্পাদকদের মধ্যে কারাগারে আছেন— সহ-সাংগঠনিক সম্পাদক শরিফুল আলম, সহ-প্রচার সম্পাদক শামীমুর রহমান শামীম, সহ-স্বাস্থ্যবিষয়ক সম্পদাক ডা. রফিকুল ইসলাম বাচ্চু, সহ-গ্রামসরকার বিষয়ক সম্পাদক বেলাল আহমেদ ও সমাজ কল্যাণবিষয়ক সম্পাদক কাজী আবুল বাশার। নির্বাহী কমিটির সদস্য আবু সাঈদ চাঁদ, সাইয়েদুল আলম বাবুল, শেখ রবিউল আলম রবি, আবুল হোসেন খান ও ফজলুর রহমান খোকনও কারাগারে রয়েছেন।

এ ছাড়া ঢাকা মহানগর উত্তরের সদস্য সচিব আমিনুল হক, দক্ষিণের সদস্য সচিব রফিকুল ইসলাম মজনু, দক্ষিণের সাবেক ভারপ্রাপ্ত সদস্য সচিব তানভির আহমেদ রবিন, সাবেক সংসদ সদস্য মিয়া নুরুদ্দীন অপু, যুবদলের সাবেক সভাপতি সাইফুল আলম নীরব, যুবদল সাধারণ সম্পাদক আব্দুল মোনায়েম মুন্না, সাবেক সহসভাপতি এস এম জাহাঙ্গীর, খুলনা জেলা বিএনপির সভাপতি আমির এজাজ খান, দিনাজপুরের দুলাল হোসেন, জয়পুরহাট জেলা বিএনপির আহ্বায়ক গুলজার হোসেন, ফেনির শেখ ফরিদ উদ্দিন বাহার, বরিশাল মহানগর বিএনপির আহ্বায়ক মনিরুজ্জামান ফারুক, নওগাঁ জেলা বিএনপির সদস্য সচিব বায়জিদ হোসেন পলাশ, গাইবান্ধার মাহমুদুন নবী টিটুল, পিরোপুরের লাভলু গাজী, টাঙ্গাইল জেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক ইকবাল হোসেন ফরহাদ, নরসিংদী জেলা বিএনপির সদস্য সচিব মঞ্জুর এলাহী, নারায়ণগঞ্জ মহানগর বিএনপির সদস্য সচিব আবু ইউসুফ টিপু, রংপুরের মাহফুজুন্নবী ডন, পাবনা জেলা বিএনপির সদস্য সচিব খন্দকার মাকসুদুর রহমান মাসুদ, ব্রহ্মণবাড়িয়ার সিরাজুল আসলাম, ফরিদপুরের এ কে কিবরিয়া, শেরপুর জেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক হযরত আলী, নড়াইলের মনিরুল ইসলাম, মেহেরপুরের আমজাদ হোসেন, ঢাকা মহানগর উত্তর বিএনপির যুগ্ম আহ্বায়ক ইউনুস মৃধা, যুবদলের সহসভাপতি ইউসুফ বিন জলিল (মির্জা কালু), ঢাকা মহানগর দক্ষিণ যুবদলের সাবেক সহসভাপতি গোলাম মাওলা শাহীন, ঢাকা মহানগর উত্তর স্বেচ্ছাসেবক দলের সাবেক সাধারণ সম্পাদক আজিজুর রহমান মুসাব্বির, ঢাকা বিশ্ববিদ্যাল ছাত্রদলের সভাপতি খোরশেদ আলম সোহেল এবং ঢাকা মহানগর দক্ষিণ ছাত্রদলের সভাপতি পাভেল সিকদার এই মুহূর্তে কারাগারে রয়েছেন।

রুহুল কবির রিজভী যে ৬৩ জনের তালিকা প্রকাশ করেছেন তাদের মধ্যে কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য মাত্র ২৮ জন। বাকি ৩৫ জন্য মহানগর, জেলা এবং অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনের নেতা। অথচ বিএনপির কেন্দ্রীয় নেতারা সংখ্যা প্রায় ৬০০। এদের মধ্যে জাতীয় নিরর্বাহী কমিটির কর্মকর্তা ও সদস্য মিলে ৫০২ জন, চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা ৭৩ জন এবং দলের সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারণী ফোরাম জাতীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য রয়েছেন ১৪ জন।

এই ৬০০ জনের মধ্যে স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. আব্দুল মঈন খান, নজরুল ইসলাম খান ও সেলিমা রহমান; ভাইস চেয়ারম্যান ডা. এ জেড এম জাহিদ হোসেন, জয়নাল আবেদীন ও নিতাই রায় চৌধুরী; চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা জয়নুল আবদিন ফারুক; ফজলুর রহমান, সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী, যুগ্ম মহাসচিব ব্যারিস্টার মাহবুবউদ্দিন খোকন, হাবিব উন নবী খান সোহেল, আইন সম্পাদক কায়সার কামাল এবং স্বাস্থ্য বিষয়ক সম্পাদক ডা. রফিকুল ইসলামসহ কয়েকজন ছাড়া বাকিদের ২৮ অক্টোবরের পর আন্দোলন-সংগ্রামে খুব একটা দেখা যায়নি। তৃণমূল নেতাকর্মীদের মধ্য থেকে প্রশ্ন উঠেছে বিএনপির এত নেতা থেকে লাভ কী? আন্দোলন সংগ্রামের সময় তারা থাকেন কোথায়?

দলের চেয়ারপারসন এবং পদাধিকার বলে স্থায়ী কমিটির এক নম্বর সদস্য খালেদা জিয়া গ্রেফতার হয়ে ২০১৮ সালের ফেব্রুয়ারি থেকে রাজনীতির বাইরে। স্থায়ী কমিটির দুই নম্বর সদস্য ও ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান গত ১৬ বছর ধরে লন্ডনে রয়েছেন। স্থায়ী কমিটির তিন নম্বর সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন এভারকেয়ার হাসপাতালে ভর্তি। স্থায়ী কমিটির পাঁচ নম্বর সদস্য ব্যারিস্টার জমিরউদ্দিন সরকার ও ১০ নম্বর সদস্য ব্যারিস্টার রফিকুল ইসলাম মিয়া অসুস্থতার কারণে রাজনীতির বাইরে রয়েছেন।

স্থায়ী কমিটির ১১ নম্বর সদস্য মির্জা আব্বাস, ১৫ নম্বর সদস্য মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর ও ১৬ নম্বর সদস্য আমির খসরু মাহমুদ চৌধুরী ২৮ অক্টোবরের মহাসমাবেশের পর থেকে কারাগারে। ১২ নম্বর সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায় আছেন আত্মগোপনে। স্থায়ী কমিটির ১৮ নম্বর সদস্য ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু দীর্ঘদিন ধরে দেশের বাইরে রয়েছেন। স্থায়ী কমিটির ১৯ নম্বর সদস্য সালাহ উদ্দিন আহমেদ গত ৯ বছর ধরে ভারতের মেঘালয় রাজ্যের রাজধানী শিলংয়ে আছেন।
অসুস্থতা ও মৃত্যুজনিত কারণে শূন্য হওয়া স্থায়ী কমিটির পদগুলোও পূরণ হচ্ছে না দীর্ঘদিন।

দলীয় সূত্রমতে, বিএনপির গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে এখন স্থায়ী কমিটির যেসব ভার্চুয়াল বৈঠক হয় সেখানে তারেক রহমান, ড. মঈন খান, নজরুল ইসলাম খান, সেলিমা রহমান ও সালাহউদ্দিন আহমেদ যুক্ত থাকেন। আত্মগোপনে থাকা গয়েশ্বর চন্দ্র রায় মাঝে মাঝে যুক্ত হন।

বিএনপির ৩৫ জন ভাইস চেয়ারম্যানের মধ্যে মৃত্যু ও দল ছেড়ে যাওয়ার পর এই মুহূর্তে পদে আছেন আবদুল্লাহ আল নোমান, মেজর (অব.) হাফিজউদ্দিন আহমেদ, এয়ার ভাইস মার্শাল (অব.) আলতাফ হোসেন চৌধুরী, বরকতউল্লাহ বুলু, মোহাম্মদ শাহজাহান, মীর নাসির, শাহ মোফাজ্জল হোসেন কায়কোবাদ, আবদুস সালাম পিন্টু, ড. ওসমান ফারুক, মেজর জেনারেল (অব.) মাহমুদুল হাসান, আবদুল আউয়াল মিন্টু, অধ্যাপক ডা. এ জেড এম জাহিদ হোসেন, শামসুজ্জামান দুদু, আহমেদ আজম খান, জয়নাল আবেদীন, নিতাই রায় চৌধুরী ও গিয়াস কাদের চৌধুরী। কিন্তু আন্দোলনের সময় হাতে গোনা ৩/৪ জন ছাড়া কাউকে দেখা যায়নি। অবশ্য এদের মধ্যে আলতাফ হোসেন চৌধুরী, শামসুজ্জামান দুদু, আব্দুস সালাম পিন্টু কারাগারে রয়েছেন।

বিএনপি চেয়ারপারসনের ৭৩ জন উপদেষ্টার মধ্যে মৃত্যু এবং দল ছেড়ে চলে যাওয়ার পর এই মুহূর্তে পদে আছেন সারোয়ারি রহমান, রিয়াজ রহমান, মুশফিকুর রহমান, এ জে মোহাম্মদ আলী, আমান উল্লাহ আমান, মিজানুর রহমান মিনু, আবুল খায়ের ভুঁইয়া, ইঞ্জিনিয়র আ ন হ আখতার হুসেইন, অধ্যাপক মাজেদুল ইসলাম, জয়নুল আবদিন ফারুক, জয়নাল আবেদীন ভি পি, মনিরুল হক চৌধুরী, হেলালুজ্জামান তালুকদার লালু, নুরুল হুদা (চাঁদপুর), সৈয়দ মেহেদি আহমেদ রুমী, আবদুল হালিম, এম এ কাইয়ুম, শহীদুল ইসলাম, জহুরুল ইসলাম, ইসমাইল জবিউল্লাহ, ক্যাপ্টেন (অব.) সুজাউদ্দিন আহমেদ, আবদুর রশীদ, ব্যারিস্টার হায়দার আলী, ব্যারিস্টার জিয়াউর রহমান খান, অধ্যাপক তাজমিরী ইসলাম, অধ্যাপক শাহিদা রফিক, আব্দুর রেজ্জাক খান, রোজী কবির, গোলাম আকবর খন্দকার, অধ্যাপক শাহজাহান মিয়া, ফজলুর রহমান (কিশোরগঞ্জ), হাবিবুর রহমান হাবিব, আতাউর রহমান ঢালী, নাজমুল হক নান্নু, তাহমিনা রুশদি লুনা, ড. ইনামুল হক চৌধুরী, ডা. সিরাজুল ইসলাম, অধ্যাপক সুকোমল বড়ুয়া, বিজন কান্তি সরকার, আবদুল হক (সিলেট), আফজাল এইচ খান, কামরুল মুনির, বোরহান উদ্দিন, অধ্যাপক আবদুল বায়েছ ভুঁইয়া, আফরোজা খান রীতা, আবদুস সালাম (ঢাকা মহানগর), ময়নুল ইসলাম শান্ত, মো. শাহজাদা মিয়া, এসএস ফজলুল হক, কর্নেল (অব.) এম এ লতিফ, ডা. মো. আবদুল কুদ্দুস, সৈয়দ আলমগীর হোসেন ও আমিনুল হক। কিন্তু বিএনপির আন্দোলনে দু’ চারজন ছাড়া কাউকে দেখা যায়নি।

অবশ্য এদের মধ্যে আমান উল্লাহ আমান, সৈয়দ মেহেদী আহমেদ রুমী, হাবিবুর রহমান হাবিব ও আতাউর রহমান ঢালী এই মুহূর্তে কারাগারে রয়েছেন। আর সারোয়ারি রহমান ও রিয়াজ রহমান অসুস্থতার কারণে রাজনীতি থেকে দূরে আছেন।

বিএনপির জাতীয় নির্বাহী কমিটির সাত যুগ্ম মহাসচিবের মধ্যে মজিবর রহমান সরোয়ার, সৈয়দ মোয়াজ্জেম হোসেন আলাল, খায়রুল কবির খোকন, লায়ন আসলাম চৌধুরী কারাগারে। বাকি তিনজন ব্যারিস্টার মাহবুব উদ্দিন খোকন, হাবীব-উন-নবী খান সোহেল, হারুন-অর-রশিদ বাইরে থাকলেও মাহবুবউদ্দিন খোকন-সোহেল ছাড়া হারুনকে ২৮ অক্টোবরের পর দেখা যায়নি।

বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক আবদুস সালাম, (ঢাকা), মাহবুবুর রহমান শামীম (চট্টগ্রাম) রুহুল কুদ্দুস তালুকদার দুলু (রাজশাহী), অনিন্দ্য ইসলাম অতিম (খুলনা), আসাদুল হাবিব দুলু (রংপুর) ডা. শাখাওয়াত হোসেন জীবন (সিলেট), এমরান সালেহ প্রিন্স (ময়মনসিংহ), বিলকিছ জাহান শিরিন (বরিশাল) ও শামা ওবায়েদকেও (ফরিদপুর) ২৮ অক্টোবরের পর হরতাল-অবরোধে মাঠে দেখা যায়নি। এদের মধ্যে অবশ্য এমরান সালেহ প্রিন্স ২৮ অক্টোবরের পর থেকে কারাগারে রয়েছেন। আর মাঝে-মধ্যে অনিন্দ্য ইসলাম অমিত নিজ জেলা যশোরে নিজের অনুসারীদের নিয়ে ঝটিকা মিছিল করেছেন।

এ ছাড়া সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য, সহ-সম্পাদক, জাতীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য মিলে বিএনপির কেন্দ্রীয় নেতার সংখ্যা আরও চার শতাধিক। চূড়ান্ত আন্দোলনের সময় এদের বেশির ভাগই ছিলেন নিষ্ক্রিয়। যদিও দলটির শীর্ষ নেতারা বলছেন, ব্যাপক হারে ধরপাকড় ও পুলিশি হয়রানির কারণে সেভাবে রাজপথে নামতে পারেননি বিএনপির নেতাকর্মী, সমর্থকেরা।

জেলার নেতারা বলছেন, ২৮ অক্টোবর মহাসমাবেশ পণ্ডের পর বিএনপি লাগাতার কর্মসূচি দিলেও কেন্দ্রীয় নেতারা মাঠে নামেননি। শীর্ষ কয়েকজন গ্রেফতার হলে কেন্দ্রীয় নেতারা আত্মগোপনে যান। এই সময়ে হরতাল-অবরোধ কর্মসূচিতে মাঠ পর্যায়ের নেতাকর্মী ছাড়া কেন্দ্রীয় নেতাদের দেখা যায়নি। ফলে মামলা-হামলায় জর্জরিত এবং নানাভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন তৃণমূলের নেতাকর্মীরা।

তারা গ্রেফতার আতঙ্কে বাড়িঘর ছেড়ে বনজঙ্গল, ফসলি জমি, খোলা মাঠে রাত্রিযাপন করেছেন। হরতাল-অবরোধে দিনে বিভিন্ন স্থানে মিছিলসহ পিকেটিং করেছেন। অনেকেই এলাকা ছাড়তে বাধ্য হয়েছেন। সরকারদলীয় নেতাকর্মী ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর আতঙ্কে এখনো তৃণমূলের নেতাকর্মীরা বাড়ি যেতে সাহস পাচ্ছেন না। এজন্য গণতন্ত্রের মুক্তি ও সরকারের পতন না হওয়া পর্যন্ত বিএনপিকে আন্দোলন অব্যাহত রাখতে হবে। এজন্য কেন্দ্রীয় নেতাদের উপস্থিতি বাড়াতে জোর দেওয়া জরুরি।

ওইসব নেতা আরও বলেন, নির্বাচন সামনে রেখে বিএনপি ভোট বর্জনের পক্ষে গণসংযোগ ও অসহযোগ আন্দোলন ঘোষণা দিলেও কেন্দ্রীয় নেতারা আত্মগোপন থেকে বের হননি। এতে সরকারবিরোধী আন্দোলন কাঙিক্ষত মাত্রায় পৌঁছেনি। সেই সুযোগে সরকার একরকম নির্বিঘ্নে নির্বাচন করার সুযোগ পেয়েছে। যদিও ভোটকেন্দ্রে ভোটার যায়নি। বিএনপি প্রাথমিকভাবে একদিকে সফল। দেশবিদেশে একতরফার নির্বাচন ‘ডামি নির্বাচন’ হিসাবে প্রতিষ্ঠা পেয়েছে।

চাঁদপুর জেলা বিএনপির সভাপতি শেখ ফরিদ আহমেদ মানিক যুগান্তরকে বলেন, বিএনপির বেশির ভাগ কেন্দ্রীয় নেতার বিরুদ্ধে মামলা রয়েছে। এর মধ্যে তারা সরকারবিরোধী আন্দোলন নানাভাবে চালিয়ে নিয়েছেন। বিএনপির তৃণমূলের নেতাকর্মীরা সামনে থেকে কর্মসূচি বাস্তবায়ন করেছে। সামনের দিনেও নতুন কর্মসূচি আসবে। কেন্দ্র থেকে যেভাবে নির্দেশনা দেবে, আমরা সেটাই বাস্তবায়ন করব।

দলটির বিভিন্ন স্তরের নেতারা প্রায় অভিন্ন তথ্য দিয়ে বলছেন, দেশের অধিকাংশ মানুষ বিএনপির আন্দোলনকে সমর্থন জানিয়েছে। নির্বাচনকে সামনে রেখে বিএনপি আরও কঠোর হতে পারত। তবে নির্বাহী কমিটি ও অঙ্গ সংগঠনের শীর্ষ নেতারা আত্মাগোপনে থাকায় নির্দিষ্ট লক্ষ্য অর্জনে ব্যর্থ হয়েছে। রাজধানীতে যেভাবে আন্দোলন হওয়ার কথা ছিল, এর কিছুই হয়নি। বিভিন্ন সময়ে কয়েকটি অঙ্গ সংগঠনের নেতারা ফাঁকা রাস্তায় কিংবা অলিগলিতে দাঁড়িয়ে ছবি তুলে শীর্ষ নেতাদের কাছে পাঠিয়ে দায় এড়িয়েছেন। সামনের দিনে যেসব কর্মসূচি আসবে, সেখানে কেন্দ্রীয় নেতাদের মাঠে চান নেতারা।

বিএনপির সিনিয়র যুগ্মমহাসচিব রুহুল কবির রিজভী বলেন, সরকারবিরোধী আন্দোলনে সিনিয়র নেতারা নিজ নিজ জায়গা থেকে সর্বোচ্চ কাজ করেছেন। তারা আন্দোলনকে নানাভাবে গতি দিয়েছেন। এত মামলা, হামলা ও গণগ্রেফতারের মধ্যেও তারা কর্মসূচি পালন করেছেন। স্থায়ী কমিটির নেতারাও রাস্তায় রাস্তায় মিছিল, লিফলেট বিতরণ ও গণসংযোগ করেছেন। নানা প্রতিকূলতার মধ্যেও জনগণ বিএনপির পক্ষে ছিল। আমাদের অসংখ্য নেতাকর্মী কারাবন্দি। এর মধ্যেও কেন্দ্র থেকে তৃণমূলের নেতাকর্মীরা সর্বোচ্চ দিয়ে আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছেন।

এদিকে গত বছরের ২৮ অক্টোবর মহাসমাবেশ পণ্ডের পর লাগাতর আন্দোলনে যায় বিএনপি। সমমনা দলগুলো নিয়ে ১২ ধাপে ২৪ দিনের অবরোধ এবং পাঁচ ধাপে ছয়দিনের হরতাল পালন করে দলটি। এতে রাজধানীসহ সারা দেশে কেন্দ্রীয় নেতাদের উপস্থিতি তেমন একটা দেখা যায়নি। তৃণমূলে নেতাকর্মীদের উপস্থিতিও ছিল নগণ্য।

এ বিষয়ে বিএনপির স্থায়ী কমিটির একজন সদস্য বলেন, দীর্ঘদিন আন্দোলন করে এলেও নির্দিষ্ট লক্ষ্য ও আদর্শ থেকে বিচ্যুত হয়নি বিএনপি। শাস্তিপূর্ণ ও গণতান্ত্রিক কর্মসূচি সফল হয়েছে। ৭ জানুয়ারি এর প্রমাণ মিলেছে। জনগণ বিএনপির ডাকা কর্মসূচিতে সাড়া দিয়ে ভোট বর্জন করেছে। আগামী দিনেও গণতান্ত্রিক কর্মসূচি আসবে।

সেখানে জনগণকে সঙ্গে নিয়েই সরকারের পতন ঘটানো হবে। নেতাকর্মীরাও সক্রিয়ভাবে মাঠে আছেন। বিএনপিসহ সমমনা দলগুলো শিগগিরই নতুন কর্মসূচিতে যাবে। কেন্দ্র থেকে তৃণমূল পর্যন্ত নেতাকার্মীরা সংগঠিত হয়ে সেই কর্মসূচি বাস্তবায়ন করবেন।

গত বছরের ২৮ অক্টোবর নয়াপল্টনের মহাসমাবেশ পণ্ডের পর বিএনপির প্রায় ২৫ হাজার নেতাকর্মী কারাগারে। মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলামসহ ৩ জন স্থায়ী কমিটির পাশাপাশি কেন্দ্রীয় নেতাদের অনেকেই কারাবন্দি। তাদেরকে মুক্তকরণের পাশাপাশি গণতান্ত্রিকভাবে আন্দোলন অব্যাহত রাখা হবে। একই সঙ্গে বহির্বিশ্বের কর্মকাণ্ডের ওপর নজর রয়েছে। পরিবেশ ও পরিস্থিতির আলোকে যে কোনো সময় যে কোনো ধরনের কর্মসূচি আসবে।