বেনজীরকে সপরিবারে দুদকে তলব

অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগে পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক (আইজিপি) বেনজীর আহমেদ, তাঁর স্ত্রী জীশান মীর্জাসহ তাঁদের দুই মেয়েকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য তলব করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)।

গতকাল মঙ্গলবার রাজধানীর সেগুনবাগিচায় দুদকের প্রধান কার্যালয় থেকে তলবের এই চিঠি পাঠানো হয়েছে। চিঠিতে আগামী ৬ জুন তাঁদের দুদকের প্রধান কার্যালয়ে হাজির হতে বলা হয়েছে। তাঁদের দুই মেয়ে হলেন ফারহিন রিসতা বিনতে বেনজীর ও তাহসিন রাইসা বিনতে বেনজীর।

তবে আরেক মেয়ে জাহরা জেরিন বিনতে বেনজীর নাবালিকা হওয়ায় তাকে তলব করা হয়নি।অন্যদিকে দেশের সম্পদ অনুসন্ধান চলার মধ্যেই বেনজীর পরিবারের বিদেশে থাকা সম্পদ অনুসন্ধানেও নেমেছে দুদক। বিশেষ করে সিঙ্গাপুর, সংযুক্ত আরব আমিরাত, অস্ট্রেলিয়া, মালয়েশিয়াসহ অন্যান্য দেশে তাঁদের কী পরিমাণ সম্পদ রয়েছে, সেসবের খোঁজও নেওয়া হচ্ছে। দুদকের তিন সদস্যবিশিষ্ট অনুসন্ধান কমিটির প্রধান হাফিজুল ইসলামের সই করা চিঠি বিভিন্ন দপ্তরে পাঠানো হয়েছে।

তাঁর স্বাক্ষরেই তলব করা হয়েছে বেনজীর পরিবারকে। দুদক সূত্র কালের কণ্ঠকে এসব তথ্য নিশ্চিত করেছে।
এরই মধ্যে আদালতের আদেশে বেনজীর পরিবারের মালিকানাধীন রাজধানীর গুলশানে বিশালাকৃতির বিলাসবহুল ফ্ল্যাট, গোপালগঞ্জে ৩৪৫ বিঘা ও মাদারীপুরে ২৭৩ বিঘা জমি জব্দ এবং অসংখ্য ব্যাংক ও বিও অ্যাকাউন্ট অবরুদ্ধ করেছে দুদক।

অনুসন্ধানে দেখা গেছে, দেশের বিভিন্ন এলাকায় যে বিপুল সম্পদ গড়েছেন বেনজীর, তার বেশির ভাগই তিনি কেনেন আইজিপি পদে আধিষ্ঠিত হওয়ার পর।

তিনি আইজিপি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন ২০২০ সালের ১৫ এপ্রিল থেকে ২০২২ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত। নথিপত্র বিশ্লেষণে দেখা যায়, চাকরিজীবনের শেষ দুই বছরে অর্থাৎ আইজিপি থাকাকালেই পরিবারের সদস্যদের নামে ৪৬৬ বিঘা জমি কেনেন বেনজীর। ১৯টি প্রতিষ্ঠানে শত শত কোটি টাকা বিনিয়োগ করে তাঁর পরিবার হয়ে যায় পুরোদস্তুর ব্যবসায়ী পরিবার। আইজিপি পদটি যেন তাঁর কাছে হয়ে ওঠে ‘আলাদীনের চেরাগ’।

জানতে চাইলে দুদক কমিশনার (তদন্ত) মো. জহুরুল হক বলেন, ‘শুধু দেশের সম্পদই নয়, আমরা বিদেশে থাকা সম্পদের বিষয়েও তথ্য সংগ্রহ করছি।

তিনি বলেন, ‘দুদক সব সময় বৈধ সম্পদ এবং সম্পদের উৎস দেখবে। আয়কর নথিতে যত সম্পদই থাকুক না কেন তা দুদকের বিবেচ্য বিষয় নয়। আয়কর নথিতে শুধু অর্থ দেখালেই চলবে না। সেসব অর্থের উৎস ও বৈধতার প্রমাণও দুদককে দেখাতে হবে।’

তিনি আরো বলেন, ‘যদি সম্পদ অবৈধ হয় তাহলে আদালত রাষ্ট্রের অনুকূলে তা বাজেয়াপ্ত করতে পারবেন। এ জন্য অনুসন্ধান পর্যায়ে তাঁর (বেনজীর) সম্পদ ফ্রিজ (জব্দ) করা হয়েছে। কারণ ফ্রিজ না করলে এসব সম্পদ হস্তান্তর হওয়ার শঙ্কা রয়েছে।’

এক প্রশ্নের জবাবে দুদক কমিশনার বলেন, ‘আমরা তথ্য-উপাত্তগুলো সংগ্রহ করছি। এগুলো পর্যালোচনা করা হচ্ছে। শুধু তথ্য সংগ্রহ করলেই চলবে না। আমরা তাঁর (বেনজীর আহমেদ) কথাও শুনব। তাঁরও তো বক্তব্য থাকতে পারে। সম্পদ বৈধ হলে তা প্রমাণ করার যথেষ্ট সুযোগ তিনি পাবেন।’

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক দুদকের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেন, স্ত্রীর ও সন্তানদের মৎস্য ব্যবসা দেখিয়ে আয়কর নথিতে অনেক অর্থ-সম্পদ দেখিয়েছেন বেনজীর। কর দিয়ে বিপুল সম্পদ আয়কর নথিতে দেখালেও এসব সম্পদের উৎসর খোঁজ নেওয়া হচ্ছে। আর বিদেশে থাকা সম্পদের বিষয়ে তথ্য দিতে বাংলাদেশ ফিন্যানশিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিটকে (বিএফআইইউ) চিঠি দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া গোয়েন্দা সোর্সের মাধ্যমে কমিশনের অনুসন্ধান টিম সিঙ্গাপুর, দুবাই, অস্ট্রেলিয়া ও কানাডায় থাকা অবৈধ সম্পদের বিষয়ে খোঁজ নিচ্ছে। অনুসন্ধানে জানা গেছে, বেনজীর আহমেদের ক্যাশিয়ার হিসেবে পরিচিত ছিলেন যুক্তরাজ্যপ্রবাসী সাব্বির বিকাশ। সেই সাব্বির বিকাশের মাধ্যমেই দেশের টাকা কৌশলে বিদেশে পাচার করেছেন বেনজীর আহমেদ। অবৈধ সম্পদের বিষয়ে কালের কণ্ঠে অনুসন্ধানী প্রতিবেদন প্রকাশিত হওয়ার পরপরই দেশ ছেড়ে পালিয়ে যান বেনজীরের ঘনিষ্ঠ সহযোগী সাব্বির বিকাশ।

বেনজীরের বিরুদ্ধে ক্ষমতার অপব্যবহার ও অবৈধ সম্পদ অর্জনের যেকোনো অভিযোগ গুরুত্বসহকারে আমলে নিচ্ছে দুদক। দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে তাঁর বিরুদ্ধে নানা তথ্য দুদকে আসা শুরু হয়েছে। এ ছাড়া কমিশনের অনুসন্ধান টিম দেশের সব মিডিয়ায় প্রকাশিত সব ধরনের তথ্য সংগ্রহ করে তা পর্যালোচনা করছে। ওই কর্মকর্তা কালের কণ্ঠকে জানান, অনেক ভুক্তভোগী দুদকের একাধিক কর্মকর্তার সঙ্গে যোগাযোগ করছেন। ধীরে ধীরে বেনজীরের বিরুদ্ধে অভিযোগের পাল্লা আরো ভারী হচ্ছে।

দুদকের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে ঢাকা মহানগর সিনিয়র স্পেশাল জজ মোহাম্মদ আসসামছ জগলুল হোসেন গত ২৪ মে বেনজীর আহমেদ, তাঁর স্ত্রী, দুই মেয়ে ও এক স্বজনের নামে থাকা ৩৪৫ বিঘা (১১৪ একর) জমি ক্রোক বা জব্দের আদেশ দেন। একই দিন বেনজীর ও তাঁর স্ত্রী-সন্তানদের নামে বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি ব্যাংকে থাকা ২৩টি ব্যাংক হিসাব (অ্যাকাউন্ট), ক্রেডিট কার্ড চারটি ও বিও অ্যাকাউন্ট ছয়টি অবরুদ্ধের আদেশ দেওয়া হয়।