রংপুরের দেয়াল এখন আন্দোলনের রাঙা পোস্টার

অধিকার আদায়ে বাঙালি জাতির আন্দোলন-সংগ্রামের ইতিহাস গর্বের। বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন, উনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান, একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ, নব্বইয়ের স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনের মতো চব্বিশের বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন বাংলাদেশের ইতিহাসের পাতায় যোগ করেছে আরেকটি গৌরবোজ্জ্বল অধ্যায়।

ইতিহাসে কোন কোন সময় এমন আসে যখন এক একটা মিনিটের ব্যাপ্তি, গভীরতা এবং ঘনত্ব শত বছরকে ছাড়িয়ে যায়। আমাদের জীবনে চব্বিশের বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন সে রকম। এই আন্দোলনের মর্মবাণীর মোহন সুন্দর বজ্র নিনাদ যাদের বুকে বেজেছে, তারা ছাড়া অন্য কেউ এর তাৎপর্য উপলব্ধি করতে পারবে না।

জুলাইয়ের প্রথম থেকেই বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের ব্যানারে গোটা দেশের ছাত্ররা একত্রিত হতে থাকে। ছাত্রদের শান্তিপূর্ণ অবরোধে প্রশাসনের অযাচিত শক্তি প্রয়োগ ও নির্বিকার গুলিবর্ষণ, এ আন্দোলনকে গণমানুষের আন্দোলনে পরিণত করে। দেশের বুদ্ধিজীবী, সুশীল সমাজ, শিল্পী-সাহিত্যিকসহ সকল শ্রেণি-পেশার মানুষ শিক্ষার্থীদের হত্যার বিচার ও বৈষম্যহীন দেশ গড়ার প্রত্যয় নিয়ে রাজপথে নেমে আসে। তখন আন্দোলন পায় নতুন রূপ।

সৃষ্টিশীল ছাত্র-জনতা মিছিল-অবরোধের আন্দোলনকে উঠিয়ে আনে গান, কবিতা আর দেয়ালচিত্রে। রংপুরের দেয়াল তখন হয়ে উঠে আন্দোলনের রাঙা পোস্টার। দেয়ালগুলোতে ছাত্র-জনতা তাদের ক্ষোভ, ঘৃণা আর দ্রোহের ভাষা ফুটিয়ে তোলে। ‘এই শিকল পড়েই শিকল তোদের করবোরে বিকল’ কিংবা ‘দড়ি ধরে মারো টান, রাজা হবে খান খান’ -এর মতো অসংখ্য স্লোগানে ভরে যায় রংপুরের দেয়াল।

কোথাও শিক্ষার্থীরা প্রতিবাদ করে লিখেছে ‘আমার খাও, আমার পরো, আমাকেই গুলি করো’ আবার কোথাও লিখেছে ‘তোমার কোটা তুমি নাও, আমার ভাইকে ফিরিয়ে দাও’। দেয়ালচিত্রগুলোতে শিক্ষার্থীরা তাদের স্বকীয়তার বর্ণনা দিয়েছে এভাবে ‘জেনো ওহে! আমাদের রক্তে চারটি কণা; শ্বেত, লোহিত, অনুচক্রিকা সঙ্গে বারুদদানা’ কখনো বা সতীর্থদের সাহস জোগাতে লিখেছে, ‘বন্ধু তোমার ছাড়ো উদ্বেগ, সুতীক্ষ্ণ করো চিত্ত, বাংলার মাটি দুর্জয় ঘাঁটি বুঝে নিক দুর্বৃত্ত’। আন্দোলনকে যে কতটা শৈল্পিকভাবে তুলে ধরা যায়, এই দেয়ালচিত্রগুলোই তার উদাহরণ।

তবে আন্দোলন সফল হবার পর বদলে যায় দেয়ালের লিখন, ভাষা ও চিত্র। দেয়ালে নতুন করে ফুটিয়ে তোলা হয় দেশপ্রেম, সাম্য, ভ্রাতৃত্ববোধ আর নতুন দেশের স্বপ্ন। রংপুর চেকপোস্ট এলাকার দেয়ালগুলোতে শিক্ষার্থীরা লিখেছে ‘সমুদ্রজুড়ে গর্জন, সবসময় আমারই থাক’, ‘গণতন্ত্র মূলমন্ত্র’; ‘আমি একবার দেখি, বার বার দেখি, দেখি বাংলার মুখ’-এর মতো অনেক স্লোগান।

রংপুর লালকুঠির মোড়ের দেয়ালগুলোতে লেখা রয়েছে ‘ন্যায়কে ন্যায় বলি, অন্যায়কে না বলি’, ‘আর নয় অত্যাচার, দেশ হোক সংস্কার’। রংপুর ডিসির মোড় এলাকার দেয়ালে লেখা ‘ধর্ম যার যার, দেশ সবার’। রংপুর সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের দেয়ালে লেখা ‘বিকল্প কে? তুমি, আমি, আমরা’; ‘দুর্নীতির দিন শেষ, অধিকারের লড়াইয়ে বাংলাদেশ’-এর মতো অসংখ্য দেয়াল চিত্র।

যেখানে শিল্প হয়ে উঠেছে নাগরিক প্রতিবাদ ও শপথের সম্মিলিত ভাষা।

আন্দোলনের প্রাপ্তির সাথে মাতৃভূমির সংকট-সম্ভাবনায় আপসহীন আত্মত্যাগকারী শহিদদের প্রতি আমরা শ্রদ্ধা জানাই। তাঁদের রেখে যাওয়া স্বপ্নকে পূর্ণতা দিতে আগামী প্রজন্মের জন্য একটি বৈষম্যহীন ও বাসযোগ্য বাংলাদেশ তৈরিতে আমরা প্রতিজ্ঞাবদ্ধ।

তাই এই মৃত্যুঞ্জয়ী বিপ্লবীদের চেতনার সঙ্গে কণ্ঠ মিলিয়ে আমরাও বলতে চাই ‘এসো রবিশঙ্করের সুরে সুরে মুমূর্ষু মানবতাকে গাই/ বিবেকের জং ধরা দরোজায় প্রবল করাঘাত করি/ অন্যায়ের বিপুল হিমালয় দেখে এসে ক্রুদ্ধ হই, সংগঠিত হই/ জল্লাদের শাণিত অস্ত্র, সভ্যতার নির্মল পুষ্পকে আহত করার পূর্বে, দর্শন ও সাহিত্যকে হত্যা করার পূর্বে, এসো বজ্র হয়ে বিদ্ধ করি তাকে।’